শাবান মাসের ফজিলত ও আমল

শাবান মাস হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস। আরবিতে এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান
মাস।শাবান শব্দের অর্থ দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এ মাসটি
রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী, তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয় (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর রহ.)। এ সময় বছরের শ্রেষ্ঠ মাস পবিত্র রমজানের আগমনী বার্তা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যায়। আর শাবান মাস এলেই চারদিকে ইবাদতের সুবাতাস বইতে শুরু করে। মুমিন হৃদয় জেগে ওঠে। নিজেদেরকে প্রভুপ্রেমে বিলিয়ে দেন বিনীদ্র রজনীতে।
ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান দিনের বেশিরভাগ সময়। আসছে রমজানের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মানসিকভাবে গড়ে তোলার
অপূর্ব সুযোগ শাবান মাস।

হিজরতের দেড় বছর পর পূর্বতন কিবলা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’-এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম তথা খানায়ে কাবা বা কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই। তাই শাবান
মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামি ঐক্যের মাস, অন্যদিকে তেমনি কাবা কেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।  শাবান আরবী বর্ষের অন্যান্য মাস সমূহের তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতপূর্ণ
মাস। রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ি উক্ত মাসটি হজরত মোহম্মাদ (সা.) এর সাথে সম্পৃক্ত। হুজুর (সা.) রমজান মাসের
রোযার সাথে উক্ত মাসটির রোজাকে মিলিয়ে দিতেন। তিনি বলেছেন: শাবান মাস আমার মাস।

শাবান মাসের ফজিলত:

হুজুর (সা.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত করতেন। ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, রজব আল্লাহ তাআলার মাস,
শাবান নবীজি (সা.)-এর মাস, রমজান হলো উম্মতের মাস। রজব মাসে ইবাদতের মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণ করা, শাবান
মাসে আরও বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিতে বীজ বপন করা, রমজান মাসে সর্বাধিক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে
সফলতার ফসল ঘরে তোলা হয়। হুজুর (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনা সংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এ মাসেই অ
বতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা নবীজি (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজি (সা.)-এর
জন্য রহমত কামনা করেন; হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’
(সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৫৬)।

তাই শাবান মাস হলো নবীজি (সা.)–এর প্রতি অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং প্রেম-ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হবে সুন্নাত অনুশীলনের মাধ্যমে। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘হে বৎস! যদি পারো এভাবে
সকাল ও সন্ধ্যা পার করো যেন তোমার অন্তরে কারও প্রতি হিংসা না থাকে; তবে তাই করো।’ অতঃপর বলেন, ‘এটাই
আমার সুন্নাত আদর্শ, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অনুসরণ করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসল; যে আমাকে
ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, তিরমিজি শরিফ: ৩৬: ১৭৫)।

রাসুল (সা.) রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবা ওয়া শাবান, ওয়া
বাল্লিগনা রমাদান’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ, প্রথম খণ্ড: ২৫৯, শুআবুল ইমান, বায়হাকি,৩: ৩৭৫)।

এ মাসে রাসুল (সা.) বেশি বেশি রোজা রাখতেন:

রমজানের রোজা মুসলমান, বালেগ, সুস্থ মানুষের ওপর ফরজ। রমজান ছাড়া ভিন্ন মাসে ফরজ রোজা নেই। তবে অন্য মাসে
ও বিশেষ দিনে নফল রোজা রাখায় সওয়াব রয়েছে। রাসুল (সা.) ও সেসব নফল রোজা রাখতেন। সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করতেন। রাসুল (সা.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। অন্য কোনো মাসে এ পরিমাণ রোজা রাখতেন না।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি পুরো শাবান মাসই রোজা রাখতেন এবং বলতেন, তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু আমল করো, কারণ
তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা (সওয়াব) দান বন্ধ করেন না। নবী (সা.) এর
কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় নামাজ ছিল তা-ই, যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হতো, যদিও তা পরিমাণে কম হতো
এবং তিনি যখন কোনো (নফল) নামাজ আদায় করতেন পরে তা অব্যাহত রাখতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)

উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাস একাধারে
রোজা রাখতে দেখিনি। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৬) বছরব্যাপী প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা
সুন্নাত। প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিদের নফল রোজাও রয়েছে। এ ছাড়া কোনো সময় ও দিন
তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যত বেশি সম্ভব নফল ইবাদত করা যায়, তা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে,
যেন কোনো ফরজ ওয়াজিব ছুটে না যায় এবং কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয়। নফল ইবাদত করা অপেক্ষা
নিষেধ থেকে বেঁচে থাকা অধিক গুরুত্ববহ।

পবিত্র শবে বরাত শাবান মাসে:

এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। এই রাতে বান্দার গুনাহ মাফ করা হয়।
অভাবীকে রিজিক দেওয়া হয়। বিপদগ্রস্তকে বিপদমুক্ত করা হয় । এই রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফার্সি এর
অর্থ রাত। ‘বারাআত’ শব্দটি আরবি। অর্থ : মুক্তি। তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত হলো ‘শবেবরাত’। ‘শবেবরাতকে
হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর
আসমানে নেমে আসেন। বান্দাকে ডাকতে থাকেন। বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করার আহ্বান করেন।

‘রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো, দিনেরবেলা রোজা
রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, আমার কাছে কোনো গুনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি
পেতে চায় কি? আমি তাকে মুক্তি দেব। আছে কী এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত।’ (সুনানে
ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)

রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা বিশেষ জরুরি একটি সুন্নাত আমল। হাদিস শরিফে
নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ, আলবানি, খণ্ড: ২,
পৃষ্ঠা: ১০৩)। সম্ভব হলে নতুন চাঁদ দেখা সুন্নাত, চাঁদ দেখে নতুন চাঁদের দোয়া পড়াও সুন্নাত; চন্দ্র মাসের তারিখের হিসাব
রাখা ফরজে কিফায়া। কারণ, ইসলামি বিধিবিধান গুলো চাঁদের তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল বাদায়েউস সানায়ে)।