সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি কি জায়েয?

সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। আর সভ্যতা হলো সেই জাতির দেহ স্বরূপ। প্রাণহীন দেহসত্তার যেমন কোনো মূল্য নেই, দেহহীন আত্নাও তেমনি মূল্যহীন। তাই বলা যায়, সংস্কৃতি ও
সভ্যতা অনেকাংশে পরষ্পরের পরিপূরক। সংস্কৃতি সাধারণত তাহজিব, তমদ্দুন বা
ইংরেজি কালচারের প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়। এ সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা। এ হচ্ছে একটি ব্যাপক জীবনব্যবস্থা যা মানুষের
চিন্তা-কল্পনা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, পারিবারিক কাজকর্ম, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, রাজনৈতিক কর্মধারা, সভ্যতা ও সামাজিকতা সবকিছুর ওপরই পরিব্যাপ্ত। এক কথায় সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বিশ্লেষণের। “ইংরেজিতে
যাকে বলা হয় (Culture/Refinement), আরবিতে যাকে তাহজিব বলা হয়, সংস্কৃতি শব্দটা সেই অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে।”  “Culture শব্দের ধাতুগত অর্থ কর্ষণ অর্থাৎ সোজা কথায় চাষ করা। জমি রীতিমতো কর্ষিত না হলে যত ভালো বীজই বপন করা হোক না
কেন তাতে ভালো ফসল কিছুতেই আশা করা যায় না। মন জিনিসটাও প্রায় জমির মতই। মনের ফসল পেতে হলে তার রীতিমত কর্ষণের প্রয়োজন।” এক কথায় মনুষ্যত্বের উপর
যে সংস্কৃতির ভিত্তি, একমাত্র সে সংস্কৃতিই মানবজীবনে বিকিরণ করতে পারে আলো। যে আলোর নেই কোনো দেশ, কোনো কাল ও জাত। তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, মানুষের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে চরিত্র আর চরিত্রের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক স্বভাবের বিপরীত কোন কিছু করাকে অপসংস্কৃতি বলে। দুঃখের বিষয় অপসংস্কৃতি গুলোকে আমরা সাংস্কৃতির নামে চালিয়ে দিচ্ছি।

সংস্কৃতি সম্পর্কে ভূল ধারনা:

আমরা সাধারণ গান, সিনেমা, নাটক, বাদ্যযন্ত্র, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়কে সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করে থাকি। আসলে এইগুলো ঠিক সংস্কৃতি নয়; বরং অপসংস্কৃতির বাহন মাত্র। সংস্কৃতি বিকাশের জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয় উপকরণ বা বাহন হিসাবে। তাই আমরা ভুলবশত তা অজ্ঞতার কারণে এ উপকরণ বা বাহনকে সংস্কৃতি বলে থাকি। সংস্কৃতিকে শুধু রীতিনীতি কিংবা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। মানব মনের অন্তর্নিহিত শক্তি, কৌতূহল ও প্রতিভা স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ লাভ করে সংস্কৃতির মাধ্যমে। এ জন্যই সংস্কৃতির মাধ্যমে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে। খণ্ড খণ্ড কিংবা আংশিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কখনও মানুষকে তার মনুষ্যত্ব বিকাশের সহায়তা করতে পারে না।

অপসংস্কৃতি কি:

অপসংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বভাবের বিপরীত অথবা সাংস্কৃতিক
আদর্শের বিরুদ্ধে যা মানুষের সুস্থ ও সুপ্ত প্রতিভাকে বিকৃতি ও বিধবস্ত করে তাই
হচ্ছে অপসংস্কৃতি। বর্তমান সমাজে অপসংস্কৃতি বলে থাকে চিহ্নিত করতে পারি
তা নিম্নবরূপ:
১. বিদেশি প্রাচুর্য থেকে সৃষ্ট এক ধরনের অশ্লীল নৃত্যগীত, নাটক ও সিনেমা ইত্যাদি।
২. বিদেশি মিডিয়ার কু-প্রভাব।
৩. ডিশ এন্টিনার বদৌলতে প্রাইম, স্টার টিভি, জিটিভি, এমটিভি আগ্রাসন।
৪. যৌন উত্তেজনামূলক সাহিত্য, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, কমিক বই ইত্যাদির মাধ্যমে
চরিত্র হরণ করা।
৫. ছায়াছবির মাধ্যমে ভায়োলেন্সের চিত্র প্রদর্শন।
৬. বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ক্লাবের নামে মাদকের ছড়াছড়ি।
৭. পুরুষ ও মহিলাদের বিকৃত রুচির পোশাক পরিধান।
৮. অতি আধুনিকতার নামে বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও অনুশীলন।
১০. বিকৃত রুচি ও যৌন সুড়সুড়িমূলক বিজ্ঞাপন, পোস্টার, ফেস্টুন আলোকচিত্র
ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন।
১১. ধর্মের নামে মাজার পূজা, কবর পূজা, শিরক ও বিদাতের ব্যাপক সয়লাব।
সুতরাং অপসংস্কৃতি চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে একটি জাতি বা দেশের ঐতিহ্যকে বিবেচনার আয়ত্তে আনতেই হবে।

