আধুনিক অর্থব্যবস্থার একটি হচ্ছে সুদ ব্যবস্থা। ইহা মানুষকে তিলে তিলে
ধ্বংস করে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন বহুলাংশে সুদনির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ সুদের
পার্থিব ও পরকালীন পরিণাম ভয়াবহ। সুদের কারণে ধনী দিন দিন আরও ধনী হয়,
গরিব ক্রমে হতদরিদ্র হতে থাকে। এতে ধনী-গরিবের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি হয়।
পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। সমাজে চলে আসে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক অসমতা।
এনজিও সংস্থাগুলো সেবার নামে গরীবদের ঋণ দিয়ে জোঁকের মত গরীবদের থেকে
চুষে নেয় সুদের টাকা। যথাযথভাবে সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গরীবের ভিটে মাটিও
এনজিও সংস্থার কাছে সুদের বিনিময়ে দিতে হয়। এই এনজিওরা মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কাজ করছে এবং সুদ ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরা সুদ ব্যবস্থার
প্রসার ঘটিয়ে মানুষকে বেকার, কর্মহীন, অর্থহীন ও ধর্মহীন করছে। বর্তমান বিশ্বের
দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার অন্যতমও কারণ হচ্ছে এই অভিশপ্ত সুদ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাই বর্তমানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি করছে। সুদ হচ্ছে প্রকৃতিবিরোধী আর ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা হচ্ছে প্রকৃতিগত ব্যবস্থা। যাকাতের অর্থ উপর থেকে নিচে আসে আর
সুদের অর্থ নিচ থেকে উপরে উঠে। এজন্যই বলা হয়-সুদ প্রকৃতিবিরোধী। কারণ প্রত্যেক জিনিসই উপর থেকে নিচের দিকে আসে। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনকিছুই নিচু থেকে উপরে উঠা স্বাভাবিক নয় : তা হচ্ছে একটা দুর্লক্ষণ। যেমন-পানি যখন আকাশ
থেকে নিচে নাজিল হয়, তখন তা হয় প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণকর। এমনকি বন্য
পশু, জীব-জানোয়ার, গাছপালা ইত্যাদি সবকিছুর জন্যই এটা হয় একটা রহমত স্বরূপ।
কিন্তু যখন প্লাবন হয়ে নিচের পানি উপরের দিকে উঠে, তাহলে তা হয় সবকিছুর
জন্যই বিপদের কারণ অর্থাৎ গাছপালা, জীব-জানোয়ার ইত্যাদি গৃহপালিত পশু এবং মানবক‚ল-প্রত্যেকের জন্যই একটা মহাবিপদের কারণ।
যে ঋণ করজদাতার জন্য কোনো ধরনের মুনাফা বয়ে আনে সেটাই রিবা বা সুদ। ইসলামে
সব ধরনের সুদই হারাম। ইন্টারেস্ট, মুনাফা, লাভ, ফিন্যানশিয়াল চার্জ অথবা সুদ- যে
নামেই তাকে ডাকা হোক- চাই তা মহাজনি সুদ হোক বা বাণিজ্যিক সুদ, চাই তা সরল
সুদ কম হোক বা বেশি হোক।
সুদ সমাজের এক চরম ব্যাধি:
ইসলামে সুদকে হারাম করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব,
যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো, যা গত হয়েছে
তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওয়ালায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী-জাহান্নামি। ’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
হাদিসে বর্ণিত হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) সুদ গ্রহীতা,
দাতা ও সুদি কারবারের লেখক এবং সুদি লেনদেনের সাক্ষী, সবার ওপর লানত করেছেন।
পবিত্র কোরআনে বহু ধরনের গুনাহর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
সেসবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে যত
কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহর ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় সেই ঘৃণ্য ব্যবস্থাটিই হচ্ছে সুদ ব্যবস্থা।
সুদ ব্যবস্থায় মানবতার কোন কল্যাণ নেই। সুদ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল
ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়। মানুষ যাতে অর্থনৈতিক মুক্তি পায় সেজন্য রাসূল (সা.) হাদীসে
সকল প্রকার সুদকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
আমাদের সমাজে অনেক লোক আছেন যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। আর ব্যাংক তাদেরকে ১০% বা ২০% হারে লাভ দিয়ে থাকে।
এরা ঘরে বসেই বিনাকষ্টে এই টাকা পেয়ে থাকেন। তারা মনে করেন-এটা ব্যবসা।
এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসলে এটা সুদ। এই সুদকে তারা খোড়া যুক্তি দিয়ে
ব্যবসা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। ব্যবসার নাম নিয়ে সুদের লেনদেন করছেন আমাদের সমাজের অনেকে। ব্যবসা তো হচ্ছে সেটা-যাতে টাকা বিনিয়োগ করা হয়, চিন্তা-ফিকির
ও পরিশ্রম করা হয়, লাভ-ক্ষতি উভয়টাকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেয়া হয়। চিন্তা-ফিকির নেই, পরিশ্রম নেই, কোন প্রকার ক্ষতিকে মেনে নেয়া হয় না-সেটাকে কোন বিবেকে
ব্যবসা বলা হয়? ব্যাংক থেকে ১০% বা ২০% লাভে বিনা পরিশ্রমে যা পাওয়া যায় তা
সরাসরি সুদ। এই সুদের পরিণাম অত্যন্ত করুণ। ইরশাদ হচ্ছে-‘তাদের অনেককেই
তুমি দেখবে পাপে, সীমালঙ্গনে ও অবৈধ ভক্ষণে (সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে) তৎপর : তারা যা
করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট” (সূরা মায়িদা : ৬২)।
সুদ সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের একটি :
