যুগে যুগে আমাদের আকাবিরগণ নব্য বাতিলের মুকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন
করে দ্বীনী দায়িত্ব পালনের এক উজ্জ্বল নমুনা জাতির সামনে রেখে গিয়েছেন ।
কিয়ামত যতই সন্নিকটে আসবে, বাতিলের সয়লাব ততই বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
তাই আকাবিরদের অনুসরণে দ্বীন ও ঈমানের হেফাযতের জন্য ও বাতিলের
মুকাবিলার লক্ষে দ্বীনের খাদেমদের সর্বদা প্রস্তুত থাকা ঈমানী দায়িত্ব।
দীর্ঘদিন যাবত আবুল আলা মওদূদী সাহেবের প্রবর্তিত ফিতনা মহান আল্লাহ প্রদত্ত
দ্বীন-ইসলামের উপর আঘাত হেনে চলেছে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ সরল মুসলমানগণ দ্বীন অনুশীলনের ধোঁকায় পড়ে উক্ত ফিতনায় আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের দ্বীন
ও ঈমান হারাতে বসেছে। আমাদের আকাবিররা উক্ত ফিতনা সম্পর্কে মুসলিম
জাতিকে অবহিত করে গিয়েছেন। বর্তমানে ইসলামের খাদিমদেরও দায়িত্ব হচ্ছে,
এই ফিতনার মূলোৎপাটনের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা চালানো। বলাবাহুল্য, এই ব্যাপারে
হক্কানী উলামায়ে কিরামের ভূমিকা প্রশংসনীয়। মওদূদী সাহেবের ভ্রান্ত মতবাদের
দিকে জাস্ট ইঙ্গিত করতে গেলেও তা মাঝারী আকারের একটি স্বতন্ত্র বইয়ের আকার
ধারণ করবে। কাজেই আমরা এখানে মওদূদী সাহেবের ঐ সমস্ত ভ্রান্তির মধ্য থেকে
১৫টি নিয়ে আলোচনা করব। আপনারা পড়লে বুঝতে পারবেন যে, যাদের দ্বীনের
সাথে সামান্যতম সম্পর্ক আছে, তারাও এমন কথা কখনই বলতে পারে না।
উল্লেখ্য যে, মওদূদী সাহেবের সাথে আমাদের বিরোধ রাজনৈতিক নয়, যেমনটি
আজকাল প্রচার হচ্ছে। বরং, এটা আমাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। এখানে প্রশ্ন ঈমান ও
কুফরের, সত্য ও মিথ্যার।
মওদূদী সাহেবের ভ্রান্ত মতবাদের কিছু নমুনা :-
(১) আল্লাহ সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: মহান আল্লাহ কোনো ক্ষেত্রে জুলুমের আশঙ্কাজনিত কোনো বিধান দেননি। (সূরা ইউনুস- আয়াতঃ৪৪)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ যেক্ষেত্রে নর- নারীর অবাধ মেলা-মেশার সুযোগ রয়েছে, সেক্ষেত্রে যিনার কারণে আল্লাহর আদেশকৃত রজমের শাস্তি প্রয়োগ করা নিঃসন্দেহে জুলুম। (তাফহীমাত ২-২৮১)
(২) ফেরেশতা সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: ফেরেশতাগণ নূরের তৈরী আল্লাহর মাখলূক। তাদেরকে মহিলা বা পুরুষ কোনোটাই বলা যাবে না। তাদের খানা-পিনার প্রয়োজন হয় না। তারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন। (শরহুল আকাইদ-১৩৩)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ ফেরেশতা প্রায় ঐ জিনিষ, যাকে গ্রীক,ভারত প্রভৃতি দেশের মুশরিকরা দেব-দেবী স্থির করেছে। (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন-১০)
(৩) পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: পবিত্র কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করা নাজায়িয ও হারাম।
(তিরমিযী শরীফ,২/১১৯)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ কুরআন শরীফের মনগড়া ব্যাখ্যা করা জায়িয। তিনি তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকাতে লিখেন: কুরআনের এক একটি বাক্য পড়ার পর, তার যে অর্থ
আমার মনে বাসা বেঁধেছে এবং মনের ওপর তার যে প্রভাব পড়েছে, তাকে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। (তাফহীমুল কুরআন,বাংলা ১/১০)
(৪) আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাতু ওয়াসসালাম) সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: নবীগণ মাসূম তথা নিষ্পাপ, তারা যাবতীয় গুনাহ থেকে পবিত্র।
(শরহুল আক্বাইদঃ১৫২)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ
নবীগণ মাসুম নন। প্রত্যেক নবীর দ্বারাই কোনো না কোনো গুনাহ সংঘটিত হয়েছে। (তাফহীমাত ২/৪৩)
(৫) ঈসা আ.কে আসমানে উত্তোলন সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: মহান আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ঈসা আ.কে জীবিতাবস্থায় সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। (সূরা-আল ইমরান আয়াত ৫৫)
