মেলা: ইসলাম কী বলে?

মেলা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা বা সাময়িক বাজারের আয়োজন করা হয়। যেমন: বই মেলা, ফাল্গুনী মেলা, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় বা শখের সামগ্রীর পসরা মেলে দোকানীরা বসে। আর তথায় ছেলে-মেয়ে, জোয়ান-বুড়ো সবাই গিয়ে জড়ো হয় বিনোদনমূলক কেনা-কাটা, খাওয়া-দাওয়া করা বা ঘুরাফেরা করার জন্য। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে
মেলার অর্থ লেখা হয়েছে, বিশেষ কোনো উপলক্ষে হাট-বাজারে প্রচুরতর পণ্য ক্রয়-বিক্রয় তৎসহ আমোদ-প্রমোদের অস্থায়ী ব্যবস্থা, অস্থায়ী প্রদর্শনী, জনসমাগম, সমাবেশ,
সমাজ , সভা (পৃ: ৯৯৭)। সংসদ বাংলা অভিধানে মেলার অর্থ লেখা হয়েছে, উৎসব
পার্বন ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থাযুক্ত অস্থায়ী হাট। (পৃ: ৭১৭)।
মেলার আর একটা সহজ অর্থ মিলে-মিশে একাকার হওয়া। মেলায় যেমন একত্রিত
হয়ে দেখা-শোনা, চেনা-জানার আকাঙ্খা আছে, চলাচলের নেশা আছে, সাজগোজ বা বিপননদ্রব্য প্রদর্শনীর বাসনা আছে, তেমনি নর-নারী তরুণ-তরুণী মিলে-মিশে
একাকার হওয়ার গোপন স্পৃহাও আছে। (আরিফুল হক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও
প্রতিরোধ, পৃ: ৬১)।
বাংলাদেশে প্রচলিত মেলার প্রায় সবগুলোই ছিলো গ্রামকেন্দ্রিক। কিন্তু ইদানিং শহরের ব্যস্ততম জীবনেও বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে মেলা উৎসব দেখা যায়। চারিত্রিক বিচারে মেলাকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা চলে। ১. ধর্মীয় মেলা ২. স্বারক ও সাংস্কৃতিক
মেলা, ৩. বাণিজ্যিক প্রদর্শনী মেলা, ৪. রাজনৈতিক মেলা। বাংলাদেশের বেশিভাগ
মেলাই ধর্মীয় আদলে প্রবর্তিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা,
দূর্গাপূজা, কালীপূজা, জন্মাষ্টমী, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, শিবরাত্রি, সাধু-সন্তের
জন্ম-মৃত্যুর স্মারক দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে মেলা বসে। (আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সম্পাদিত নববর্ষ ও বাংলার লোক-সংস্কৃতি, পৃ: ৪১)।

কোন মেলা জায়েয আর কোনটা না জায়েয?

এখন কথা হলো এ সমস্ত মেলার মধ্য থেকে কোনটা জায়েয আর কোনটা না জায়েয।
এর উত্তর সহজে এভাবে দেয়া যায় যে, যদি এসমস্ত মেলায় ইসলাম পরিপন্থী কোন কার্যক্রম না হয় তাহলে তা জায়েয। যেমন বই মেলা। কিন্তু এই বই মেলাতেও যদি
ইসলাম পরিপন্থী কার্যক্রম হয় তাহলে তাও হারাম। যেমন পর্দা ছাড়া অবাধে ছেলে-মেয়েদের চলাফেরা, গানবাজনা করা ইত্যাদি। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নজরের হেফাজত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে কোন গায়রে মাহরামের প্রতি দৃষ্টিপাত না হয়।
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে বর্তমানে যতোগুলো বই মেলার আয়োজন করা হয় তার সবগুলোই এখন ‘হারাম’ কার্যক্রমে ঠাসা। অনৈসলামিক কাজে ভরপুর। তার সংখ্যা অগণিত। হাতে গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। যেমন, বেপর্দা নারী-পুরুষের ভীড় ও
ঠেলাঠেলি, বেপর্দা নারীদের এ্যাড, বেপর্দা সুন্দরী নারীরা সেল্সম্যান,ইত্যাদি। এখন
তো আবার নব্য লেখক-লেখিকাদের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা তাদের বইয়ের সেল
বাড়ানোর জন্য সশরীরে উপস্থিত থেকে ক্রেতাকে অটোগ্রাফ দিতে হয়। এবং ছেলে
লেখক মেয়ে ক্রেতার সাথে আর মেয়ে লেখক ছেলে ক্রেতার সাথে ফটো তুলে যাচ্ছে দেদারসে। অথচ লেখক বা লেখিকার আগে বড় করে ইসলামিক সাইনবোর্ড লাগানো।
যা বড় আফসোস আর পরিতাপের বিষয়।

ইসলাম নারীদের কি বলে আর নারীরা হাঠছে কোন পথে?