দুনিয়াতে যে সাতটি ধ্বংসাত্মক মহাপাপ আছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো সুদ। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকো।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক
কাজ কী? তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা; জাদু করা; অন্যায়ভাবে মানুষ
হত্যা করা, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন; সুদ খাওয়া; এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা; জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া; সতী মুমিন নারীদের অপবাদ দেওয়া। ’
(বুখারি, হাদিস : ২৭৬৬)
সুদ সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত :
সুদের সঙ্গে জড়িত সবাইকে নবীজি (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে,
‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ
বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৬)
সুদের অর্থে কোনো বরকত নেই :
সুদের মাধ্যমে যত অর্থই উপার্জন করুক, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাতে কোনো
বরকত নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত
করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। ’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৬) সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
‘যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো—যেন মানুষের সম্পদের সঙ্গে মিশে তা বেড়ে যায়,
আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না। ’
সুদখোর আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত :
সুদখোর স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা
মুমিন হও। যদি তোমরা না করো (সুদের বকেয়া না ছাড়ো, সুদের কারবার অব্যাহত রাখো) তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও । ’ (সুরা : বাকারা,
আয়াত : ২৭৮-২৭৯)
সুদখোর ব্যভিচারকারীর সমতুল্য :
ব্যভিচার সবার কাছে নিন্দনীয়। বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যভিচার আরো বেশি জঘন্য। আর স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত
হওয়া কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে তার মায়ের
সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে জড়িত। বর্ণিত আছে, ‘সুদ সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো—আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য। ’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৫৩৪৫)
‘সুদ থেকে অর্জিত এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ (প্রায় ৩০০ টাকা) ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৬ বার ব্যভিচার করা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২১৯৫৭)
চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধের কারণ :
সুরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা
চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। ’ এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করার কারণ হলো—কোরআন নাজিল হওয়ার সময় আরবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খাওয়ার প্রথা ছিল। তাই তা
দূর করার জন্য স্বতন্ত্রভাবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। তার মানে এ
নয় যে চক্রবৃদ্ধিহারে না হলে সুদ খাওয়া হালাল হয়ে যাবে। কারণ অন্যান্য আয়াতে তো যেকোনো রকমের সুদ খাওয়াকে হারাম করা হয়েছে।
ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত :
যেকোনো ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হালাল পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলরা, তোমরা পবিত্র বস্তু
থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো। ’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৫১)
হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হয় না।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোনো ধরনের ইবাদত আল্লাহর
নিকট গিয়ে পৌঁছে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৩০)
সুদখোরের বরজখি জীবনের শাস্তি :
সুদখোরকে মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বরজখি জীবনে আজাব দেওয়া হবে। তার আজাব হবে—তাকে এমন নদীতে সাঁতার কাটতে হবে, যার পানি হবে রক্তের মতো লাল এবং তাতে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হতে থাকবে। (বুখারি, হাদিস : ১৩৮৬)
সুদখোরের পেট সাপে পরিপূর্ণ :
রাসুল (সা.) বলেছেন, মেরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিল অসংখ্য সাপে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল, এরা কারা? তিনি জবাবে বলেন, এরা সুদখোরের দল। (মুসনাদে আহমাদ,
হাদিস : ৮৬৪০)
সুদখোর কিয়ামতের দিন যে অবস্থায় উঠবে :
কিয়ামতের দিন সুদখোর পাগলের মতো উঠবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে।
এটা এ জন্য যে তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই । ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
মহান আল্লাহ সবাইকে সুদ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।