কিন্তু অমুসলিম ভ্রষ্ট কাদিয়ানী সম্প্রদায় এ সত্যকে স্বীকার করে না। মওদূদী সাহেবও তাদের অনুকরণ করে বলেনঃ ‘হযরত ঈসা আ.কে আল্লাহ তা‘আলা আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এ কথা বলা যাবে না, আবার তিনি মারা গেছেন একথাও বলা যাবে না।
বরং, বুঝতে হবে, এ ব্যাপারটি অস্পষ্ট। (তাফহীমূল কুরআন, উর্দূ, ১/৪২১)
(৬) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: মুহাম্মদ সা. মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন। (তরজুমানুস্সুন্নাহ্-৩/৩৫০, শরহুল আকাইদ-১৩০)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ মুহাম্মদ সা. মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি মানবিক দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে গুনাহ করেছিলেন। যে কারণে ‘সূরা নাসর’ এর মধ্যে
তাকে তাওবা ও ইস্তেগফার করতে বলা হয়েছে। (তাফহীমুল কুরআন বাংলা, ১৯/২৯০)
(৭) সুন্নাত সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: নবী কারীম সা. এর আদত-আখলাক ও স্বভাব-চরিত্র আমাদের অনুকরণের জন্য উত্তম নমুনা বা আদর্শ। (সূরা আহযাব ২১, বুখারী শরীফ ২/১০৮৪)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ নবী কারীম সা. এর আদত-আখলাককে সুন্নাত বলা ও তা
অনুকরণে জোর দেওয়া আমার মতে সাংঘাতিক ধরণের বিদ‘আত ও ধর্ম বিকৃতির
নামান্তর। (রাসায়েলে মাসায়েল-১/২৪৮)
(৮) ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মওদূদী সাহেবের মন্তব্য:
মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম
হল ইসলাম। (সূরা আল ইমরান- ১৯)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ ইসলাম কোনো ধর্মের নাম নয় বরং এটি হলো একটি বিপ্লবী মতবাদ। (তাফহীমাত-১/৬২)
(৯) সাহাবায়ে কেরাম রাযি. সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: সাহাবায়ে কেরাম রাযি. সত্যের মাপকাঠি। (সূরা বাক্বারা-আয়াত ১৩৭, বুখারী শরীফঃহা.৩৬৫১)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি জানবে না। (দস্তুরে জামায়াতে ইসলামী-পৃঃ৭)
(১০) মাযহাব এর তাক্বলীদ (অনুসরণ) করা সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম বলে: চার ইমামের পরবর্তী যুগের মুসলমানদের, চাই তারা আলেম হোক বা
মূর্খ হোক; হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হাম্বলী, এই চার মাযহাবের কোনো এক নির্দিষ্ট মাযহাবকে অনুসরণ করা ওয়াজিব। এ চার মাযহাবের অনুসারী সকল মুসলমান
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নামে অভিহিত।
মওদূদী সাহেব বলেনঃ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য তাক্বলীদ করা, তথা চার মাযহাবের কোনো
এক মাযহাবের অনুসরণ করা নাজায়িয ও গুনাহের চেয়েও জঘন্যতম। (রাসায়েলে মাসায়েল, ১/২৩৫)
(১১) নামায রোযা ইত্যাদি সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: দ্বীনের আসল মাকসাদ হচ্ছে; নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি
কায়েম করা। আর ইসলামী হুকুমত উক্ত মাকসাদ অর্জনে সহায়ক। (বুখারী শরীফ-কিতাবুল ঈমান.হাদীস নং-৮)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ দ্বীনের আসল মাকসাদ হচ্ছে, ইসলামী হুকুমত। আর নামায,রোযা,হজ্জ,যাকাত, প্রভৃতি ইবাদত হচ্ছে উক্ত মাকসাদ অর্জনের মাধ্যম মাত্র। (আকাবিরে উম্মত কি নযর মে মাওলানা মওদূদী পৃঃ ৬৪, জিহাদের হাক্বীকত-১৬)
মওদূদী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের ফল এই দাড়ায় যে, ইসলামী হুকুমত অর্জিত
হলে নামাজ, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতের কোনো প্রয়োজন থাকবে না।
কেননা, মাকসাদ অর্জিত হয়ে গেলে মাধ্যমের আর প্রয়োজন থাকে না। অথচ
ইসলামী হুকুমত কায়েম হোক বা না হোক, সকল মুসলমানের মৃত্যু পর্যন্ত নামায,
রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত পালন করতে হবে।
(১২) ইফতার সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: রোযার শেষ সীমা সূর্যাস্ত পর্যন্ত, সূর্য অস্ত যাওয়ার পরে ইফতার