ইসলাম এসে নারীদের আবৃত করে রাখতে শিখিয়েছিল—ঝিনুক যেভাবে তার পেটে মুক্তোকে আবৃত করে রাখে। কিন্তু হালের ইসলামি লেখিকারা অনাবৃত দেহ প্রদর্শন করে বইয়ের উপর ইসলামিক সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তা পৌঁছে দিচ্ছে ঘরে ঘরে। দেখলে
মনে হবে অনেক চিন্তা তাদের–ইসলাম পৌঁছানো নিয়ে। কোনো অবস্থাতেই পিছিয়ে
থাকা যাবে না। সাথে সাথে বইগুলো যে পৌঁছে দিচ্ছে তার প্রমাণস্বরূপ হাজারো লোকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ আর একখানা ফটো তো তুলতেই হয়। তা-না হলে আল্লাহর
কাছে প্রমাণ পেশ করবে কীভাবে, তিনি যে ইসলামিক লেখিকা ছিলেন!
বিষয়টা যেন শৈশবের বেভুল অসতর্ক জীবনকে স্মরণ করিয়ে দেয় বারবার। দুষ্টুমি
করে যখন মায়ের কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম, মা বেচারি তখন একগাল হেসে মারবে না বলে কাছে ডেকে নিতেন। তারপর শুরু হত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। আর যুদ্ধের
সময় অব্যহৃত ইটপাটকেলগুলো কুড়িয়ে এনে পিঠে ছুঁড়তেন। কী সাংঘাতিকরে বাবা!
ঠিক শৈশব,কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের ছোঁয়া গায়ে মেখেও তেমন ধোঁকায় পড়ছি, এসব মেলায় বই সংগ্রহ করতে গিয়ে।
সুতরাং একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ঈমানদার পুরুষ বা নারীর একান্ত প্রয়োজন ছাড়া
এসব মেলাতে না যাওয়াই উত্তম। তবে পর্দা রক্ষা করা সম্ভব হলে একজন নারীর জন্য
তার স্বামী বা অভিভাবক সহকারে জরুরি কোনো কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে মেলায়
যেতে পারে। তবে যদি বিধর্মীদের কোন আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মেলা হয়ে থাকে কিংবা মেলায় শিরকি আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে সে মেলায় অংশগ্রহণ করা যাবে না।
কারণ এতে অন্যায় কাজে এক ধরনের সহায়তা করা হয়। যেমন ফাল্গুনী মেলা, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন-

‘তোমরা অন্যায় ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সাহায্য করো না।’ [সূরা
মায়েদা, আয়াত: ২] বর্তমান সময়ে চলমান মেলা গুলো বিধর্মীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের
মতোই অনুষ্ঠিত হয়। কারণ এখানে গান-বাজনা, নারী-পুরুষের অবাধে চলাফেরা এমন
কি শরীয়ত পরিপন্থী বিভিন্ন জিনিসেরও আয়োজন করা হয়। যেমন জুয়ার আসর, লটারি
ও জাদুর মতো জঘন্যতম জিনিস।
গান-বাজনা, মদ, জুয়া, লটারি ও পর্দার বিধান:
১. গান-বাজনা সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ইরশাদ করেন: “আর মানুষের
মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা সেগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য
রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।” (সূরা: লুকমান, আয়াত নং: ০৬-০৭)
কুরআনুল কারীমের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানদের ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ইবলিসকে বললেন, “তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।” (সূরা: আল-ইসরা, আয়াত নম্বর: ৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “তোমরা গায়িকা ক্রয়-বিক্রয় করো না এবং তাদেরকে
গান শিক্ষা দিয়ো না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখো, এর
প্রাপ্ত মূল্য হারাম।” (জামে তিরমিযী হাদিস: ১২৮২; ইবনে মাজাহ হাদীস: ২১৬৮)
নাসাঈ ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন হযরত আয়শা রা.–এর নিকট বাজনাদার নূপুর পরে কোনো এক বালিকা এল, তখন তাকে আয়শা রা. বললেন,
খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি
বললেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন যে, “যে ঘরে ঘণ্টি থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নাম্বার: ৪২৩১, সুনানে নাসাঈ, হাদীস নাম্বার: ৫২৩৭) সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন,
“ঘণ্টি, ঘুঙুর হলো শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নাম্বার: ২১১৪)

প্রচলিত মেলা মানেই গান, বাজনা, জুয়া, লটারি ইত্যাদি:

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে মদ, জুয়া, বলি ও ভাগ্য গণনা সম্পর্কে
বলেন, “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, দেবতার নামে বলি দেয়া ও লটারি দ্বারা ভাগ্য
গণনা শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এসব কাজ থেকে দূরে থাকো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। মদ ও জুয়ার মধ্য দিয়ে শয়তান তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ
সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্বরণ ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে চায়। তোমরা কী বিরত থাকবে? (সূরা আল মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)
তারা যেন নিজেদের আভরণ প্রকাশ না করে, তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর
পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের
মধ্যে যারা যৌন কামনা-রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক
ব্যতীত অন্য কারো নিকট। (সূরা নূর: ৩১)
হে নবী! মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর : ৩১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে
সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, ‘সাধারণত যা প্রকাশিত’ এর অর্থ হচ্ছে কাপড়।
(তাফসীরে তাবারী ১৮/১১৯)
শেষ কথা, উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমানিত হলো যে গান-বাজনা, মদ,জুয়া,লটারি ও পর্দাহীন নারীদের অবাধে চলাফেরা করা হারাম।
আর এ সমস্ত কার্যক্রম বর্তমান সময়ের মেলা গুলোতে সম্পাদিত হচ্ছে অহরহ।
তাই তা হারাম হওয়া ছাড়া হালাল হওয়ার কোন পন্থা আমার জানা নেই। এসব মেলায় যোগদান ও যোগানদান সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। এসব মেলার কোনো জিনিস খাওয়া ও
ক্রয় করা ইসলামি আত্মমর্যাদাবোধের পরিপন্থী।