জীবন চলার পথে রিযিক তথা জীবিকা জীবনের অপরিহার্য উপাদান। জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবিকা ছাড়া
জীবন অসম্পূর্ণ, অচল ও অসম্ভব। কম বেশি সবার প্রয়োজনীয় জীবিকা দরকার। খাদ্য-পানীয়, সহায়-সম্বল, অর্থকড়ি,
সন্তান-সন্ততি ও ধনসম্পদ- যা আমরা ভোগ করি, সবই রিযিক এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহতায়ালাই রিজিকদাতা। এ কথা মুসলমানমাত্রই বিশ্বাস করেন। আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক মানুষ লাভ করে বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে। এই রিযিক তিনি সৃষ্টিজগৎকে দান করেন নিজ অনুগ্রহে এবং জন্মের আগে তা আমাদের ভাগ্যে বণ্টন করে রেখেছেন। আমরা সর্বদা
জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। ধনসম্পদ নিয়ে টেনশন করি। অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত থাকি। পরিবার-পরিজন
ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। টাকা-পয়সার বিষয় সামনে এলেই ব্যতিক্রম, স্বার্থপর ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। সবসময় ভাবতে থাকি, আগামীতে কী করব? কী খাব? কীভাবে চলব? ইত্যাদি, ইত্যাদি। জীবিকা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘পৃথিবীতে চলমান সকল প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি তাদের অবস্থানস্থল ও সংরক্ষণস্থল জানেন। সবকিছুই
এক স্পষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে’ (সূরা হুদ : ৬)। অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, ‘কোনো প্রাণীই জানে না, আগামীতে সে কী
উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না তার মৃত্যু কখন কোথায় হবে’ (সূরা লোকমান : ৩৪)।
রিযিক এর অন্বেষণ ও মৃত্যু থেকে বাঁচার চেষ্টায় পৃথিবীবাসী ব্যস্ত:
জন্ম, জীবিকা, বিবাহ ও মৃত্যু- এগুলো মহান রব তথা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, রহস্য ও নিয়ন্ত্রিত মহিমা! অতএব পরিশ্রম, চেষ্টা ও সাধনার পরও যদি কোনো কিছু অর্জন না হয়, তাহলে মনে করতে হবে- তা রিযিক, নসিব তথা ভাগ্যে নেই। এজন্য হতাশ
বা চিন্তিত হওয়া উচিত নয়। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা হচ্ছে ঈমানের দাবি। হাদিসে রাসূল (সা.)
বলেন, ‘গরিব মু’মিনেরা ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (তিরমিজি : ২৩৫৩)। আল্লাহপাক বান্দার জন্য
যা ভালো ও মঙ্গলজনক, তাই করেন। যদিওবা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা তা বুঝতে পারি না। অতএব কার বরাদ্দ কোথায় রেখেছেন, তা আলেমুল গায়েব আল্লাহই ভালো জানেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমার রব
যাকে চান জীবিকা বাড়িয়ে দেন, আবার সংকুচিত করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর বান্দাদের সব খবর রাখেন এবং সবকিছু দেখেন’ (৩০ : ১৭)।
জীবনের জন্য রিযিক অথচ এই রিজিকের জন্য অনেকের জীবন পর্যন্ত চলে যায়:
আমরা জীবিকার পেছনে সবাই দৌড়াই অথচ সবার রিযিক কিন্তু সমান নয়। কেউ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে লবণ
আনতে পান্তা ফুরায়। আবার কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ বসে বসে খায়। সবাই সমান রিযিক উপার্জন করতে
পারে না। আল্লাহপাকের হিকমতের দাবিও তাই। কারণ সবার রিযিক যদি সমান হয়, সবাই যদি সমান অর্থ-সম্পদের মালিক
হয়, তাহলে দুনিয়ার আবাদ ও বিশ্ব পরিচালনা ব্যাহত হবে, পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়বে। তাই এর বণ্টন আল্লাহপাক নিজ
দায়িত্বে¡ রেখেছেন। তিনি নিজ হিকমত ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সবার মাঝে তা বণ্টন করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ, রিজিক তথা জীবিকার সন্ধান করবে’ (সূরা জুমআ : ১০)।
উল্লেখ্য, সরকারের বাজেট পাস হয় সংসদে আর রবের বাজেট পাস হয় আসমানে। অতএব রিজিক বাড়ানোর জন্য
আগ্রহী প্রার্থীকে অবশ্যই আসমানে দরখাস্ত করতে হবে। রিজিক বৃদ্ধির হাতিয়ার- মহান রবের দরবারে দোয়া ও ইস্তিগফার। সরকারি বাজেট বিভিন্ন এজেন্সি ও সংস্থার মাধ্যমে সরকার জনগণের মাঝে পৌঁছে দেন। অনুরূপভাবে আল্লাহপাক সৃষ্টিজগতের বাজেট সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কাছে পৌঁছান। এ হচ্ছে বিধাতার বিধান।
জীবিকা তথা রিযিক কোনো সম্মান বা মর্যাদার মাপকাঠি নয়;
আল্লাহতায়ালা নিজ বান্দাদের পরীক্ষার জন্য রিজিক কমবেশি করেন। রিজিক বৃদ্ধি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়, অনুরূপ রিজিকের সংকীর্ণতাও তার অসন্তুষ্টির কারণ নয়। অধিকাংশ মানুষ এ বিষয় জানে না যে, দুনিয়ার সচ্ছলতা কারও শুভ
লক্ষণের প্রমাণ নয়। কেননা আখেরাতের সাফল্য নির্ভর করে নেক আমলের ওপর। দুনিয়ায় আল্লাহ কখনও অবাধ্যকে
দেন সচ্ছলতা, অনুগতকে দেন সংকীর্ণতা। আবার কখনও এর বিপরীত করেন্। কখনও উভয়কে সচ্ছলতা দেন, কখনও
দেন সংকীর্ণতা। কখনও অবাধ্য বা অনুগত ব্যক্তিকে এক সময় দেন সচ্ছলতা, অন্য সময় দেন অসচ্ছলতা। এসব কিছু
