রাজব মাস ইসলামের ইতিহাসে এবং মুসলিম উম্মাহর মাঝে আল্লাহর রাসূল (স.) এর স্বর্গ আরোহণের জন্য সুপরিচিত একটি
মাস। ইসরা ও মিরাজ, রাসূলুল্লাহ স. এর পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। মুমিনের ভক্তি ও বিশ্বাস এবং আবেগ ও অনুভূতির শেকড় গভীরভাবে মিশে আছে যার সঙ্গে। নবী কারীম (সা.) তাওহীদ ও ঈমানের দাওয়াতে নিজেকে বিলীন
করে দিচ্ছেন। কাফেরদের নির্মম অত্যাচার ও অবর্ণনীয় বাক্যবাণে তিনি বিধ্বস্ত। মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম জুলুম–অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট। তবুও হৃদয়ে তারা ঈমানের আলো জ্বেলে রেখেছেন। এমন মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা ডেকে নিলেন প্রিয় হাবীব (সা.)
কে ঊর্ধ্বজগতে। রাতের এক খণ্ডে, জিবরাঈলকে পাঠিয়ে, বুরাকে চড়িয়ে।
মেরাজের সংজ্ঞা:
মেরাজ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ সিঁড়ি বা ঊর্ধ্বরোহণ। ইসলামি পরিভাষায় মুহাম্মদ (সা.) এর সশরীরে কাবা শরিফ
থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে উপনীত হয়ে সেখান থেকে সপ্তাকাশ হয়ে আরশে আজিম পৌঁছে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ
করাকে মেরাজ বলে।
ইসরা এর অর্থ হলো, রাতে নিয়ে যাওয়া। মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা (ফিলিস্তিন) পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহর সফরের
কথা সূরাহ্ বানী ইসরাঈলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই
সফরকে ‘ইসরা’ বলা হয় এবং এখান থেকে যে সফর আসমানের
দিকে হয়েছে সেই সফরকে ‘মেরাজ’ বলা হয়। মেরাজ এসেছে ‘উরুজ’ থেকে যার অর্থ হলো উপরে উঠা। তাই রাসূলুল্লাহ্ (স.)
এর এই সফরের নাম হয়েছে মেরাজ।
কুরআন কারীমে মেরাজ এর সুস্পষ্ট বিবরণ নেই:
এ তো গেলো কুরআন কারীমে ইসরা এর বিবরণ। কিন্ত সেখানে মেরাজের বিবরণ এসেছে সংক্ষেপে। যেমন- ‘নিশ্চয় তিনি
তাকে (জিবারঈল) কে আরেকবার দেখেছিলেন। সিদরাতুল মুন্তাহার (সীমান্তবর্তী কুলগাছ) নিকটে, যার কাছে অবস্থিত
জান্নাতুল মা’ওয়া। তখন সেই কুল গাছটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই জিনিস, যা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। (রাসূলের) চোখ বিভ্রান্ত হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি। (অর্থাৎ দেখার ব্যাপারে চোখ ধোঁকায় পড়েনি এবং আল্লাহ তাআলা তার জন্য
যে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি তা লংঘনও করেননি যে, তার সামনে কী আছে তা দেখতে যাবে।) বাস্তবিকপক্ষে,
সে তার প্রতিপালকের বড়-বড় নিদর্শনের মধ্য হতে বহু কিছু দেখেছে। -সূরা নাজম : ১৩-১৮
সীরাত, সুন্নাহ এবং তারীখের নির্ভরযোগ্য সূত্রে রয়েছে এর বিশদ বিবরণ। সে হাদীসগুলো সামনে রেখে মিরাজের ঘটনা
নিম্নরূপ– ‘ইসরা ও মেরাজ’ এর ঘটনার সারমর্ম হলো, হিজরতের পূর্বের কথা। রাসূলুল্লাহ্ (স.) সে রাতে ‘হাতীমে কা‘বা’।
অন্য বর্ণনায় হজরত উম্মে হানী (রা.) এর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল (আ.) এসে তাঁকে ঘুম থেকে
তুলে নিয়ে গেলেন যমযমের নিকট। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হল। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ। তাতে যমযমের
পানি। জিবরাঈল আ. নবীজীর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে বের করে আনলেন হৃদয়। এবং তা জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে
ঈমান ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ করে সেটিকে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন জায়গামত। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেওয়া হল
নবীজীর বক্ষ। এরপর আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য সওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট।
নাম বুরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে।
নবীজী (সা.) মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বাইতুল মুকাদ্দাসে:
বুরাক বেঁধে রাখা হল পাথর ছিদ্র করে। সেখানে তখন সকল নবীগণ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার আগমনের পর
পরই রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর ইমামাতীতে সবাই দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। নামায পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাঈল
(আ.) নবীজীর সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজী দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাঈল আ. বললেন, আপনি (দ্বীনের) স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন। আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন
তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৯৪)
মেরাজ এর পটভূমি!!
