সুপারিশ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সুপারিশ করা, কারো জন্য মধ্যস্থতাকারী হওয়া, কারো প্রয়োজন সমাধা করার জন্য অন্যের কাছে আবেদন করা একটি সামাজিক আমল। সব এলাকা
ও সব জমানাতেই তা পাওয়া যায়। কারো উপকার করা কিংবা অপকার দূর করার জন্য কারো কাছে আবেদন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
সুপারিশের প্রতিদান :
ভালো কাজে সুপারিশ করা একটি সৎকর্ম। সৎকর্মে সাহায্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে
একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ২)
এ ছাড়াও স্পষ্টভাবে বিভিন্ন হাদিসে সুপারিশ করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ সে কোনো মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে ব্যাপৃত থাকে। তোমরা সুপারিশ করো, সওয়াব পাবে। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় পয়গম্বরের মাধ্যমে যে ফয়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট থাকো।’ হজরত মুয়াবিয়া রা: থেকে বর্ণিত, নবীজী সা: বলেন, ‘সুপারিশ করে সওয়াব অর্জন করো, তোমাদের কোনো প্রয়োজন দেখলে আমি তা মাথায় রাখি যে, কখন
তা সমাধান করে সওয়াবের অংশীধার হবো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৩২)
হজরত আবু মুসা আশআরি রা: বর্ণিত, নবীজী সা:-এর খেদমতে যখন কোনো অভাবী কোনো প্রয়োজনে এসে প্রয়োজন
হজরত আবু মুসা আশআরি রা: বর্ণিত, নবীজী সা:-এর খেদমতে যখন কোনো অভাবী কোনো প্রয়োজনে এসে প্রয়োজন
পূরণ করার আবেদন করত, তখন তাঁর মজলিসে যারা থাকতেন তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বলতেন, ‘তোমরা এই অভাবগ্রস্তের জন্য আমার কাছে সুপারিশ করো, ফের তোমরা সুপারিশ করার সওয়াব পাও।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ১৪৩২)
দোয়া করাও সুপারিশ : তাফসিরে মাজহারিতে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানের অভাব-অনটন দূর করার জন্য আল্লাহর
দোয়া করাও সুপারিশ : তাফসিরে মাজহারিতে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানের অভাব-অনটন দূর করার জন্য আল্লাহর
কাছে দোয়া করাও ভালো সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। এতে দোয়াকারীও সওয়াব পায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন কেউ মুসলমান ভাইয়ের জন্য নেক দোয়া করে, তখন ফেরেশতা বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমারও অভাব দূর করুন।’
সুপারিশ একটি পরামর্শ : রাসূল সা: বলেন, ‘যার পরামর্শ নেয়া হয়, সে একজন আমানতদার।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৮) আমানতদারি ও দিয়ানতদারি রক্ষা করে যা ভালো মনে হয়, তা পরামর্শ গ্রহীতাকে জানিয়ে দেয়া ফরজ।
সুপারিশ একটি পরামর্শ : রাসূল সা: বলেন, ‘যার পরামর্শ নেয়া হয়, সে একজন আমানতদার।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৮) আমানতদারি ও দিয়ানতদারি রক্ষা করে যা ভালো মনে হয়, তা পরামর্শ গ্রহীতাকে জানিয়ে দেয়া ফরজ।
এটা পরামর্শের হক।
সুপারিশ গ্রহণ করা জরুরি নয় :
রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা আমার কাছে সুপারিশকরো। এটি জরুরি নয় যে, তোমাদের সুপারিশ আমাকে শুনতেই হবে;
বরং ফয়সালা তো আল্লাহ তায়ালার মর্জি মোতাবেকই করব।’
সুপারিশ হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে, ন্যায় কাজে : নবীজী সা: বলেন, ‘মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে এ
সুপারিশ হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে, ন্যায় কাজে : নবীজী সা: বলেন, ‘মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে এ
ব্যাপারে আমি কারো সুপারিশ গ্রহণ করব না এবং তার হাত কেটে দেবো।’ (সহিহ বোখারি)
সুপারিশ না মানলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা যাবে না: উদার মনমানসিকতা নিয়ে সুপারিশ করতে হবে। সুপারিশ যদি গৃহীত না
সুপারিশ না মানলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা যাবে না: উদার মনমানসিকতা নিয়ে সুপারিশ করতে হবে। সুপারিশ যদি গৃহীত না