নিয়ন্ত্রণ করেন আল্লাহতায়ালা নিজ প্রজ্ঞা ও হিকমতের ভিত্তিতে।
রিযিক তথা জীবিকার এই হ্রাস-বৃদ্ধি পরীক্ষাস্বরূপ:
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, কখনও ভয়ভীতি, কখনও অনাহার দিয়ে, কখনও তোমাদের জানমাল ও ফসলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। (এমন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে) তুমি ধৈর্যশীলদের (জান্নাতের) সুসংবাদ দান করো।’ –সূরা বাকারা: ১৫৫
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি আল্লাহর নিকট মাছির ডানার সমান দুনিয়ার মূল্য থাকত, তাহলে তিনি কোনো কাফেরকে
এক ঢোক পানিও পান করাতেন না’ (তিরমিজি : ২৩২০)। অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিতনা রয়েছে, আমার উম্মতের ফিতনা হচ্ছে মাল’ (তিরমিজি : ২৩৩৬)।
স্বভাবগতভাবে মানুষ তাড়াহুড়া প্রবণ। সে দ্রুত সব কিছু পেতে চায়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নির্ধারিত জীবিকা আসবেই। কেউ
তার রিজিক ভোগ না করে মৃত্যুবরণ করবে না।’ নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানুষ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। ধনসম্পদ সংগ্রহে উত্তম পন্থা অবলম্বন করো। কেননা কেউ তার রিজিক পরিপূর্ণ না করে মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তা অর্জনে বিলম্ব হোক না কেন।’ –সুনানে ইবনে মাজাহ
বিখ্যাত বুজুর্গ হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, আমি কোরআনের নব্বই জায়গায় পেয়েছি, আল্লাহতায়ালা বান্দার রিজিক
নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেবল এক জায়গায় পেয়েছি, ‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভয় দেখায়।’ -সূরা বাকারা: ২৬৮

অতএব চিরসত্য রিযিক ও মৃত্যু- এ দুটি বিষয় বান্দার ইচ্ছাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তা একমাত্র মহান রব তথা প্রতিপালকের হাতে। এটি বিধাতার শাশ্বত বিধান। তারই নিয়ন্ত্রণাধীন ও ইচ্ছাধীন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই জীবিকা নির্ধারণ করে
রেখেছেন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই আমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করে রেখেছেন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই মৃত্যুর সময়
ও স্থান অবধারিত করে রেখেছেন। অতএব যে বিষয়টি হাতের নাগালের বাইরে, নিজের ইচ্ছাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন নয়- তা
নিয়ে দুশ্চিন্তা, হতাশা ও অনুশোচনা কখনও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
কিছু কারণে বান্দার রিযিক তথা জীবিকা বৃদ্ধি পায়। কারণগুলো হচ্ছে-
এক. একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ও সৎকর্ম করা। -সূরা আন নাহল: ৯৭
দুই. বেশি পরিমাণে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা ও ইস্তেগফার পড়া। -সূরা নুহ: ১০-১২
তিন. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলা। -সূরা আত তালাক: ২
চার. বেশি বেশি বৈধ রিজিকের জন্যে দোয়া করা। -সূরা বাকারা: ১৮৬
পাঁচ. দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। -সূরা আত তালাক: ৩
ছয়. অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা। -সহিহ বোখারি: ২৮৯৬
সাত. হজ ও উমরা করা। -সুনানে তিরমিজি: ৮১০
আট. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। -সহিহ বোখারি: ২০৬৭
নয়. সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। -সুনানে আবু দাউদ: ২৬০৬
দশ. ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা। -সহিহ মুসলিম: ৬৫৭
একমাত্র যে কারণে বান্দাকে রিজিক থেকে বঞ্চিত রাখা হয় তা হচ্ছে গোনাহের কাজে লিপ্ত থাকা। ইবনে মাজাহ: ৯০
অতএব কোনো ধরনের হতাশা নয়, তাকদিরে আমাদের জন্য যতটুকু বরাদ্দ আছে, ততটুকু আমরা পাবোই, এটাই আল্লাহর ওয়াদা। আমাদের কাজ শুধু চেষ্টা করে যাওয়া। যে বিষয়ে আল্লাহ হুকুম করেছেন- তা মানা, আর যে বিষয়ে আল্লাহ নিষেধ করেছেন, তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। এসব কাজের অন্যতম হলো-
উদাসীনতা: আল্লাহতায়ালার জিকির থেকে উদাসীনতা মানুষের রিজিকের বরকত উঠিয়ে নেয়।
সুদ: সুদ সম্পদের বরকত নষ্ট করে দেয়।
অকৃতজ্ঞতা: রিজিক কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো- অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহতায়ালার নিয়ামতের প্রতি শোকরিয়া না
করা। আল্লাহ অকৃতজ্ঞদের পছন্দ করেন না।
গোনাহ: রিজিকে বরকত আসার জন্য আল্লাহর ওপর ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি। যে বান্দা এই দু’টি জিনিস অর্জন করতে পারবে না, তার রিজিকে সংকীর্ণতা নেমে আসবে। গোনাহ ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে এটিও রিজিকের বরকত কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কখনও কখনও মুমিন বান্দার দুনিয়ায়ই এর শাস্তি ভোগ করতে হয়, যার ফলে তার
ওপর বিপদাপদ, অভাব-অনটন ও অসুস্থতা ইত্যাদি চেপে বসতে পারে।