মাক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর চাচা আবু তালিব এবং তাঁর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাহ্ (রা.) এর কাছ থেকে তিনি খুব সহযোগিতা পাচ্ছিলেন। চাচা আবু তালিবের কারণে তাঁর গোত্র বনু হাশিমের সমর্থন ও ছিলো। হযরত খাদিজাহ্ (রা.)
যেহেতু মাক্কার একজন ধনী ও সম্মানিতা মহিলা ছিলেন, তাই মাক্কার মুশরিকরাও আল্লাহর রাসূলের গায়ে হাত দেওয়ার
আগে শত বার চিন্তা করতো। তবে চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজা (রা.) যখন মারা গেলেন, তখন এই দৃশ্যমান সমর্থন থেমে গেলো। এই সুযোগ মাক্কার লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর উপর প্রকাশ্যে অত্যাচার করতে শুরু করলো। রাসূল (স.) মাক্কার মুশরিকদের অত্যাচারে
অতিষ্ট হয়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে তিনি তায়েফে চলে গেলেন। ভাবছিলেন হতে পারে
তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং তাদের ঈমানের তাওফিক হবে। কিন্তু তা হলো না। তবে তায়েফবাসীরা মাক্কাবাসীদের
চেয়েও কঠোর হৃদয়ের প্রমাণিত হলো। তারা রাসূলুল্লাহ (স.) এর সাথে এমন খারাপ আচরণ করলো যা মাক্কাবাসীদের দুর্ব্যবহারকেও ছাড়িয়ে গেছে। অতঃপর যখন কষ্ট, পরীক্ষা ও ক্লেশ সব শেষ হয়ে গেলো, তখন আল্লাহ্ তাঁর রাসূল (স.) কে মে’রাজ ও স্বর্গারোহণের মর্যাদা দিয়ে যালিমদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিলেন।
মেরাজ এর উদ্দেশ্য:
হুজুর (সা.) এর চাচা আবু তালেব ও স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকালের পর তাঁর উপরে অত্যাচারের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় আল্লাহর নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করিয়ে রসূল (সা.) এর মনোবল চাঙ্গা করাটা ছিল মেরাজের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এব্যপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতের একটি অংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে যান, যার
চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শোনেন এবং
সব কিছু জানেন। –সূরা ইসরা: ১ বস্তুত ইসরা হচ্ছে, মক্কা মুকাররমা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণের সেই পর্বটুকু,
যা রাতের একটি অংশে সংঘটিত হয়েছিল। আর মিরাজ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধ্বজগৎ পরিভ্রমণের সেই বিস্তৃত অধ্যায়।
প্রচলিত মতানুযায়ী এ ঘটনাটি ঘটেছিল নাবুয়্যাতের দ্বাদশ বর্ষে এবং রাজব মাসের ২৭ তারিখে। তখন হযরত মুহাম্মদ (স.)
এর বয়স ছিল ৫১ বছর পাঁচ মাস।
মেরাজ বা ঊর্ধ্বরোহণ শুরু: