পৃথিবীতে বৃষ্টি না হলে প্রখর রোদ্রের তাপ আর তীব্র গরমে মানুষ পশু-পাখি, জীব-জন্তু সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অনাবৃষ্টির
কারণে জমির ফসলও পুড়ে যায়। সে অনুকূল কঠিন পরিস্থিতিতে কী করবে মানুষ? শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবি
মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এ গরমের প্রচণ্ড তাপদাহ থেকে বাঁচতে ও বৃষ্টি প্রার্থনা করতে নামাজ আদায় করতে বলেছেন। আর
সে নামাজের নামই সালাতুল ইস্তিসকা বা নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট পানি প্রার্থনা করাকে ‘সালাতুল ইস্তিসকা’
বলা হয়। ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে সর্বপ্রথম মদীনায় ইস্তিসকার নামাজের প্রবর্তন হয়।
ইস্তিসকা এর অর্থ পানি প্রার্থনা করা। অনাবৃষ্টিতে খুব বেশি কষ্ট হলে সব মুসল্লিদের নিয়ে একত্রে খোলা মাঠে বৃষ্টির জন্য
প্রার্থনা করা হয়। আর এ প্রার্থনা করাকেই ইস্তিসকার নামাজ বলে। আলেমদের মতে, এ নামাজ মাঠে গিয়ে আদায় করার
আগে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণপূর্বক একাধারে তিন দিন রোজা রাখবে। তারপর সংশ্লিষ্ট ওই এলাকার ইমাম বা খতিব সাহেব মুসল্লিদের নিয়ে বসবেন, নসিহত করবেন, উপদেশ দেবেন। তিন দিনের রোজা শেষে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে মাঠে গিয়ে নামাজ
আদায় করবেন। মাঠে যাওয়ার আগে এবং পরে সবাই তওবা করবেন। তওবা করলে বৃষ্টি বর্ষণের খুবই সম্ভাবনা থাকে।
সালাতুল ইস্তিসকা সুন্নাত; কেননা নবী (সা.) ইস্তিসকার নামাজ আদায় করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ থেকে বর্ণিত এক
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজের মাঠের দিকে বের হয়ে গেলেন, অতঃপর আল্লাহর কাছে পানি তলব করলেন।
তিনি কিবলামুখী হলেন। তাঁর চাদর উল্টিয়ে পরলেন এবং দু রাকাত নামাজ আদায় করলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
সালাতুল ইস্তিসকা কিভাবে পড়তে হয়:
প্রথম পদ্ধতি: সালাতুল ইস্তিসকা আদায়ের জন্য খুশু-খুজু, বিনয়- নম্রতার সাথে গমন করা সুন্নত। সাথে সাথে একমাত্র
আল্লাহ তাআলাই যে বান্দার সকল হাজত-প্রয়োজন পূরণ করেন এ মনোভাবও অন্তরে জাগ্রত রাখা উচিত। ইবনে আব্বাস
(রা.) রাসূল (সা.) এর ইস্তিসকার নামাজের জন্য বের হওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সা.) অনাড়ম্বরভাবে,
বিনয়-নম্রতা ও আকুতিসহ বের হয়ে নামাজের মাঠে উপস্থিত হয়েছেন। (আবু দাউদ)
এক. ইস্তিসকার নামাজ দুই রাকাত। সূর্যোদয়ের পর বিশ মিনিটের মতো সময় অতিবাহিত হলে ইস্তিস্কার নামাজ পড়তে হয়, ঈদের নামাজের সময়ের মতোই। আযান ইকামতবিহীন প্রকাশ্য কিরাআতে উক্ত নামাজ আদায় করতে হয়।
তিন. প্রত্যেক তাকবীরের সময় হাত উঠাবে এবং তাকবীরগুলোর মাঝে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা এবং রাসূল (সা.) এর উপর দরূদ পড়বে।
চার. নামাজের পর ইমাম খুতবা দিবেন। খুতবায় বেশী বেশী ইস্তেগফার ও কুরআন তিলাওয়াত করবেন। অতঃপর দু হাত
উঠিয়ে মিনতির সঙ্গে দুআ করবেন এবং হাদীসে বর্ণিত দুআগুলো বেশী পড়বেন।
পাঁচ. অতঃপর ইমাম ও মুক্তাদী সকলে ক্বিবলামুখী দাঁড়িয়ে স্ব স্ব চাদর উল্টাবে। অর্থাৎ চাদরের নীচের অংশ উপরের দিকে
