যাদের ত্যাগে গড়ে উঠে দেওবন্দ মাদরাসাঃ
দারুল উলুম দেওবন্দের সূচনা কাল থেকেই মাদরাসা ‘র পেছনে রয়েছে কিছু মানুষের আত্মত্যাগ। যথাক্রমে- তারা হলেন হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ
(ইন্তেকাল-১২৯৭ হি.), হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবি রহ. (১৩০২ হি.),
হযরত মাওলানা হাজি আবেদ হোসাইন রহ. (১৩৩১ হি.), হযরত মাওলানা শাহ রফি
উদ্দিন রহ. (১৩০৮ হি.), হযরত মাওলানা যুলফিকার দেওবন্দি রহ. (১৩২২ হি.), হযরত মাওলানা ফযলুর রহমান উসমানি রহ. (১৩২৫ হি.)।
মূলনীতিঃ মহান শিক্ষাসাধক ও সংস্কারক হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. পরাধীন ভারতে ধ্বসে পড়া ইসলামি শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গণ-চাঁদার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে সে ধারাকে সুশৃঙ্খলভাবে টিকিয়ে রাখা এবং তার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ সকল দীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য তিনি তার বিদগ্ধ চিন্তার আলোকে কতিপয় মূলনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিহাসে এই মূলনীতিগুলোই ‘উসূলে হাশতগানা’ নামে পরিচিত। সেই নীতিমালায় তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, দেওবন্দী ধারার যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মৌলিকভাবে এ সকল নীতিমালাকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করতে হবে।
দেওবন্দ মাদ্রাসা,র নীতিমালা
১.যথাসম্ভব মাদরাসা’র কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিকহারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করতে হবে, অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা
করাতে হবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে
২. যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে বরং ক্রমান্বয়ে তা উন্নত
করার ব্যাপারে কল্যাণকামীদের সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
৩. মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী যাতে কারো মাঝে না হয় এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, উপদেষ্টাগণ নিজ নিজ
মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতের সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে। আর যথাসম্ভব
মুক্ত মনে পরামর্শ দিতে হবে । নিজের মত প্রতিষ্ঠার মনোবৃত্তি না থাকতে হবে। এ জন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী না হতে হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে সম্পাদন যোগ্য বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া অবশ্যই জরুরী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ
না হয় এবং প্রয়োজন মাফিক উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে কেবল এ জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না।
মাদরাসা ’র আরো নীতিমালা:
৪.মাদরাসার সকল শিক্ষককে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার
অনুসারী হতে হবে।দুনিয়াদার আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও
অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত না হতে হবে। যদি কখনো এরূপ
অবস্থা দেখা দেয়, তাহলে মাদরাসার জন্য এটি মোটেও কল্যাণকর হবে না।
৫. পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিতই হবে না।
৬. এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে;
ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন কোন
জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরূপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি
ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহমুখী হওয়ার মূল পুঁজি, তা হাত
ছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী
ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে।
৭. সরকার ও আমীর উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির
কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।
৮. যথা সম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় হবে বলে
মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদাদানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না
মাদ্রাসা ’র মুহতামিম সাহেবের দেখা স্বপ্ন
মাওলানা রফি উদ্দিন রহ. একদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন যে, রাসুল সাঃ তাকে
নিয়ে গিয়ে বর্তমান সাত্তা মসজিদের পাশে একটি স্থানে দাগ টেনে দিলেন এবং
সেখানেই মাদরাসার ফাউন্ডেশন দিতে বলেন। তিনি যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন,
সত্যিই তিনি রাসুলের দেখানো স্থানে টেনে যাওয়া দাগ দেখতে পেলেন। অবশেষে
সেখানেই বিখ্যাত ইলমি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাভবন নির্মাণ হলো।
(সূত্র: তারিখে দারুল উলুম, ভূমিকা; মাকতাবায়ে দারুল উলুম; ইখলাস কা তাজমহল)
দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে একবার শাহ রফি উদ্দিন রহ. স্বপ্নে দেখলেন যে দারুল
উলুম দেওবন্দে এহাতায়ে মুলসরি নিকটবর্তী কূপ দুধে ভর্তি হয়ে গেছে এবং হুজুর সাঃ পেয়ালা দিয়ে উক্ত দুধ বন্টন করছেন। কেহ বড় পাত্র দিয়ে দুধ নিচ্ছে। আবার কেহ
কেহ ছোট ছোট পাত্র দিয়ে দুধ নিচ্ছে। ঘুম থেকে জাগার পর হজরত এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন এভাবে যে, এখানে দুধ ধারা উদ্দেশ্য হলো, ইলম। সুতরাং যারা যারা সেদিন
রাসূলের হাতে দুধ পান করেছিলো তারাই কেবল এখানে ভর্তি হতে পারবে এবং কেয়ামত অবধি যারাই এখানে পড়তে আসবে প্রত্যেকে-ই নিজ নিজ মেহনতের উপর ইলম
লাভে ধন্য হবে এই পাত্রের মতো কেউ কম, কেউ বেশী।
মাদরাসা ‘র সবাইকে অবাক করা ঘটনা
এসে বলতে শুরু করলো- এই শুরবা কি খাওয়ার জন্য বানানো হয়েছে? নাকি ওজু
করার জন্য। এটা তো একদম খাবারের উপযোগী-ই না। এগুলো কোনো শুরবা হলো!
শুধুই তো টাটকা পানি দেখা যাচ্ছে। এগুলো কিভাবে খাবো? এর দ্বারা তো ওজু
করা যাবে! তার এ অভিযোগ শুনার পর মাওলানা রফি উদ্দিন সাহেব রহ. বললেন
শুধুই তো টাটকা পানি দেখা যাচ্ছে। এগুলো কিভাবে খাবো? এর দ্বারা তো ওজু
করা যাবে! তার এ অভিযোগ শুনার পর মাওলানা রফি উদ্দিন সাহেব রহ. বললেন
এই ছেলেটা সত্যিকারার্থে দারুল উলুম দেওবন্দের রেজিস্টারভুক্ত কোনো ছাত্র না
তার এ কথা শুনে উপস্থিত ছাত্র উস্তায সবাই অবাক হয়ে গেলো। আসলে বিষয়টা কী!
তিনি কিভাবে একটা ছেলেকে বিশ্বাসের সাথে মাদরাসা ‘র ছাত্র না বলে অস্বীকার
করছেন! কারণ কী? সবাই কিছুটা উদ্যত হয়ে মাদরাসা ‘র রেজিস্টারবুকে ওর নাম খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। সত্যিই দেখা গেলো সে দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র না।
এবার সকল ছাত্র উস্তাদ গিয়ে রফিউদ্দীন রহ.-এর কাছে এর রহস্য জানতে চাইলেন ।
তখন রফি উদ্দিন সাহেব
বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম হুজুর সা. নিজ হাতে দুধ বিতরণ করছেন আর
ছাত্ররা নিজ নিজ পাত্র দিয়ে দুধ সংগ্রহ করছে। সেদিন যারাই দুধ সংগ্রহ করেছে
সবার চেহারাই আমার কাছে পরিচিত। এমনকি যারাই দারুল উলুমে ভর্তি হয়
সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাদের চেহারাগুলো চিনে ফেলি। এজন্য খানা সম্পর্কে তার
অভিযোগ করার পর আমি যখন গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম, মনে হলো,
তাকে তো সেদিন আমি রাসুল সা: এর হাত থেকে দুধ সংগ্রহ করতে দেখি নি। সুতরাং
সে দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র হতে পারে না।
খানার ব্যাপারে অভিযোগ করবে না৷ এজন্যই আমি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথেই
বলেছিলাম সে প্রকৃতপক্ষে দারুল উলুম দেওবন্দের রেজিস্টারভুক্ত ছাত্র না।