সম্প্রীতি বজায় রাখতে মহানবীর আদর্শ।

ইসলাম একমাত্র মনোনীত দীন ও জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের আদর্শ শাশ্বত ও
সার্বজনীন। মুসলমান আর অমুসলমানের মধ্যে এখানে কোনো বিভাজন নেই।
পরম সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা ও নির্দেশনা
কালজয়ী আদর্শ হিসেবে বিশ্ব সভ্যতায় একটি স্বীকৃত বিষয়। ইসলামে অপরের কল্যাণ সাধন উপযোগিতা একটি জাতি ও আদর্শের টিকে থাকার মূলমন্ত্র। অস্তিত্বের এই শাশ্বত দর্শনের উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘আর যা মানুষের জন্য কল্যাণকর
যা মানুষকে উপকৃত করে তা টিকে থাকে পৃথিবীতে। (সূরা রাদ : ১৩:১৭)
‘হে মানবজাতি! আমি নর ও নারী থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর আমি বিভিন্ন গোষ্ঠী
ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার’।
(সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষ হিসাবে আমরা সবাই এক জাতি। আদম ও হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্ট মানবমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে সবাই আল্লাহ তায়ালার কাছে সমমর্যাদার
অধিকারী।চামড়ার রং, ধনসম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদি দ্বারা
মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা
একে অপরের উপকার হতে পারে।

মহানবি (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে তাকওয়া তথা আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।
আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর এ মহান বাণীতে ইসলামের অনন্য আদর্শ বিশেষত জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে
একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার নির্দেশনা উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। খোদার পৃথিবীতে বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।

পারস্পরিক সহযোগিতার নামই হলো সম্প্রীতি:

এসব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার নামই
হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা
ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটায়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে
আরোহণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে
পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা
ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, গৃহযুদ্ধেও রূপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহকাল-পরকালের সব নেকির কাজও ধ্বংস হয়ে
যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এটি এমন এক সার্বজনীন
ও শান্তিময় জীবনব্যবস্থা, যেখানে শুধু মানব সম্প্রদায়ই নয় বরং পশুপাখি ও প্রকৃতির অধিকারও সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধর্মে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো
স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইসলাম কায়েম
করতে চায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎপথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ (সূরা আল বাকারার ২৫৬)
ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকত, তাহলে হযরত রাসূল  (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য
বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সঙ্গেও বন্ধুসুলভ
আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই উৎস থেকে, তাহলে কেন
একে অপরের সঙ্গে বিরোধ? কুরআন-হাদিস ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথের
বাইরে যা কিছুই করা হবে তা ইসলাম নয়। আজকের সমাজে অতি উৎসাহী কিছু
মানুষ ধর্মের নামে বল প্রয়োগ, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি জুলুম-অত্যাচর করতে
চান-যা মোটেও ইসলাম সমর্থন করে না।

ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।

 

ধর্ম পালনে কেউ বাধাগ্রস্ত হবে না। তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কোনো মুসলমানের জন্য সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক)
ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (সূরা আনয়াম : ১০৮) অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো
চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি) অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সামর্থ্যবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা
জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো (আবু দাউদ)।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার উধাহরণ:

একটা গল্প বলছি। কোনো কাল্পনিক গল্প নয়। গল্পটা পড়েই বুঝতে পারবেন ইসলাম
কতটা উদার। মুসলিম সেনাপতি হযরত আমর ইবনে আ’স (রা.)-এর সময়ের কথা।
একদিন সকালবেলা আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান পল্লীতে হইচই পড়ে গেল। দেখা গেল
সবাই বাজারে জটলা হয়ে আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে। সেখান থেকে
খ্রিস্টানদের স্থানীয় আর্চ ‘বিশপ’ বাজারের ঘটনা অবগত করার জন্য আমর ইবনে
আ’স (রা.)-এর বাসভবনে গেলেন। তার সাথে আরও অনেকেই গেলেন। সেখানে গিয়ে বিশপ জানালেন, গত রাতে কেউ একজন বাজারের যিশু খ্রিস্টের মূর্তির নাক ভেঙে দিয়েছে। এ মূর্তিটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ধরে নিয়েছি যে
মুসলমানরাই ম্প্রদায়িক  সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য এই কাজ করেছে ।
আমর ইবেন আ’স এ কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি বললেন, “আমি খুবই
লজ্জিত ও ব্যথিত। সত্যি কথা বলতে, ইসলামে মূর্তিপূজা জায়েজ না ঠিক, কিন্তু অন্য
ধর্মের উপাস্যকে গালি দেয়াও যে ইসলাম হারাম করেছে। অনুগ্রহ করে আপনি মূর্তিটা পুনর্নির্মাণ করে নিন। এতে যত খরচ হয় আমি তা দিয়ে দেব।” বিশপ বললেন, “এ মূর্তি রিপেয়ার করা যাবে না।” আ’স বললেন, “তবে নতুন করে বানান। আমি খরচ দেব।” “না, সেটাও হবে না। আপনি জানেন, যীশু ঈশ্বরপুত্র। তার মূর্তির এমন অবমাননা সহ্য করা
যায় না। একটাই ক্ষতিপূরণ, আমরা আপনাদের মুহাম্মাদ (সা.)- এর মূর্তি বানিয়ে সেটার
নাক ভাঙ্গব।” রাগে জ্বলে গেল আ’স (রা.)-এর গা। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বিশপকে বললেন, “আপনি যা বললেন সেটা সম্ভব না।আমরা  আমাদের সম্পদ, পরিবারের চেয়েও
মুহাম্মাদ (সা.)কে বেশি ভালবাসি। আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো
প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”

সম্প্রীতি বজায় রাখতে মুসলিম সৈন্যের স্বীকারুক্তি:

খ্রিস্টান নেতারা সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা.) সবার সামনে হাজির
হয়ে বিশপকে বললেন, “এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ
আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই এই তরবারি গ্রহণ
করুন এবং আপনিই আমার নাক কেটে দিন।” এ কথা বলেই বিশপকে একখানি
ধারালো তরবারি হাতে দিলেন, বিশপ সেটা পরীক্ষা করলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিস্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। হঠাৎ সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো।
চিৎকার করে বলল, “আমিই দোষী, সেনাপতির কোনো অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির
নাক ভেঙেছি। এই দেখুন আমার হাতে এখনো সেই নাকটি রয়েছে। সবার দৃষ্টি মূর্তির
ভাঙ্গা নাকের দিকে। নাক হাতে সৈন্যটি বললেন, মূর্তি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমার
ছিল না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখি ছিল। আমি ভাবলাম যদি এই পাখিটা মলত্যাগ
করে মূর্তিটাকে অসুন্দর করে দয়। তাই পাখিটার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নিচে নাক পেতে দিল।
নির্বাক সবাই। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুড়ে বিশপ বললেন,
“ধন্য সেনাপতি, ধন্য হে বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা.), যার মহান
আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে।
সুতরাং এ ঘটনা থেকেই অনুমেয় যে, ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এবং অন্য
ধর্ম, ধর্মের উপাস্য ও ধর্মের অনুসারীদের ওপর কতটা উদার।