কত রকম বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ি এ জগতে! এখানে ভালো মানুষ আছে, মন্দ মানুষও আছে। গরীব ও অসহায় মানুষ আছে,
আছে ধনী ও বিত্তবান মানুষ। মালিক আছে, শ্রমিক আছে, আছে কর্তৃপক্ষ-কর্মচারী। কেউ শিক্ষিত, কেউ অশিক্ষিত।
কেউ নরম, কেউ গরম। এভাবে নানা রকমের নানা পেশার নানা শ্রেণির মানুষের সাক্ষাৎ আমরা প্রতিনিয়তই পাই।
সমাজবদ্ধ এ জীবনে মানুষের শ্রেণি-পেশা ও অবস্থার বৈচিত্র্য অপরিহার্য। জগতের এক স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেই কর্মচারী
ও শ্রমিক বারবার মালিকের দুয়ারে ফিরে যায়। তাদের জীবনের অবলম্বন খুঁজে বেড়ায়। জীবনের কোনো এক অনাকাক্সিক্ষত ঝাপটায় নিরুপায় হয়ে অসহায় মানুষ গিয়ে হাত পাতে ধনীর দুয়ারে। চাকরির সন্ধানে বেকার যুবককে ঘুরতে হয় কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে। ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক বিভিন্ন প্রয়োজনে ছুটোছুটি করতে হয় নানান অফিসে। এই যে একে অন্যের কাছে
ঘুরে বেড়ানো, এটা যেমন একটা স্বাভাবিক বাস্তবতা, তেমনি একজন আরেকজনের কাছে গিয়ে কখনো আইনি কারণে, কখনোবা অনৈতিক কোনো কারণে, আবার কখনো আস্থা ও বিশ্বাসের কিছুটা সংকটের কারণে মানুষ আটকে যায়, এটাও
এক অনস্বীকার্য বিষয়। তখনই প্রয়োজন হয় সুপারিশ। জাগতিক প্রয়োজনে এ সুপারিশ আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সুপারিশ যেমনই হোক, যার জন্যে সুপারিশ করা হয় সে তো প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা অসহায়ত্বের মুখে পড়েই অন্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। প্রয়োজনের মুহূর্তে তাই একটু সুপারিশঅনেক বড় এক সেবা। মানুষের এই সমাজে একজনের প্রয়োজনে আরেকজন সঙ্গে থাকবে, একজনের অসহায়ত্বের সময় আরেকজন পাশে এসে দাঁড়াবে-এটা যেমন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিচায়ক, এর পাশাপাশি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে এর এক মহা প্রতিদানের কথা। হযরত রাসূল
সা. বলেছেন–
মুসলমান মুসলমানের ভাই, একে অন্যের সুপারিশ করা।
সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমানিত করতে এবং শত্রুর হাতে তুলে দিতে
পারে না। আর যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। যে (দুনিয়াতে) কোনো মুসলমানের একটি বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেয় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন।
হাদীসে উল্লেখিত এই যে এক ভাই আরেক ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের দুশ্চিন্তা
দূর করে দেয়া, এগুলো যেমন কেউ নিজেও করতে পারে, আবার নিজে না পারলে অন্যকে সুপারিশ করে করিয়েও দিতে পারে। এ দুটি কাজের যে প্রতিদানের কথা এখানে ঘোষিত হয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আল্লাহ যদি কারও প্রয়োজন পূরণ
করে দেয়ার ওয়াদা করেন, তাহলে তার আর চিন্তা কীসের! দুনিয়ার জীবনের নানামুখী সংকট মোকাবেলায় এর চেয়ে প্রশান্তিদায়ক অঙ্গীকার আর কোথায় কার কাছে পাওয়া যাবে?
দ্বিতীয়ত, দুনিয়াতে কেউ কারও একটি দুশ্চিন্তা দূর করে দিলে বা বিপদ থেকে উদ্ধার করলে পরকালে আল্লাহ তার একটি দুশ্চিন্তা ও বিপদ দূর করে দেবেন। পরকালের যে কঠিন ও সংকটময় পরিস্থিতির কথা আমরা পড়ি ও শুনি, সেসময় আল্লাহ
যদি কোনো দুশ্চিন্তা সরিয়ে দেয়ার কথা দেন, এর চেয়ে বড় প্রতিদান আর কী হতে পারে?
