শবে মিরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোন আমল আছে কি?

শবে মিরাজ’ বা ‘লাইলাতুল মিরাজ’- ফারসি শব্দ। যার অর্থ হলো রাত, রাত্রি বা রজনী। আবার ‘লাইলাতুন’ আরবি শব্দ।
এর অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘মিরাজ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ উর্ধ্বগমন বা উর্ধ্ব গমনের বড় মাধ্যম। ‘শবে মিরাজ’
শব্দ দুটির সম্মিলিত শাব্দিক অর্থ হলো- উর্ধ্বগমনের রাত বা রজনী। ইসলামী পরিভাষায় রাসূল (সা.) যে রাতে আল্লাহ
রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় তার ডাকে সাড়া দিয়ে উর্ধ্ব আকাশে গমন করেছিলেন সেই রাত ও সেই পবিত্র যাত্রাকে
‘শবে মিরাজ’ বা ‘লাইলাতুল মিরাজ’ বলা হয়।

মেরাজ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মোজেজা। রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদে
হারাম থেকে মসজিদে আকসা, এরপর বোরাকে করে ঊর্ধ্বাকাশ পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর
দিদার লাভ করার নামই মেরাজ।

এই রাত উম্মতে মুহাম্মদির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঊর্ধ্বভ্রমণের আগে মহানবী (স.) সব নবীকে নিয়ে নামাজের
ইমামতি করেন। এরপর বিশেষ বাহন বোরাকে আরোহন করেন। এই যাত্রাপথে সাত আসমানে সাতজন বিশিষ্ট নবীর
সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নবীজির। এরপর সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে সবুজ রঙের বাহন রফরফে করে আরশে আজিমে পৌঁছে
তিনি আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হন। নামাজের বিধান রচিত হয় এ রাতেই।

কিন্তু শবে মেরাজ কোন দিনের রাত্রিতে হয়েছিলো এই ব্যপারে কুরান ও সহীহ হাদীসে কিছু বলা নাই। আর ঐতিহাসিকেরা
একেক জন একেক দিনের কথা বলে – আসল কথা হচ্ছে সঠিক তারিখ কেউই জানেনা। আর তারিখ জানার প্রয়োজ়ন
নেই বলেই, এই ব্যপারে কুরান হাদীসে কিছু বলা হয় নাই।

মেরাজ কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে উম্মত-এর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে, এ ঘটনার পর রাসুল (স.) অনেক বছর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে উপস্থিত
থাকা সত্ত্বেও শবে মেরাজকেন্দ্রিক কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ হুকুম দেননি। রাসুলুল্লাহ (স.) নিজেও বিশেষ আমল করেননি।  রাসুল (স.)-এর পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তাঁরা ২৭ রজবকে বিশেষভাবে উদযাপন
করেছেন বলে একটি ঘটনাও পাওয়া যায়নি। যে কাজ রাসুল (স.) করেননি, সে কাজ সাহাবায়ে কেরামও পরিহার করেছেন।

শবে মিরাজ উপলক্ষে নতুন আবিষ্কৃত আমল (বেদআত)

রজব মাসের রোজাঃ
রাসূল (সা.) এবং তার সাহাবাদের থেকে রজব মাসের রোজার ফজিলতের ব্যাপারে প্রামাণ্য কোন দলিল নেই। তবে অন্যান্য মাসের মত এ মাসেও, সপ্তাহের সোমবার, বৃহস্পতিবার, মাসের তেরো, চৌদ্দ, পনেরো তারিখ, একদিন রোজা রাখা, পরের
দিন না রাখা- সওয়াবের, বৈধ ও সুন্নত। ওমর রা. রজব মাসের রোজা হতে নিষেধ করতেন। কারণ, এতে ইসলাম-পূর্ব কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাহেলি যুগের সাথে সামঞ্জস্য বিদ্যমান।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, রজবের নির্দিষ্ট-অনির্দিষ্ট দিনের রোজা, কিংবা রজবের নির্দিষ্ট কোন রাতের রোজার
ব্যাপারে প্রমাণ যোগ্য কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। যে কয়টি সুস্পষ্ট অর্থবহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তা দুভাগে বিভক্ত।
জইফ বা দুর্বল, মওজু বা (বানোয়াট) জাল হাদিস। তিনি সব কয়টি হাদিস একত্র করেছেন, দেখা গেছে, ১১টি দুর্বল হাদিস,
২১টি জাল হাদিস।

