ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস:
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি:
১) অফিস আদালতে উর্দু ভাষার ব্যবহার: পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই সরকার বাঙালি জাতির উপর বিভিন্নভাবে
অন্যায় অত্যাচার শুরু করেন। ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অফিস-আদালতে ইংরেজি উর্দু ব্যবহারের পাশাপাশি পোস্টকার্ড প্রকৃতির মতো ছোটখাটো জিনিসে উর্দু ব্যবহার হতে থাকে। এভাবে সরকার বাঙ্গালীদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত তমুদ্দুন মজলিশ সর্বপ্রথম বাংলা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন।
২)গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার: ১৯৪৮ সালের ২৩ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু
হওয়ার পূর্বেই হবে গণপরিষদের ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার দাবি
উত্থাপন করেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, যেহেতু পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােকের মাতৃভাষা বাংলা, সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তার এই প্রস্তাব্রে বিরােধিতা
করেন । অধিবেশনে লিয়াকত আলী খান মন্তব্য করেন যে, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই পাকিস্তানের সরকারি
ভাষা মুসলমানের ভাষা হওয়া উচিত। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি গণপরিষদে অগ্রাহ্য হওয়ায় পূর্বাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এরই প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। বাংলা ভাষার সংগ্রামকে
সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ২ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকার ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ (১৯৪৮) পূর্ব বাংলার সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। কিন্তু পূর্ববাংলার সরকার
বাংলাভাষার আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে। সরকারী পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে
ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলমসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৩) জিন্নাহর ঘোষণা: ২১ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম
গভর্নর মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট করে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। জিন্নাহর ঘােষণায় পাকিস্তান সরকারের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি হয়। ফলে ভাষার আন্দোলন ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন:
৪) আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যবহার: বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করা ছাড়াও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা
ভাষাকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে| এতে বাঙালি জনগণ আরো বেশি ক্ষোভে
ফেটে পড়ে।
৫) খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা: ১৯৫২সালের ২৬জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার এই ঘােষণায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জানুয়ারি (১৯৫২) ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহবান করে। ৩০ জানুয়ারির সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে সমস্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সরকারি ঘােষণায় ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং
তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভাঙার পন্থা হিসেবে দশজন দশজন করে ছাত্র রাস্তায় মিছিল বের
করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকেই এদিন গ্রেফতার হন। পুলিশ মিছিলকারীদের উপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ছাত্ররা মেডিকেল হােস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে জমায়েত হন। তখন ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ বাহিনী এসে তাদের তাড়া করে এবং ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস
নিক্ষেপ করে। প্রতিবাদে ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। একদিকে ইট পাটকেল, আর অন্য দিক থেকে তার পরিবর্তে
কাঁদানে গ্যাস আর লাঠি চার্জ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই সালাম,
জব্বার ও রফিক, বরকত শহীদ হন।