ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ইতিহাস

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে
তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন জাতীয় চরিত্রের একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। সূচনায় ছাত্র-আন্দোলন হিসেবে এর প্রকাশ
ঘটলেও দ্রুতই তা দেশজুড়ে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয় সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন নিয়ে। এর মূল দাবি পাকিস্তানের
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এ আন্দোলন দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে বাঁকফেরা গুণগত পরিবর্তন
ঘটায়। প্রমাণ, বায়ান্ন থেকে পরবর্তী কয়েক বছরের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিরা বিস্মৃত হয়েই থাকে। মাঝে মাঝে পূর্ব বাংলার মুসলিম কবি-সাহিত্যিক
ও বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে মুখ খুললেও কোন হিন্দু ববি বা সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী হিন্দির বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেননি।
১৯৪৩ সালে মাসিক মোহাম্মদী (কার্তিক ১৩৫০) পত্রিকায় পূর্ববঙ্গের আবুল মনসুর আহমদ ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘‘উর্দু নিয়ে ধস্তাধস্তি না করিয়া আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয়
ভাষা রুপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, শিক্ষাখাত, অর্থনৈতিক ও শিল্পখাত রূপায়ণে হাত দিতে পারিব। ’’ তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘‘জাতির যে অর্থ, শক্তি, সময় ও উদ্যম উর্দু প্রবর্তনে ব্যয় হইবে তাহা যদি আমরা শিক্ষা-সাহিত্যে নিয়োজিত করি তবে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা শুধু ভারতে নয়, সমগ্র দেশের শ্রেষ্ট দেশে পরিণত করিতে পারিব। ’’

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস:

পূর্ব বাংলার কবি ফররুখ আহমদ ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে মাসিক সওগাত (আশ্বিন ১৩৫৪) প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিশেষ
করে পাকিস্তানে উর্দু সমর্থকদের লক্ষ করে, ‘পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘পাকিস্তানের,
অন্তত: পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা বাংলা হইবে একথা সর্বজনসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন
তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করিয়াছেন যাহা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রুপান্তরিত করিলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হইবে-এই তাদের অভিমত। কুতসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি
এর পেছনে কাজ করিয়াছে একথা ভাবিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। ’’
১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলন – পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৯৭ ভাগ এবং পূর্ব বাংলায় শতকরা ৮০ ভাগ অধিবাসী ছিল
মুসলমান। অধিকাংশ অধিবাসীর ধর্ম এক হলেও ভাষা ছিল ভিন্ন। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত এ
বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীমহল, ছাত্রসমাজ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক
কর্মী প্রমুখ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করে।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নবগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন পূর্বপাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে বাংলাভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার দাবি জানানাে হয়। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাষার প্রশ্নে সােচ্চার হয়। সংগঠনটির নাম ছিল ‘তমদ্দুন মজলিশ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
আবুল কাসেম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। পুস্তিকাটির নাম ছিল : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা – বাংলা না উর্দু’।
তমদ্দুন মজলিশ ছাত্র-শিক্ষক মহলে বাংলাভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। ১৯৪৭ সালের মধ্যেই বহু প্রখ্যাত এবং
অখ্যাত লেখক বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রতি তাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের দাবি
উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়। যদিও পাকিস্তানের শতকরা মাত্র ৩.২৭ ভাগ লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু তথাপি পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফরম, রেলের টিকেট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও
উর্দুভাষা ব্যবহার করা হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি:

১) অফিস আদালতে উর্দু ভাষার ব্যবহার: পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই সরকার বাঙালি জাতির উপর বিভিন্নভাবে
অন্যায় অত্যাচার শুরু করেন। ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অফিস-আদালতে ইংরেজি  উর্দু ব্যবহারের পাশাপাশি পোস্টকার্ড প্রকৃতির মতো ছোটখাটো জিনিসে উর্দু ব্যবহার হতে থাকে। এভাবে সরকার বাঙ্গালীদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত তমুদ্দুন মজলিশ সর্বপ্রথম বাংলা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন।

২)গণপরিষদে  ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার: ১৯৪৮ সালের ২৩ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু
হওয়ার পূর্বেই হবে গণপরিষদের ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার দাবি
উত্থাপন করেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, যেহেতু পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােকের মাতৃভাষা বাংলা, সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তার এই প্রস্তাব্রে বিরােধিতা
করেন । অধিবেশনে লিয়াকত আলী খান মন্তব্য করেন যে, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই পাকিস্তানের সরকারি
ভাষা মুসলমানের ভাষা হওয়া উচিত। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি গণপরিষদে অগ্রাহ্য হওয়ায় পূর্বাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এরই প্রতিবাদে  ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। বাংলা ভাষার সংগ্রামকে
সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ২ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকার ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ (১৯৪৮) পূর্ব বাংলার সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। কিন্তু পূর্ববাংলার সরকার
বাংলাভাষার আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে। সরকারী পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে
ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলমসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৩) জিন্নাহর ঘোষণা: ২১ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম
গভর্নর মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট করে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। জিন্নাহর ঘােষণায় পাকিস্তান সরকারের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি হয়। ফলে ভাষার আন্দোলন ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন:

৪) আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যবহার: বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করা ছাড়াও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা
ভাষাকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে| এতে বাঙালি জনগণ আরো বেশি ক্ষোভে
ফেটে পড়ে।

৫) খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা: ১৯৫২সালের ২৬জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার এই ঘােষণায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জানুয়ারি (১৯৫২) ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহবান করে। ৩০ জানুয়ারির সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে সমস্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সরকারি ঘােষণায় ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং
তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভাঙার পন্থা হিসেবে দশজন দশজন করে ছাত্র রাস্তায় মিছিল বের
করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকেই এদিন গ্রেফতার হন। পুলিশ মিছিলকারীদের উপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ছাত্ররা মেডিকেল হােস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে জমায়েত হন। তখন ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ বাহিনী এসে তাদের তাড়া করে এবং ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস
নিক্ষেপ করে। প্রতিবাদে ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। একদিকে ইট পাটকেল, আর অন্য দিক থেকে তার পরিবর্তে
কাঁদানে গ্যাস আর লাঠি চার্জ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই সালাম,
জব্বার ও রফিক, বরকত শহীদ হন।

ভাষা আন্দোলনের ফলাফল:
সাধারণ জনগণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ১৫ মার্চ আলােচনায় বসেন এবং ৮ দফা চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মূল বিষয় ছিল
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে, পুলিশি অত্যাচার নির্যাতনের
বিষয়ে তদন্ত করা হবে, পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে, সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু পূর্ববাংলা সরকার চুক্তির শর্তগুলি বাস্তবায়ন না করায়
ভাষা আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচঢালা কালো পথ। বাংলার মানুষের রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া কালি দিয়ে লেখা হয়
এক অনন্য ইতিহাস। অবশেষে তীব্র বিক্ষোভের মুখে পাকিস্তান সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সাময়িকভাবে
বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তারপর সাংবিধানিকভাবে ১৯৫৬ সালে সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।
মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।