ইবনে কাইয়ূম রহ. বলেন, রাসূল (সা.) লাগাতার তিন মাস (রজব, শাবান, রমজান) রোজা রাখেননি-যেমন কিছু লোক করে
থাকে। রজবে কখনো রোজা রাখেননি, রোজা পছন্দও করেননি। লাজনায়ে দায়েমার ফতওয়াতে আছে, “রজবের কতক
দিনকে রোজার জন্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে আমাদের কোন দলিল জানা নেই”।

বরং অনর্থক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে মেরাজের আসল তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহর
পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করতে হবে। এছাড়াও শিরক না করা, পিতা-মাতার অবাধ্য আচরণ
না করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ না করা, সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, খাদ্যাভাবে সন্তানকে হত্যা না করা, অহংকার ও অনুমাননির্ভর কাজ থেকে বিরত থাকা, জেনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও না যাওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ ইত্যাদি
বিষয়ের শিক্ষা আমরা মেরাজের ঘটনা থেকে পাই।

শবে মিরাজ উপলক্ষে সালাতে রাগায়েব:

হাদিস শাস্ত্রে কতিপয় মিথ্যাচারের দ্বারা এ নামাজের সূচনা হয়। এ নামাজ রজবের প্রথম রাতে পড়া হয়। এ ব্যাপারে ইমাম
নববি রহ. বলেন, এটি নিন্দনীয়, ঘৃণিত, জঘন্যতম বেদআত। যা কয়েকটি অপরাধ ও নিষিদ্ধ কর্মের সমন্বয়ে রচিত। সুতরাং
একে পরিত্যাগ করা, এর থেকে বিরত থাকা এবং এর সম্পাদনকারীকে নিষেধ করা কর্তব্য। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া
রহ. বলেন, “ইমাম মালেক, শাফি, আবু হানিফা, সাওরি, লাইস প্রমুখের মতে সালাতে রাগায়েব বেদআত। হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে এ ব্যাপারে বর্ণিত সকল হাদিস জাল, বানোয়াট”।

লাইলাতুল মিরাজ মনে করে জমায়েত হওয়া, মাহফিল করাঃ

মেরাজের রজনী কিংবা মেরাজের মাস নির্ধারণের ব্যাপারে কোন প্রমাণ দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে, সত্য অনুদ্ঘাটিত। তাই এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়। মেরাজের রজনি নির্দিষ্ট করণের ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদিস
বর্ণিত হয়নি। যা বিদ্যমান আছে, সব জাল, ভিত্তিহীন। (বেদায়া নেহায়া ২:১০৭, মাজমুউল ফতওয়া ২৫:২৯৮) অতএব এ
রাতে অতিরিক্ত এবাদত ধার্য করা, যেমন রাত জাগা, দিনে রোজা রাখা, অথবা ঈর্ষা, উল্লাস প্রকাশ করা, নারী-পুরুষ অবাধ
মেলা-মেশা, গান-বাদ্যসহ মাহফিলের আয়োজন করা, যা বৈধ, শরিয়ত কর্তৃক স্বীকৃত ঈদেও না-জায়েজ-হারাম, এখানের
তো বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরন্তু মেরাজ রাত্রি ঐতিহাসিকভাবেও সুনির্দিষ্ট নয়। প্রমাণিত মনে করলেও এতে মাহফিল
করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরাম এবং পূর্বসুরীগণ হতে এ ব্যাপারে কোন দিক-নির্দেশনা পাওয়া
যায়নি। রজব মাসে গুরুত্বসহকারে কবর জিয়ারত করাঃ এটিও বেদআত। কারণ, কবর জিয়ারত বছরের যে কোন সময়
হতে পারে।