নিজে সরাসরি সহযোগিতা করে যেমন এ পুণ্য হাসিল করা যেতে পারে, তেমনি নিজের সামর্থ্য না থাকলেও অন্য কারও
কাছে একটু সুপারিশ করে সহযোগিতা করার সুযোগ যার আছে, সেও তার আমলনামাকে সমৃদ্ধ করতে পারে এর মধ্য দিয়ে।
এ সুপারিশ সহযোগিতা, পারস্পরিক কল্যাণকামনা আর একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর এক মাধ্যম। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সুপারিশতাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পবিত্র কুরআনে সুপারিশ এর বর্ণনা:
যদি কেউ কোনো ভালো (কাজের) সুপারিশকরে তাহলে তাতে তার অংশ থাকবে, আর কেউ কোনো মন্দ (কাজের)
সুপারিশকরলে তাতে তার অংশ থাকবে; আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে নযর রাখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৮৫
আয়াতের মর্ম স্পষ্ট-কেউ যদি কাউকে সুপারিশকরে কোনো একটি কাজ করিয়ে দেয়, তাহলে এর প্রতিদান সে পাবেই। সুপারিশকৃত কাজটি যদি ভালো হয় প্রতিদানও ভালো হবে। কাজটি মন্দ হলে প্রতিদানও হবে মন্দ। অসহায় গরীব কাউকে
দান করলে দানকারী যেমন সওয়াব পায়, সে যদি কারও সুপারিশে দান করে থাকে তাহলে সুপারিশকারীও এ দানের কারণে সওয়াবের অংশীদার হবে। হাদীসের ভাষ্য-
নিশ্চয়ই কল্যাণ ও পুণ্যের পথ যে দেখিয়ে দেয় সেও পুণ্যকারীর মতোই সওয়াব পাবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭০
আর সুপারিশের মধ্য দিয়ে একে অন্যকে এ কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকে। মন্দ কাজের বিষয়টিও অনুরূপ। সেখানে যে কোনোরূপ সহযোগিতা যেমন গোনাহের কাজ, তেমনি সহযোগিতা যদি কারও সুপারিশের কারণে হয় তাহলে এ সুপারিশও গোনাহের কাজ। আয়াতের এ মর্ম আমাদেরকে সুপারিশের ক্ষেত্র অনেকটাই স্পষ্ট করে দেয়। অর্থাৎ সুপারিশকরতে হবে কেবলই ভালো কাজে, কল্যাণকর কাজে। মন্দ ও গোনাহের কোনো কাজে কারও পক্ষে সুপারিশ করা যাবে না।
সুপারিশ হতে হবে কেবলই ভালো কাজে:
সূরা নিসার উপরোক্ত আয়াত থেকে এ কথাও জানা যায়, সুপারিশ যেমনই হোক, ভালো-মন্দ যাই হোক, সুপারিশকারী
এর প্রতিদান পাবেই। এক্ষেত্রে সুপারিশ গৃহীত হল কিনা-তা বিবেচ্য বিষয় নয়। কেউ যদি ভালো কোনো কাজের সুপারিশ
করে তাহলে সুপারিশ গৃহীত না হলেও সে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে না। আবার কেউ যদি কোনো পাপ কাজের জন্যে
সুপারিশ করে আর তার সুপারিশ গৃহীত না হয়, তবুও তাকে বইতে হবে গোনাহের ভার।
সহীহ বুখারীর একটি হাদীস, হযরত আবু মূসা রা. বর্ণনা করেন-
রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে যখন কোনো সাহায্যপ্রার্থী আসত, কিংবা তাঁর কাছে কোনো প্রয়োজনের কথা বলা হতো, তিনি
তখন (উপস্থিত সাহাবীদের) বলতেন, তোমরা (তার পক্ষে) সুপারিশকর, তাহলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। আর আল্লাহ যা চান,
তাঁর নবীর জবানে সেই ফয়সালাই করাবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৩২
এ হাদীসটিতে উপরোক্ত বিষয়টি আরও সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। রাসূল সা. এখানে বলছেন, অভাবী অসহায় কেউ যখন
আসে তোমরা তার পক্ষে সুপারিশ করো। সুপারিশ করলেই যে সেটা গৃহীত হবে এমন নয়। কিন্তু তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক আর নাই হোক, তোমরা কোনো অবস্থাতেই এর সওয়াব ও প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না।
এ হাদীসের আরেকটি শিক্ষা-সুপারিশকরলেই যে তা গ্রহণ করতে হবে এমন নয়। সুপারিশতো একটি পরামর্শ মাত্র,
একটি অনুরোধ। সুপারিশকারী ভালো মনে করলে সুপারিশ করবেন, আর যার কাছে সুপারিশ করা হল তিনি ভালো মনে
করলে সে সুপারিশ গ্রহণ করবেন। কথা এতটুকুই। রাসূল সা. বলেছেন, তোমাদের সুপারিশ তোমরা কর, আর আল্লাহ
তাআলা যেটা চান, তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে সেটাই ফয়সালা করাবেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও সুপারিশ যদি গ্রহণ করতেই হয়,
সেটা সুপারিশকারীর ভয়েই হোক কিংবা তার ক্ষমতা ও দাপটের কারণেই হোক, তখন তা আর সুপারিশ থাকে না। এটাকে হয়তো ‘আদেশ’ বলতে হবে, কিংবা বলতে হবে ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’। এটা সুপারিশনয়। সুপারিশকারীকে এমন উদার
মানসিকতা নিয়েই সুপারিশ করতে হবে-আমার কথা তিনি রাখতেও পারেন, নাও রাখতে পারেন। সুপারিশ যদি গৃহীত না
হয় তাহলে এ নিয়ে তার রুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
হযরত রাসূল সা. এর সুপারিশ:
পবিত্র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সুপারিশের ঘটনা লক্ষ করুন-তিনি কতটা উদার মনে সুপারিশ করতেন।
দুই সাহাবী-হযরত মুগীছ রা. এবং হযরত বারীরা রা.। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। বিয়ের সময় হযরত বারীরা ছিলেন আরেকজনের দাসী। হযরত বারীরা রা.-এর মনিব হয়তো তার অমতেই তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন হযরত মুগীছ রা.-এর কাছে। বারীরা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু তার স্বামী মুগীছ রা.-এর গঠন-আকৃতি সুন্দর ছিল না। এরপরের কথা। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এই দাসীকে কিনে আজাদ করে দিলেন। হযরত বারীরা যখন স্বাধীন হয়ে গেলেন, তখন ইসলামী
শরীয়তের বিধানানুসারে তার বিয়েটি টিকিয়ে রাখার কিংবা ভেঙ্গে দেয়ার এখতিয়ার লাভ করলেন। এই এখতিয়ারের
ভিত্তিতে তিনি তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দেন। হযরত মুগীছ রা. অনেক অনুনয়-কান্নাকাটি করেও বারীরার মন
গলাতে পারেননি। অবশেষে হযরত রাসূল সা. কে বললেন : আপনি আমার জন্যে সুপারিশ করুন। রাসূল সা. হযরত
বারীরা রা-কে তার সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করতে সুপারিশকরলেন-