বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রকট সমস্যারূপে চিহ্নিত। সাম্প্রদায়িকতার
অশুভ গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া যে-কোনাে বিবেকবান
মানুষের উচিত। সুস্থ জীবনবােধে উদ্দীপ্ত হতে হলে অসাম্প্রদায়িক বােধের কোনাে
বিকল্প নেই। কোনাে বিদ্বেষ বা হিংস্র মনােভাব কখনাে মানবজাতির জন্য কল্যাণকর
হতে পারে না। তাই অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের চর্চা করে যথার্থ মানবিক বােধের বিকাশ ঘটানাে দরকার। বদ্ধ ধারণার বৃত্ত ভেঙে, উদার মানবতার চর্চা করতে হলে অসাম্প্রদায়িক ভাবনার অধিকারী হওয়া একান্ত আবশ্যক।
সাম্প্রদায়িকতা কী ?
‘সম্প্রদায়’ শব্দ থেকে সাম্প্রদায়িক শব্দটির সৃষ্টি। সম্প্রদায় শব্দের আভিধানিক অর্থ
দল বা গােষ্ঠী, সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা শব্দের যথার্থ অর্থ হলাে দলীয় বা গােষ্ঠীগত মত বা মনােভাব। যেমন ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা মুসলিম সম্প্রদায়, হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা
হিন্দু সম্প্রদায়, খৃষ্টধর্মের অনুসারীরা খৃষ্টান সম্প্রদায়, এভাবে প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা একেকটি সম্প্রদায়, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি ইদানীং উগ্র ধর্মবিশ্বাসীদের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের অর্থ বহন করে। ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর স্বার্থে
কেউ যখন ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয় তখনই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পথ হারায়
সুস্থ ও সুন্দর জীবনবােধ। একদল মানুষ যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে বা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন সাম্প্রদায়িকতার অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাব ঘটে। অনুদার জাত্যভিমান, সংকীর্ণ গােষ্ঠীচেতনা জন্ম দেয় ধৈর্যহীনতা ও অসহিষ্ণুতার। ফলে ধ্বংসের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে মানুষ। তখন তাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লুপ্ত
হয়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।
সাম্প্রদায়িক তার কুফল:
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “ধর্মের ব্যাপারে কোনাে জবরদস্তি নেই।”
পৃথিবীর কোনাে ধর্মে বা ধর্ম গ্রন্থে অন্যের উপর নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব চাপিয়ে দেওয়ার বিধান নেই। তারপরও একদল স্বার্থান্ধ উগ্র মানুষ বিভিন্ন স্লোগান তুলে অন্যের উপর
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চায়। কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের প্রভুত্ব কায়েমের
চেষ্টা সাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিক অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় হিটলারের দ্বারা ইহুদি নিধনযজ্ঞ সাম্প্রদায়িকতারই অন্য নাম। ভারতীয়
উপমহাদেশ যখন ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, ধর্মের জিকির তুলে দ্বিখণ্ডিত
হয় তখনও ভারতে মুসলমান এবং পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় বীভৎস অত্যাচারের কবলে পড়েছে। নিরীহ নরনারীর রক্তের হােলিখেলায় মেতে উঠেছে ধর্মান্ধ মানুষ, শিশুর মগজ ছিটকে বেরিয়ে গেছে, নারীর সম্ভম ধুলােয় লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রতিকারহীন চিৎকারে ভেসে গেছে আকাশ বাতাস। মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিরােধ, আহমদী
সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ ওই সাম্প্রদায়িকতারই কুফল মাত্র।
ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির থিওরি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি:
ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শুধু থিওরি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্র্যক্টিকালি রূপদান করেছে ইসলাম। মদিনায় হিজরতের
পর রাসুলুল্লাহ সাঃ মদিনাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ
করেন। তখন মদিনা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি, মুসলিম—এই তিন সম্প্রদায়ের লোকের
একটি আবাসভূমি। রাসুলুল্লাহ সাঃ লক্ষ করলেন, এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপিত না হলে মদিনার শান্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাইবিশ্ব শান্তির দূত মুহাম্মদ সাঃ মদিনাবাসীকে একটি লিখিত শান্তিসনদ দান করেন।সনদে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নেতারা স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সনদকে বলা হয়মদিনা সনদ। মদিনা সনদই দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হলো মদিনা সনদ —