করতে হবে, এর আগে ইফতার করলে রোযা হবে না। (ফাতাওয়ায়ে শামী-২/৩৭১এইচ
এম সাঈদ)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ ইফতারের জন্য কোনো সময়সীমা নির্ধারিত নেই। তাই কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট এদিক সেদিক হলে রোযা নষ্ট হবে না। যার অর্থ দাড়ায় যে,
সূর্য ডোবার আগেও ইফতার করতে পারবে। (তাফহীমূল কুরআন উর্দূ ১/১৪৬)
(১৩) দাড়ি সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং দাড়ি এক মুষ্টি পরিমাণ লম্বা রাখাও ওয়াজিব। (মুসলিম শরীফ-১২৯) ।
মওদূদী সাহেব বলেনঃ দাড়ি কাটা/ছাঁটা জায়িয। কেটে/ছেঁটে এক মুষ্টির কম হলেও
ক্ষতি নেই। নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পরিমাণ দাড়ি রেখেছিলেন,
সে পরিমাণ দাড়ি রাখাকে সুন্নাত বলা এবং তার অনুসরণে জোর দেওয়া আমার মতে মারাত্মক অন্যায়। (রাসায়েলে মাসায়েল ১-২৪৭)
(১৪) সিনেমা দেখা সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: সিনেমা দেখা নাজায়িয ও হারাম। (তাকমিলা ফাতহুল মূলহিমঃ৪/৯৮, আহাম মাসায়েলঃ২২৬)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ প্রকৃত পথে সিনেমা দেখা জায়িয। (রাসায়েলে মাসায়েল ১-২৬২)
(১৫) তাসাউফ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে মন্তব্য:
ইসলাম ধর্ম বলে: তাসাউফ কুরআন হাদীস দ্বারা সু-প্রমাণিত, তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মশুদ্ধি ইসলামের অন্যতম উদ্দেশ্য, বরং একে ইসলামের প্রধানতম উদ্দেশ্য
বলা হয়, কারণ, কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাযকিয়ায়ে নফসকে নবী প্রেরণের
উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আত্মশুদ্ধি অর্জনকে শরী‘আতের কোথাও ইসলামী হুকুমতের উপর নির্ভরশীল বলেনি। (সূরা বাক্বারা, আয়াত-১২৯; আল ইমরান, আয়াত-১১৪)
মওদূদী সাহেব বলেনঃ আত্মশুদ্ধির জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা পূর্বশর্ত, অর্থাৎ রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন করা ছাড়া ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি অসম্ভব । (আত্মশুদ্ধির ইসলামি পদ্ধতি-৭)
তিনি আরও বলেনঃ তরিকত বা পিরালীর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে আফিম দেওয়া
হয়েছে, এর ফলে তাদেরকে অচেতন, অকর্মা ও অকেজো করে দেওয়া হয়েছে ।
(তাজদীদে ইহইয়ায়ে দ্বীন-২২)
এভাবে তিনি ইসলামের অনেক বিষয়ে এমন মন্তব্য করেছেন, যা পূর্ববর্তী সকল উলামায়ে কেরামের বিপরীত।
মওদূদী সাহেব বর্তমানে জীবিত নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ভ্রান্ত মতবাদ এখনও পুরোদমে চালু আছে। তার কিছু ভক্ত ও অন্ধ অনুসারী না বুঝে উক্ত ভ্রান্ত চিন্তাধারা সমাজে প্রচার করে যাচ্ছেন এবং মানুষকে ধোঁকায় ফেলার জন্য বাহ্যিকভাবে ইসলামের বুলি আওড়িয়ে বস্তুত ইসলামকে বিকৃত করে নতুন ধর্ম গড়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে মওদূদী মতবাদ প্রচারে গোপন সমর্থন প্রদান করা কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য জায়িয হবে না। তাই আপন জান-মালের মাধ্যমে এ ফিতনা মূলোৎপাটনের জন্য সঠিক চেষ্টা চালানো আজ সকল মুসলমানের উপর ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যারা না বুঝে এ ভ্রান্ত মতবাদ গ্রহণ করেছেন বা এর শিকার হয়েছেন; তাদের প্রতি
আমাদের আকুল আবেদন এই যে, আপনারা হক্কানী উলামায়ে কেরামের সোহবতে
আসুন। উল্লেখিত কথাগুলো নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন। কবরে ঈমানের পরীক্ষা একবারই হবে, ফেল করলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মওদূদী
সাহেব এর সাথে উলামায়ে কেরাম এর কোনো ঝগড়া বা হিংসা নেই। শুধুমাত্র সাধারণ মুসলমানদের ঈমানের হেফাযতের জন্যই এই প্রচেষ্টা।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এই ঈমান বিধ্বংসী ফিতনা থেকে হিফাযত করে সঠিক ঈমান নিয়ে কবরে যাওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক:- মাও. হাবীবুর রহমান। প্রতিষ্টাতা পরিচালক দারুল উলূম মাদ্রাসাতুল উম্মাহ্ ফ্রান্স।