হয় তা হলে এ নিয়ে তার রুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
নবী সা: কতটা উদার মন নিয়ে সুপারিশ করতেন:
তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। দুই সাহাবি হজরত মুগীছ রা: ও হজরত বারীরা রা:। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। বিয়ের
সময় হজরত বারীরা রা: ছিলেন আরেকজনের দাসী। হজরত বারীরা রা:-এর মনিব হয়তো তার অমতেই তাকে বিয়ে
দিয়েছিলেন হজরত মুগীছ রা:-এর কাছে। বারীরা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু তার স্বামী মুগীছ রা:-এর গঠন-আকৃতি
সুন্দর ছিল না। এর পরের কথা। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: এই দাসীকে কিনে স্বাধীন করে দিলেন। হজরত বারীরা
যখন স্বাধীন হয়ে গেলেন, তখন ইসলামী শরিয়তের বিধানানুসারে তার বিয়েটি টিকিয়ে রাখার কিংবা ভেঙে দেয়ার এখতিয়ার লাভ করলেন। এই এখতিয়ারের ভিত্তিতে তিনি তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দেন। হজরত মুগীরা রা: অনুনয়-কান্নাকাটি করেও বারীরার মন গলাতে পারেননি। অবশেষে রাসূল সা:-কে বললেন, আপনি আমার জন্য সুপারিশ করুন। রাসূল সা: হজরত বারীরাকে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে সুপারিশকরলেন তুমি যদি তাকে আবার গ্রহণ করে নিতে! সে যে তোমার সন্তানের বাবা! সদ্য মুক্তি পাওয়া এই নারী রাসূল সা:-কে প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলেন তাতেই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমাকে এর আদেশ করছেন? (আপনার আদেশ যদি হয় তা হলে আমার জন্য
তা শিরোধার্য। আমার মতের সাথে তা মিলুক আর না মিলুক, আমি আপনার আদেশই মেনে নেবো। কিন্তু যদি আদেশ না
হয় তাহলে ভিন্ন কথা) রাসূল সা: বললেন, আমি কেবলই একজন সুপারিশকারী। (অর্থাৎ এটা তোমার প্রতি আমার আদেশ
নয়, পরামর্শ ও অনুরোধ) তখন বারীরা রা: বললেন, তাই যদি হয়, তাহলে তার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ
তাকে আবার গ্রহণ করে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২২৩৩) এখানে রাসূল সা: তাকে
বিষয়টি চাপিয়ে দেননি। তবে এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি অসন্তষ্টও হননি, এটি বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
তিনি একবার গিয়েছিলেন হযরত বারীরা রা.-এর ঘরে।
গিয়ে দেখলেন- ডেগচিতে মাংস রান্না করা হচ্ছে। এরপর হযরত বারীরা রা. নবীজী সা. কে রুটি এবং ঘরে থাকা অন্য
একটি তরকারি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। নবীজী সা. বললেন : কী ব্যাপার! ডেগচিতে দেখলাম মাংস রান্না করা হচ্ছে!
(অথচ তুমি আমাকে মাংস না দিয়ে এসব দিয়ে মেহমানদারি করছ!) তিনি জানালেন, এটা সদকার মাংস আর আপনি
তো সদকার কোনো খাবার গ্রহণ করেন না। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, এটা তোমার জন্যে সদকা, কিন্তু (তুমি যখন
আমাদেরকে খাওয়াবে তখন) আমাদের জন্যে তা হাদিয়া! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৭৯
এমন উদার মন নিয়ে সুপারিশকরাই আমাদের জন্যে রাসূল স. এর শিক্ষা। উপযুক্ত স্থানে, সামর্থ্য থাকলে সুপারিশ
করতে হবে। কিন্তু এমনটা ভাবা যাবে না-আমার সুপারিশগ্রহণ না করা আমাকে অপমান করার নামান্তর।
অবশ্য সুপারিশ গ্রহণ করতে যদি কোনো সংকট না থাকে, তাহলে যথাসম্ভব সুপারিশকারীর কথা গ্রহণ করা উচিত।
কারণ সুপারিশ সাধারণত কোনো সম্পর্কের ভিত্তিতেই করা হয়। এই সম্পর্কের কারণে সুপারিশকারী আশায় থাকে
আমার সুপারিশ হয়তো সে গ্রহণ করবে। রাসূল সা. বলেছেন- মানুষদেরকে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দাও।
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৪৪। তাই একই বিষয়ের সুপারিশ যদি আগে-পরে দুই সময়ে দুইজন করে, আর প্রথম সুপারিশকারীর তুলনায় দ্বিতীয় সুপারিশকারীর সঙ্গে সম্পর্ক অধিক ঘনিষ্ঠ হয়, কিংবা দ্বিতীয়জন অধিক সম্মানিত-সম্ভ্রান্ত
কেউ হন, তাহলে প্রথমজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার পরও দ্বিতীয়জনের সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে। সবার সঙ্গে