লাইলাতুল মিরাজ উপলক্ষে শিরনির আয়োজন:

আজকাল ফরজ-ওয়াজিবের মতো যে জিনিসটি ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলো শিরনির আয়োজন। শিরনি না করলে যেন
মুসলমানই নয়। নামাজ পড়ুক না পড়ুক, রোজা রাখুক বা না রাখুক, গুনাহ পরিত্যাগ করুক বা না করুক শিরনি কিন্তু
করতেই হবে। কেউ যদি শিরনি না করে অথবা শিরনি করতে বাধা দেয় তাকে সব ধরনের নিন্দা করা হয়। অথচ এই প্রথা কোরআন হাদিসে, সাহাবায়ে কেরাম-তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন কিংবা কোনো বুজুর্গ—কারো জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ বিষয়টি যারা না জেনে কুসংস্কারে হারিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে বিনয় ও ভদ্রতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে বোঝাতে হবে।
তবে অন্যান্য দিনের মতো এ রাতেও নফল ইবাদত করতে কোনো বাধা নেই। ২৬ তারিখ রাত জেগে ইবাদত করেছেন,

২৭ তারিখেও রাত জাগতে অসুবিধা নেই। তেমনিভাবে ২৭ তারিখের পরও রাত জাগুন। আবার পুরো রজব মাসটিই
আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাস থেকে মহানবী (স.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। উম্মে সালমা (রা.)
বলেন, নবী করিম (স.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে।
আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবীজি (স.)-এর আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে
পারতাম।’ নফল নামাজ-রোজা যেকোনো রাতে করতে নিষেধ নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই এ রাতের নির্দিষ্ট
কোনো আমলের কথা না বলা হলেও কেউ আল্লাহপ্রেমে রাতের নামাজ-তেলাওয়াতে মশগুল হলে অসংখ্য সওয়াবের
অধিকারী হবেন ইনশাল্লাহ।

শবে মিরাজ এ বিশেষ এবাদতের ব্যাপারে দারুল উলূম দেওবন্দের ফাতাওয়াঃ
শবে মেরাজের রাতে কি বিশেষ কোনো আমল আছে? মে’রাজের কোনো রোযা আছে কি?
ফাতাওয়াঃ রজবের ২৭ তারিখেই ˝মেরাজ˝ হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে মুহাদ্দিসীন এবং মুআররিখীন (ঐতিহাসিক) দের
মধ্যে মতপার্তক্য রয়েছে। এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদাত করার কোনো প্রমাণ হাদীসে পাওয়া যায় না। আর যে রেওয়ায়াতগুলোতে এই  রাতটিতে বিশেষ ইবাদাতের কথা রয়েছে, সেগুলো দলীলযোগ্য বা প্রমাণযোগ্য নয়। আর কেউ যদি অন্যান্য সাধারণ প্রতি রাতের মতো এ রাতেও ইবাদাত করে, তাহলে সমস্যা নেই। তদ্রুপ পরদিন রোযা রাখার ব্যাপারেও
কোনো সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। সাধারণ লোকদের মাঝে যে, কথা প্রচলিত আছে যে, ‘এই রোযার ফযীলত হাজারো
রোযার সমান।’— এই কথাটির কোনো ভিত্তি নেই। আল্লামা আব্দুল হাই লখনৌভী হানাফী (রহ.) লিখেছেন, অর্থাৎ ‘‘আর
ভারতীয় উপমহাদেশে এবং অন্যান্য স্থানে রজবের রোযার ফযীলতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, ‘এ দিনের রোযা হাজারো
রোযার সমান’— এ কথাটির কোনো ভিত্তি নেই।’’
[আছারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আহ, আল্লামা লখনৌভী, ১১২ নম্বর রেওয়ায়াতের আলোচনায়।]
ফাতাওয়া প্রদানে—দারুল ইফতা, দারুল উলূম দেওবন্দ। অনলাইন ফাতাওয়া (উর্দূ) নং: ৩৩৪৫১
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক বিষয় সঠিকভাবে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।