সংক্রামক রোগ বলতে সেই সব রোগ বোঝায়, যেসব রোগ একজন থেকে আর
একজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ছড়িয়ে পড়া শুধু মানুষ থেকে মানুষ নয়,
পশু পাখি থেকে মানুষে, পশু পাখি থেকে পশু পাখির মাঝে, কিংবা মানুষ থেকে পশু পাখির মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোগের তো হাত-পা কিংবা পাখা নেই। তবে সংক্রামক রোগ ছড়ায় কী করে?
একটু মাথা খাটালেই উত্তরটা পেয়ে যাবে। রোগ-জীবাণুরা আকারে বেশ ছোটখাটো।
এত ছোট যে একটা চুলের ডগায় কোটি কোটি জীবাণু গাদাগাদি করে রাখা যাবে। এই
ফাঁকে বলে রাখি এক ন্যানোমিটার মানে হলো এক মিটারের এক শ কোটি ভাগের এক ভাগ। আর গড়ে একটা করোনাভাইরাস হয় ১২০-১৬০ ন্যানোমিটার আকারের। চোখে
দেখা যায় না এমন একটি ক্ষুদ্র জলকণায় থাকতে পারে লাখ লাখ ভাইরাস। সুতরাং
বুঝতেই পারছ এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কতটা সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।
সংক্রামক রোগের ব্যাপারে সঠিক আকীদা কি?
মহানবী সাঃ বলেছেন, অর্থাৎ, রোগের সংক্রমণ ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছুই নেই।
পেঁচার ডাকে অশুভ কিছু নেই, সফর মাসেও অশুভ কিছু নেই, আর কুষ্ঠরোগী থেকে
সেই রকম পলায়ন কর, যে রকম সিংহ থেকে পলায়ন কর। (বুখারী ৫৭০৭, মিশকাত ৪৫৭৭নং হাদীসের অর্থ হবে, সংক্রামক ব্যাধি আছে, তা থেকে দূরে থাক, সে রোগকে বাঘের মত ভয় কর। তবে এ কথাও মনে রেখো যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন রোগ
তোমার শরীরে সংক্রমণ করতে পারে না। উলামাগণ বলেছেন, নিজস্ব ক্ষমতায় কোন
রোগ কারো দেহে সংক্রমণ করে না। কোন রোগী কোন নিরোগ ব্যক্তিকে রোগী
বানাতে পারে না। বরং আল্লাহই তাঁর ইচ্ছায় এ সব করে থাকেন।
জাহেলী যুগের লোকেরা ধারণা করত যে, কোন রোগ নিজে নিজেই অন্য দেহে
সংক্রমণ করে। নবী সাঃ তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে
মহান আল্লাহই অসুস্থ করেন এবং তিনিই রোগ অবতীর্ণ করেন। (তুহফাতুল
আহওয়াযী ৬/২৯৫) যেমন যদি কেউ ধারণা করে যে, মেঘই বৃষ্টি বর্ষণ করে, তাহলে
তাকে বলা হয় যে, মহান আল্লাহই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। মেঘ জমলেই বৃষ্টি হওয়া জরুরী
নয়, আল্লাহর হুকুমই আসল জিনিস। এ জন্যই এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, (রোগগ্রস্ত
কোন কিছুই অপরকে রোগগ্রস্ত করতে পারে না। তা করলে) “প্রথমটিকে কে
সংক্রমিত করল?” যিনি প্রথমে সংক্রামক ব্যাধি সৃষ্টি করেছেন, তিনি ছাড়া অন্য কেউ
অন্য দেহে সংক্রমিত করতে পারে না। জাহেলী যুগের লোকেরা এ ব্যাপারে এত বাড়বাড়ি ধারণা রাখত যে, সংক্রমণের আশঙ্কায় কোন রোগীকে কেউ দেখা করতে যেত না, তার খিদমত করত না এবং এক সাথে বসবাস করত না। সেই বিশ্বাস ভাঙ্গার জন্য ঐ কথা
বলা হয়েছে। হাদীসের অন্য এক অর্থে বলা হয়েছে যে, ‘লা আদওয়া’ অর্থাৎ, সংক্রমণের মুখে পড়ো না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘ফালা রাফাসা, অলা ফুসূক্বা অলা জিদালা ফিল হাজ্জ’ অর্থাৎ হজ্জে যেন যৌনাচার না করে, পাপাচার না করে এবং ঝগড়া-বিবাদ