একই আচরণ করতে হবে, একজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার কারণে সবারটাই অগ্রাহ্য করতে হবে-এটা জরুরি নয়।
সুপারিশ একটি পরামর্শ ও আমানত:
সুপারিশ যখন করা হবে, তখন যার কাছে সুপারিশকরা হচ্ছে তার বিষয়টিও যত্নের সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে। সুপারিশ
একটি পরামর্শ আর পরামর্শ প্রদান একটি আমানত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় সে তো আমানতদার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮২৩
আর আমানতদারির দাবি হচ্ছে, তার কাছে সুচিন্তিতভাবে যেটা ভালো মনে হবে সে সেভাবেই পরামর্শ দেবে। পরামর্শ
দেয়ার সময় কল্যাণকামিতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য। কল্যাণকামী মানসিকতা ছাড়া সঠিক পরামর্শ দেয়া
সম্ভব নয়। তাই কোনো অসহায় বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যেও যদি কারও কাছে সুপারিশ করতে হয়, সেখানেও লক্ষ
রাখতে হবে-এ সুপারিশরক্ষা করতে গিয়ে সে আবার বিপদে পড়ে কি না; তার কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করতে হয় কি না;
তার নীতি ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে কি না; তাকে পরবর্তীতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে কি না; তার সম্মান-মর্যাদা ও চারিত্রিক শুদ্ধতা আক্রান্ত হয় কি না; আমার সুপারিশের মর্যাদা দিতে গিয়ে তাকে অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে হয় কি না; তার ধনসম্পদ কিংবা দ্বীন-ধর্ম এতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় কি না। তাই চাকরি বা এজাতীয় কোনো সুপারিশের ক্ষেত্রে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে-যার জন্যে সুপারিশকরা হচ্ছে সে এ পদের উপযুক্ত কি না; এ পদে সে নিযুক্ত
হলে মালিকের কিংবা জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না। কারও জন্যে আর্থিক সহযোগিতার
সুপারিশকরতে হলেও যথাসম্ভব জেনে নিতে হবে-বাস্তবেই সে অভাবগ্রস্ত কি না; এমন সহযোগিতা পাওয়ার সে উপযুক্ত
কি না। এসব দিক যদি রক্ষিত হয় তাহলে সুপারিশের মাধ্যমে উপকৃত হবে তিন পক্ষই-যার জন্যে সুপারিশকরা হয়েছে তার
প্রয়োজন পূরণ হবে, সংকট কেটে যাবে; যার কাছে সুপারিশকরা হল একটি ভালো কাজে কিংবা কোনো অভাবগ্রস্তকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে তিনিও একটি পুণ্যের কাজ করার সুযোগ পেলেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারলেন; আর যিনি সুপারিশকরেছেন তিনি পাবেন সুপারিশের বিনিময়ে পরকালের মহাপুরস্কার, এমনকি হাদীসের ভাষ্য মোতাবেক
এর ফল তিনি দুনিয়াতেও ভোগ করবেন।
ব্যক্তির অতীত ও বর্তমানকে সামনে রেখে সুপারিশ করা:
এর বিপরীতে যদি সুপারিশ করার সময় এসব বিষয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা না হয় তাহলেও এর ফল ভোগ করতে হবে
তিন পক্ষকেই-যার পক্ষে সুপারিশকরা হয়েছে আর যার কাছে সুপারিশ করা হয়েছে হয়তো তাদের দুজনের একজন অন্যায়কারী আরেকজন অন্যায়ে সহযোগিতাকারী হবে কিংবা তাদের একজন হবে জালেম আরেকজন হবে মজলুম।
আর সুপারিশকারী সর্বাবস্থায় হবেন অন্যায়ের পথ উন্মোচনকারী।
যোগ্য ব্যক্তির জন্যে সুপারিশকরার পরও যে সে অন্যায় করবে না, কারও কোনো ক্ষতি করবে না, ধোঁকা-প্রতারণার
আশ্রয় নেবে না-এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আর এটা ভবিষ্যতের বিষয়, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে
সুপারিশ করার সময় ব্যক্তির অতীত ও বর্তমানকে সামনে রেখেই করতে হবে। না হলে এর দায়ভার তো বহন করতে হবেই।
সুপারিশের মহান ফযিলত লাভ করতে হলে এসব মূলনীতি সামনে রেখেই সুপারিশকরতে হবে। অন্যথায় ধর্মীয় ও
সামাজিক-উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমাদের আপদ হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে তাই সচেতনতা ও
সতর্কতার বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বৈধ কাজে সুপারিশ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।