হালাল উপার্জন ও পেশায় ইসলাম উৎসাহ দেয়

ইসলামে হালাল উপার্জন করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং ইবাদততুল্য বলে
ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে উপার্জনহীনতাকে।
ইসলামে পরনির্ভরতাকে চরম অপছন্দনীয় কাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নবী-
রাসুলগণ সবাই শ্রমনির্ভর ছিলেন। নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। কুরআন ও
হাদিসে শ্রমের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘লা রাহবানিয়্যাতা
ফিল ইসলাম’ ইসলামে কোনো বৈরাগ্য নেই। বৈরাগ্য মানুষকে মূলত কর্ম ও সমাজবিমুখ করে দেয়। নামাজের পরই আল্লাহ জীবিকার  জন্য বের হতে বলেছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো’ (সুরা জুমা : ১০)। এখানে অনুগ্রহ অনুসন্ধান করার দ্বারা অর্থনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত হতে নির্দেশ করা হয়েছে। তবে কাজকর্ম করতে গিয়ে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া যাবে না।

উপার্জন ও ব্যয় :

সম্পদ উপার্জন, পরিশ্রম, জাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি প্রত্যেকটিই অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। ইহকাল ও পরকালে মান-সম্মান লাভের মাধ্যম। দানের জন্য অর্থকড়ি লাগবে,
তাই উপার্জন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন
করো এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দিই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট
তা ব্যয় করো’ (সুরা বাকারা : ২৬৭)। এ আয়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, উপার্জিত
সম্পদ থেকে যেন দান-খয়রাত করা হয়, আর উপার্জনটা হারাম না হালাল সেটাও
যেন পরখ করে দেখা হয়।

 উপার্জন এর জন্য পেশা নির্বাচন :

মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পর নবীজি (সা.) মদিনার ভূমিগুলো চাষাবাদ করার
জন্য সাহাবিদের প্রতি খুব তাগিদ দিলেন। তবে তিনি মুসলমানদের শুধু নির্দিষ্ট কোনো পেশায় না থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। কর্মসংস্থানের পরিধি ব্যাপ্ত করতে বলেছেন। যেমন নবী-রাসুলদের ভিন্ন ভিন্ন পেশা ছিল। হজরত ইউসুফ (আ.) মিসর সম্রাটের
বাড়িতে সেবকের কাজ করেছেন। হজরত শুয়াইব (আ.) ও হজরত সালেহ (আ.) ব্যবসা করেছেন। আর দাউদ (আ.)-এর কর্মকার হওয়ার বিষয়টি তো খুবই প্রসিদ্ধ। আল্লাহ
তায়ালা বলেন, ‘আর আমি তাকে (দাউদ) তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে এটা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে’ (সুরা আম্বিয়া : ৮০)। আমাদের নবী (সা.) তো অনেক পেশার কাজ করেছেন। যৌবনে তিনি খাদিজা (রা.)-এর কৃতদাস মায়সারার
সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। পবিত্র কাবা শরিফ নির্মাণের কাজে অংশগ্রহণ করেছেন।
নিজে পাথর বহন করেছেন। টাকার বিনিময়ে মক্কার লোকদের বকরি ও মেষ চড়িয়েছে
নিজ হাতের উপার্জন : নবীজি (সা.) বলেন, ‘উত্তম উপার্জন হলো নেক ব্যবসা এবং
স্বহস্তে উপার্জন’ (বুখারি : ২০৭২)। হাদিসটিতে দুটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, একটি
হচ্ছে-উত্তম উপার্জন হলো, যা মানুষ নিজে উপার্জন করে এবং নিজ হাতে উপার্জন করে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কাজেকর্মে ধোঁকা-প্রতারণা এবং আত্মসাতের আশ্রয় যেন না নেওয়া হয়।

নবীদের সুন্নত :

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ নবী ও রাসুলরা। তাঁরাও কোনো না কোনো পেশা অবলম্বন করেছেন, শ্রম দিয়েছেন। আদি পিতা আদম (আ.) কৃষক ছিলেন। হজরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন। হজরত ইদ্রিস (আ.) দর্জি
ছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) রাজমিস্ত্রি ছিলেন। হজরত ইসমাঈল  (আ.) রাজমিস্ত্রির জোগালি ছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ছাগল চরিয়েছেন।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের
কারও পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা কারও কাছে সুওয়াল করার চেয়ে উত্তম। কেননা অনেক সময় সুওয়াল করলে সে দিতেও পারে,
আবার না-ও দিতে পারে’ (বুখারি : ২০৭৪)। হাদিসটির নির্দেশনা হলো, কাজকর্ম ও শ্রম মানুষকে অপরের কাছে হাত পাতা থেকে রক্ষা করে। নিজেকে অপদস্থতা থেকে
বাঁচিয়ে রাখে। বৈধ কাজ বা পেশা যে ধরনের হোক না কেন সেটি অবশ্যই নবীদের সুন্নত।
সাহাবিদের কর্মপন্থা : সাহাবায়ে কেরামও নবীজি (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। হজরত আবু বকর (রা.) ব্যবসা করেছেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র-সংক্রান্ত কাজের জন্য
বাধ্য হয়ে ব্যবসা ছেড়েছেন। হজরত ওমর (রা.) ব্যবসা করেছেন। তিনি মুসলমানদেরকে হালাল রিজিক অনুসন্ধানের জন্য কাজ করতে খুব উৎসাহ দিতেন। হজরত ওসমান (রা.) জাহেলিয়াত ও ইসলাম উভয় সময়কালে কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। আলী (রা.) বিনিময় হিসেবে কিছু খেজুর পাওয়ার জন্য কূপ থেকে পানি ওঠানোর কাজ করতেন।
খাব্বাব (রা.) কর্মকার ছিলেন, এটা অনেকেই জানেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)
মেষ-বকরি চরাতেন। সাহাবায়ে কেরাম মূলত বিভিন্ন পেশার ছিলেন। আনসাররা
সাধারণত কৃষিকাজ করতেন। আর মুহাজিররা সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
নবীজি (সা.) সব কাজই সমানভাবে উৎসাহিত করতেন।

উত্তম খাদ্য :

হজরত মিকদাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম
খাদ্য আর নেই, যা মানুষ স্বহস্তে উপার্জনের মাধ্যমে করে। নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন’ (বুখারি : ২০৭২)। যেকোনো পেশা অবলম্বন
করা হোক, তা যেন হালাল পন্থায় হয় সেদিকে সর্বোচ্চ দৃষ্টি দিতে হবে। কাজে ও
চাকুরিতে সততা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে। হালাল খাবার মহান আল্লাহর
ভালোবাসা এবং জান্নাত লাভের রাস্তা। দোয়া কবুলের হাতিয়ার। বয়সে বরকত হয়
এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায় এতে। দুনিয়ার সৌভাগ্য এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে
সহায়ক হয়। কথায় মিষ্টতা আনে। আমল করার আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। হালাল উপার্জনে বংশের মধ্যে  বরকত হয়। পক্ষান্তরে অবৈধ এবং হারাম ধনসম্পদ বিপদ-
মুসিবত ডেকে আনে। ডেকে আনে পতন। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই
গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর
উপযোগী’ (তিরমিজি : ৬১৪)। হারাম সম্পদ কম আর বেশি নয়, এর থেকে বিরত
থাকতে হবে। কেননা একমাত্র হালাল খাবার দ্বারাই সমাজজীবন ঠিক থাকে। দোয়া
কবুল হয়। সবকিছুতে বরকত হয়। আল্লাহ আমাদেরকে হারাম থেকে বাঁচার এবং
হালালের কদর করার তওফিক দান করুন।