না করে। অনুরূপ হাদীস ‘লা য্বারারা অলা য্বিরার’ অর্থাৎ ক্ষতি করো না এবং
ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না ইত্যাদি।
মুসলমান কোন রোগ-ব্যাধির নিজস্ব সংক্রমণে বিশ্বাসী নয়।
আর উক্ত হাদীসের শেষাংশটি এ কথারই ইঙ্গিত বহন করে। মুসলিম কোন রোগ-ব্যাধির নিজস্ব সংক্রমণে বিশ্বাসী নয়। কারণ, আল্লাহর তরফ থেকেই (প্রথম) আক্রমণ এবং (পরে) সংক্রমণ হয়ে থাকে। (বুখারী ৫৭০৭, মুসলিম ২২২০) আবার সংক্রামক ব্যাধি থেকে সাবধানও থাকে। কারণ, সে তকদীর ও তদবীর দুয়েই বিশ্বাসী।
তাই যে স্থানে কলেরা, বসন্ত বা অন্য কোন মহামারী দেখা দেয়, সে স্থানে সে বর্তমান
থাকলে সেখান হতে ভয়ে বের হয়ে পলায়ন করে না। কারণ তকদীর হতে পালাবার পথ কোথায়? কিন্তু সে স্থানের বাইরে থাকলে সেখানে প্রবেশ করে না। কারণ, তদবীরও ফল দেয়। (বুখারী ৫৭২৯,মুসলিম ২২১৯, আহমাদ ১/১৯২) তদনুরূপই কোন সংক্রামী
ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাছে থাকলে দূরে সরে যায় না। বা তাকে দূর বাসে না এবং দূরে
থাকলে কাছে আসে না (মুমূর্ষের সাহায্য ও চিকিৎসা করার কথা স্বতন্ত্র)। কারণ, মানুষের কাজ তদবীর করা বা সাবধানতা অবলম্বন করা। তকদীর তার নিজের কাজ করবে।
(বুখারী ৫৭০৭, মুসলিম ২২৩১)
রোগের নিজস্ব সংক্রমণ ক্ষমতা নেই।
আবার তার কাছে যাওয়ার পর যদি তারও সেই ব্যাধি হয়ে যায়, তবে সে এ বিশ্বাস বা
ধারণা করে না যে, তার কাছে এসেই রোগটা হল। বরং বিশ্বাস রাখে যে, এটা তার নিয়তির গতি বা আল্লাহপাকের ইচ্ছা। রোগের নিজস্ব সংক্রমণ নেই। আল্লাহর ইচ্ছা না হলে কোন রোগ সংক্রমণ করতে পারে না। এ কথা মূর্খরাও জানে যে, একই বাড়িতে কিছু লোকের
সংক্রামক রোগ হলে অনেক লোকের তা হয় না। রোগ ছোঁয়াচে হলেই যে প্রত্যেককেই আক্রমণ করবে — তা জরুরী নয়। রোগের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ যেমন ছোঁয়াচে রোগ প্রথম ব্যক্তিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা দেখান, তেমনি তা প্রসার লাভ করার পরেও
অনেক লোককে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। এটাই হল আকীদা।
বাকী থাকল, সাবধানতা অবলম্বন করার কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ছোঁয়াচে রোগীর সংস্পর্শে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। মহানবী সাঃ বলেছেন, “চর্মরোগাক্রান্ত উটের
মালিক যেন সুস্থ উট দলে তার উট না নিয়ে যায়।” (বুখারী ৫৭৭১, মুসলিম ৫৯২২নং)
মহামারীগ্রস্ত দেশ বা শহরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। মহানবী সাঃ বলেছেন, “কোন স্থানে প্লেগরোগ চলছে শুনলে সেখানে প্রবেশ করো না। আর সেখানে তোমাদের থাকাকালে
তা শুরু হলে সেখান হতে বের হয়ে যেয়ো না।” (বুখারী ৫৭২৮, মুসলিম ৫৯০৫-৫৯০৬নং)
কিন্তু যে রোগীর সংস্পর্শে আছে, সে কী করবে? তার মনকে শক্ত করার জন্য কি এই আকীদা জরুরী নয় যে, রোগের নিজস্ব সংক্রমণ নেই?