উল্টে নিবেন এবং চাদরের ডান পাশ বাম কাঁধে ও বাম পাশ ডান কাঁধে রাখবে। অতঃপর দু’হাত উপুড় অবস্থায় সোজাভাবে চেহারা বরাবর উঁচু রাখবে, যেন বগল খুলে যায়। সাথে সাথে চুপে চুপে আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকবেন।
সালাতুল ইস্তিসকা আদায়ের দ্বিতীয় পদ্ধতি:
ইমাম সাহেব প্রথমে সংক্ষিপ্ত খুৎবা দিবেন। অতঃপর দু’রাক‘আত নামাজ আদায় করবেন অতঃপর দাঁড়িয়ে পূর্বে বর্ণিত
নিয়ম অনুযায়ী দো‘আ করতে থাকবেন।
তাৎপর্য: চাদর উল্টানোর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যেন খরা উল্টে গিয়ে বৃষ্টিপাত হয়। এছাড়াও রয়েছে রাজাধিরাজ আল্লাহর
সামনে বান্দার পরিবর্তিত অসহায় অবস্থার ইঙ্গিত। দাঁড়িয়ে দু’হাত উপুড় ও সোজাভাবে ধরে রাখার মধ্যে রয়েছে পালনকর্তা আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ ও একান্তভাবে আত্মনিবেদনের ইঙ্গিত। ময়দানে বেরিয়ে একত্রিত হয়ে বৃষ্টি প্রার্থনার মধ্যে রয়েছে একই বিষয়ে হাযারো বান্দার ঐকান্তিক প্রার্থনার গুরুত্ববহ ইঙ্গিত।
নামাজ ব্যতীত অন্যভাবে বৃষ্টি প্রার্থনা:
(ক) জুম‘আর খুৎবা দানের সময় খত্বীব দু’হাত উঠিয়ে আল্লাহর নিকটে বৃষ্টি প্রার্থনা করবেন। একই সাথে মুছল্লীগণ হাত উঠিয়ে দো‘আ করবেন অথবা ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন। জুম‘আ ও ইস্তিসক্বার ছালাত ছাড়াই স্রেফ দো‘আর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা।
অন্যান্য জ্ঞাতব্য :
(ক) জীবিত কোন মুত্তাক্বী পরহেযগার ব্যক্তির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর
পরে তাঁর চাচা আববাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে ওমর (রাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। কিন্তু কোন মৃত ব্যক্তির দোহাই বা অসীলা নিয়ে
বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবেনা। কারণ এটি হল সবচেয়ে বড় শিরক। (খ) ইস্তিস্কার খুৎবা সাধারণ খুৎবার মত নয়। এটির সবটুকুই
কেবল আকুতিভরা দো‘আ আর তাকবীর মাত্র। (গ) অতিবৃষ্টি হলে বলবে, আল্লা-হুম্মা ছাইয়েবান না-ফে‘আন (হে আল্লাহ! উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন)। আর তাতে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা দেখা দিলে তা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ
করে বলবে, আল্লা-হুম্মা হাওয়া-লায়না ওলা ‘আলাইনা (হে আল্লাহ! আমাদের থেকে ফিরিয়ে নাও। আমাদের উপর দিয়ো না)।
বৃষ্টিপাত হলে যা করা মুস্তাহাব
বৃষ্টিপাতের শুরুতে বৃষ্টিতে নামা ও ভেজা মুস্তাহাব; হাদীসে এসেছে, আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে থাকা
অবস্থায় আমাদেরকে বৃষ্টি পেয়ে বসল। তিনি বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.)তাঁর কাপড় গুটালেন। তিনি বৃষ্টিতে ভিজলেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এমন করলেন কেন? তিনি বললেন, কেননা এ বৃষ্টি তার রবের পক্ষ থেকে নতুন এসেছে। (মুসলিম)
বৃষ্টি একমাত্র আল্লাহ তাআলার দয়া ও করুণা, একজন মুসলমানের বিশ্বাস করা উচিত যে, আল্লাহ তাআলার দয়া ও করুণার ফলেই বৃষ্টি বর্ষিত হয়। যারা বলে যে অমুক গ্রহের কারণে বৃষ্টি হয়েছে তাদের কথা ভুল, এটা বরং শিরক।