(১) মদিনার মুসলিম, পৌত্তলিক, ইহুদি—সবাই একই রাষ্ট্রের অধিবাসী। সবার নাগরিক অধিকার সমান।
(২) মুসলিম, পৌত্তলিক, ইহুদি—প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে
ধর্ম পালনে বাধা দিতে পারবে না।
(৩) সনদে স্বাক্ষরদানকারী কোনো সম্প্রদায়কে বাইরের শত্রু আক্রমণ করলে সবসম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করবে।
(৪) বহিঃশত্রু মদিনা আক্রমণ করলে সব সম্প্রদায়ের সমবেত শক্তি দ্বারা বহিঃশত্রুকে
বাধা দিতে হবে।
(৫) কোনো সম্প্রদায়ই বাইরের কোনো শত্রুর সঙ্গে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না।
(৬) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পূর্ব অনুমতি ছাড়া কেউ কারো
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
(৭) ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য ব্যক্তিকেই দায়ী করা হবে। তাঁর সম্প্রদায়কে দায়ী
করাচলবে না।
(৮) সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাসুল সাঃ-
এর মীমাংসার ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হবে। (ইসলামের ইতিহাস : হাসান আলী
চৌধুরী, পৃ. ৭৪-৭৫)
মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম ধর্মে ধর্মে বিরোধ চায় না, শান্তি চায়। ইসলাম বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শত্রুতা চায় না, মৈত্রী চায়। ইসলাম কট্টরতা চায় না, উদারতা চায়। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার সমান। রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামই দুনিয়ার বুকেসর্বপ্রথম বাস্তব
আদর্শ স্থাপন করে, মদিনা সনদই তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত ছিল ১৯৪৬-এর দাঙ্গার ভয়াল ও কুৎসিত রূপ। তদুপরি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধর্মের জিকির তুলে এদেশের মানুষকে কীভাবে শােষণ করেছে তার নজিরও সামনে ছিল। তাই নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল তার চারটি মূলনীতির অন্যতম একটি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে
দেওয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা হলে বাংলাদেশেও
তার প্রতিশােধকল্পে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি। তারা মিলেমিশে বসবাস করতে চায়, নিজের নিজের ধর্মের প্রতি তাদের বিশ্বাস গভীর অটল। সেই বিশ্বাসকে তারা অন্যের উপর
চালাতে চায় না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল কখনাে কখনাে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
সেই বিভ্রান্তি সাময়িক, কিন্তু তার প্রভাব অবশ্যই ক্ষতিকর।
অসাম্প্রদায়িকতা ও আজকের বিশ্ব:
বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ আজ সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে
আজ কোটিকণ্ঠের আহ্বান। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা অর্থাৎ যেসব এলাকায়
অনুন্নত জনগােষ্ঠীর বসবাস বিশেষত সুশিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষার সুযোগ তারা পায় না। সেখানে দেখা দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষের জন্য প্রথমে চাই যথার্থ শিক্ষা। শিক্ষার আলােয় দূরীভূত হতে পারে ধর্মান্ধতার নিকষকালাে অন্ধকার। আজকে বিশ্ববাসী বুঝেছে যে, ধর্মবিশ্বাস আর ধর্মান্ধতা এক নয়। একজন
যথার্থ ধার্মিক কখনও অন্যের উপর পীড়ন চালাতে পারে না। কোনাে ধর্মেই অন্যকে
ছােট করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তাই আজকের পৃথিবীতে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হচ্ছে নতুন করে, নতুন উদ্যমে। গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী, উদার জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অসাম্প্রদায়িকতার কোনাে বিকল্প নেই।
উপসংহার
অসাম্প্রদায়িকতা এখন একটি সার্বজনীন ধারণা। সাম্প্রদায়িকতার কুফল বিশ্ববাসী দেখেছে, উপলব্ধি করেছে তার নির্মম নৃশংসতা। নতুন বিশ্ব গড়তে চাইলে, মানুষের বাসযােগ্য পৃথিবী দেখতে চাইলে আমাদের আজ অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। ধর্মীয়
বিশ্বাসকে জালাঞ্জলি দিয়ে নয়, বরং ধর্মের অন্তর্নিহিত শিক্ষাকে ধারণ করে সকলকে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। কেবল তাহলেই অসাম্প্রদায়িতার সুফল গড়ে
তােলা যাবে, কেটে যাবে সংঘাত ও সংঘর্ষের এই ভায়বহ ধারাবাহিক অন্ধকার।