অপসংস্কৃতি সম্পর্কে একটি ফতোয়া:

প্রধান মুফতী সাহেব দাঃ বাঃ, মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা
বিষয় : অপসংস্কৃতি
প্রশ্ন : ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শরীয়তসম্মত কিনা, তথাকথিত শিল্পীগোষ্ঠীসমূহের মাধ্যমে ইসলামী সংগীতের হুকুম কি,সংগীত শোনা জায়েয আছে কিনা এবং ইহা
ভিডিও আকারে প্রচার করা যাবে কিনা?
উত্তর : একথা অনস্বীকার্য যে, ইসলামে বিনোদন নিষেধ নয়, তাই বলে কোনো
অনৈসলামিক কাজকে ইসলামের লেবেল লাগিয়ে ইসলামী বিনোদন বলে চালিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান ইসলামী সাংস্কৃতি ও সংগীত অনুষ্ঠান নাম দিয়ে যে অনুষ্ঠান করা হয়, কুরআন-সুন্নাহর বিজ্ঞ আলেমগণ তা নাজায়েয হওয়ার ফতোয়াই দিয়ে থাকেন এবং এধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করার অনুমতি দেন না৷ কেননা এসব অনুষ্ঠানে
শরীয়ত পরিপন্থী অনেক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে৷ যেমন —
১. প্রচলিত ইসলামী সংগীতগুলো সুর, কণ্ঠ, আওয়াজের তরঙ্গ, ইকো, সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং ও ধোয়া নির্গমন ইত্যাদি সব বিষয় আধুনিক গানের সাথে সামাঞ্জস্য রাখে বিধায়
তা গানের অন্তর্ভুক্ত৷
২. আধুনিক গানের মতো এখানেও শ্রোতাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের বিকৃতি আসে।
যেমন—গানের সুরে সুরে শরীর ও মাথা দুলানো, পশুর মত অস্বাভাবিক বিকট
আওয়াজ, যেমন—“ঠিক” ইত্যাদি বলা৷
৩. এটা খেল-তামাশা (لھو-لعب) এর অন্তর্ভুক্ত। হাসি, ঠাট্টা, তামাশা, মনোমুগ্ধকর
অঙ্গভঙ্গি করে শ্রোতাদের মন মাতানো ও তাদের আনন্দ উৎসব এবং মিলন মেলা
হিসেবে এটি অনুষ্ঠিত হয়৷
৪. এর দ্বারা মানুষ ইলম, আমল, ইত্যাদি থেকে বিমুখ হয়। কেউ সংগীত বানানো, কন্ঠ
সুন্দর করা, গাওয়া, ক্যাসেট বের করা ইত্যাদিতে মূল্যবান সময় ব্যয় করে৷ কেউ তা শুনে শুনে সময় নষ্ট করে৷
৫. এটা জায়েয কাজ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে নাজায়েয কাজ করার সুযোগ নেয়া হয়,
ছবি তোলা ও ভিডিও করা হয়, যা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয৷
অর্থাৎ এটি অনেক নাজায়েয কাজের উৎস।
এছাড়াও আরও অনেক নাজায়েয, ক্ষতিকর ও অনর্থক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়৷
অতএব বর্তমান প্রচলিত ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শরীয়তসম্মত নয়। তাই এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে কোন শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে সংগীত পরিবেশন করা ও শোনা
এবং ভিডিও করে প্রচার করা জায়েয নেই৷

দলীল সমুহ:

(সূরা লুকমান, আয়াত : ৬/ আহকামুল কুরআন, ৩/১৮৫, ৩/২৫৩; [এদারাতুল কুরআন প্রকাশনী]/ রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৪৯/ সহীহ বুখারী: ৫৯৫০/ শরহে মুসলিম লিন নববী: ২/১৯৯; [আশরাফিয়া প্রকাশনী])। কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার ফতোয়া নং : ৯৯৮৫।
ফতোয়া সত্যায়নে: মুফতী আরশাদ রহমানী মহাপরিচালক কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা৷
মুফতী এনামুল হক কাসেমী। প্রধান মুফতী, কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, মারকাযুল
ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা৷
মুফতী মুঈনুদ্দীন নানুপুরী। মুফতী, কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, মারকাযুল ফিকরিল
ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা৷
নাযেমে দারুল ইকামা : মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার)
বাংলাদেশ, বসুন্ধরা।