(৬) ওয়ালীমা করা : বিবাহ র পরে বরের অন্যতম কর্তব্য হ’ল ওয়ালীমা করা। আলী (রাঃ) যখন ফাতিমা (রাঃ)-কে বিবাহ র পয়গাম পাঠালেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই নববধুর জন্য ওয়ালীমা হতে হবে’। ওয়ালীমার মাধ্যমে
বিবাহ র কথা সকলের মাঝে প্রচার হয়। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন ‘রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বিবি যয়নাবের বিবাহে যত
বড় ওয়ালীমা করেছিলেন, তত বড় ওয়ালীমা তিনি পরবর্তী কোন স্ত্রীর বিবাহে করেননি। তাতে তিনি একটি বকরী দিয়ে
ওয়ালীমা করেছেন’। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যেদিন যয়নাব (রাঃ)-এর সাথে বাসররাত উদযাপন করলেন,
সেদিন ওয়ালীমার ব্যবস্থা করলেন এবং মুসলিমদেরকে তৃপ্তি সহকারে রুটি ও গোশত খাওয়ালেন। অতঃপর তিনি তাঁর
স্ত্রীদের কাছে গেলেন এবং তাদের প্রতি সালাম করে তাদের জন্য দো‘আ করলেন। আর তারাও তাঁকে সালাম করলেন
এবং তাঁর জন্য দো‘আ করলেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁর বাসর রাতের সকালে এরূপ করতেন’।
কয়দিন ওয়ালীমা করা যাবে :
ওয়ালীমার নামে আমাদের সমাজে বড় লোকদের মিলন মেলা বসে, যেখানে ছেলে বা মেয়ের অভিভাবকদের দৃষ্টি
থাকে উপহারের দিকে। ফলে দরিদ্র লোকজন এসব অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ ওয়ালীমার দাওয়াতে উপহার
দেওয়া বা নেওয়া রাসূলের সুন্নাত নয়, সুন্নাত হ’ল সৎ ব্যক্তিগণকে দাওয়াত দেওয়া। তারা দাওয়াত গ্রহণ করে ওয়ালীমাতে আসবেন ও নবদম্পতির ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য দো‘আ করবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘তুমি শুধুমাত্র মুমিনের সাথী হবে,
আর কেবল আল্লাহভীরু ব্যক্তিই তোমার খাদ্য খাবে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘খাদ্যের মধ্যে নিকৃষ্ট খাবার ঐ ওয়ালীমার
খাবার যাতে শুধু ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং দরিদ্রদেরকে ত্যাগ করা হয়। আর ওয়ালীমার দাওয়াত যে কবুল করল না, সে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধিতা করল’। কোন মুসলিম ভাই ওয়ালীমার দাওয়াত দিলে দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব।
রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘তোমাদের কাউকে ওয়ালীমার দাওয়াত করা হলে সে যেন তাতে অংশগ্রহণ করে’।
বিবাহ র প্রচলিত প্রথা, যা ত্যাগ করা প্রয়োজন :
(১) বিবাহ র তারিখ নির্ধারণ :বছরের কোন মাস বা দিনকে বিবাহের জন্য নির্ধারণ করা অথবা বিরত থাকা শরী‘আত
বিরোধী। নির্দিষ্ট কোন দিনে, কারো মৃত্যু বা জন্মদিনে বিবাহ করা যাবে না মনে করা গুনাহের কাজ। আল্লাহর কাছে
বছরের প্রতিটি দিনই সমান। মানুষ তার সুবিধা অনুযায়ী যে কোন দিন নির্ধারণ করতে পারবে।
(২) যৌতুক : বর্তমানে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের বিবাহে যৌতুক একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিবাহ র সময় কনের পক্ষ থেকে বরকে বা বরপক্ষকে কিছু দিতে হবে, এটা ইসলাম সমর্থন করে না; বরং ছেলেপক্ষ
তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মেয়েকে মোহর প্রদান করবে। আল্লাহ বলেন ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহরানা খুশী মনে
প্রদান কর’ (নিসা ৪/৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের মোহরানা ফরয হিসাবে প্রদান কর’
(নিসা ৪/২৪)। হিন্দু ধর্মের ‘পণ’ প্রথা থেকে মুসলিম সমাজে ‘যৌতুক’ প্রথার প্রচলন হয়। এ প্রথা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
(৩) মোহরকে বংশীয় মর্যাদার প্রতীক বা নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসাবে মনে করা : বিবাহে মোহরের মত ফরয
কাজকে আজকাল বংশ-মর্যাদা বা তালাক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারীর হাতিয়ার হিসাবে অনেকে মনে করেন।
এজন্য ছেলের সামর্থ্যের দিকে লক্ষ্য না করে মেয়েপক্ষ তাদের বংশমর্যাদা অনুযায়ী লক্ষ লক্ষ টাকা মোহর নির্ধারণ
করেন। আবার অনেকে মনে করেন বিবাহে মোহর বেশী ধার্য করা থাকলে ছেলেপক্ষ মেয়েকে তালাক দিতে পারবে
না বা তালাক দিতে চাইলে প্রচুর টাকা দিতে হবে। এই উভয় ধারণাই ইসলাম বিরোধী। রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় লোকেরা
এক মুষ্টি খাদ্যের বিনিময়েও বিবাহ করতেন। এছাড়া কিছু না থাকায় কেবল কুরআন শিক্ষাদানের বিনিময়ে আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ) জনৈক ব্যক্তির বিবাহ দিয়েছেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,
‘সাবধান! তোমরা নারীদের মোহরের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কর না। কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখেরাতে
আল্লাহর নিকট তাক্বওয়ার বিষয় হত, তবে তোমাদের চেয়ে এ ব্যাপারে নবী করীম (ছাঃ)-ই অধিক উপযুক্ত ছিলেন।
কিন্তু রাসূল (ছাঃ) বার উকিয়ার বেশী দিয়ে তাঁর কোন স্ত্রীকে বিবাহ করেছেন অথবা তাঁর কোন কন্যাকে বিবাহ
দিয়েছেন বলে জানা নেই’। নবী করীম (ছাঃ) বলেন ‘উত্তম মোহর হচ্ছে, যা দেয়া সহজ হয়’।
(৪) থুবড়া প্রথা :
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বর ও কনেকে বিবাহের দু’তিন দিন পূর্বে নিজ নিজ বাড়ীতে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে রাতের প্রথমাংশে মাহরাম, গায়রে মাহরাম পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতী সকলে মিষ্টি, ফল-মূল ও পিঠা-পায়েস ইত্যাদি মুখে তুলে
খাওয়ায়। সেই সাথে নব যুবতীরা গীত গেয়ে পয়সা আদায় করে। এসব রীতি ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এর মাধ্যমে
যুবক-যুবতীরা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায় এবং পর্দাহীনতা ও যেনার দিকে ধাবিত হয়।
(৫) আংটি পরানো : আজকাল মুসলমানদের অধিকাংশ বিবাহে আংটি বদলের রীতি চালু রয়েছে।
(৬) গায়ে হলুদ : গায়ে হলুদের নামে আমাদের সমাজে বিবাহের দু’একদিন পূর্বে বর ও কনের সর্বাঙ্গে বর-কনের ভাবী,
চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনেরা মিলে হলুদ মাখার যে অনুষ্ঠান করে, তা ইসলামী বিধানের
সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া নিজে অথবা মাহরাম ব্যক্তি কর্তৃক বর-কনেকে হলুদ মাখানো যায়।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
‘নবী করীম (ছাঃ) আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ)-এর গায়ে হলুদ রঙের আলামত দেখে বললেন, এটা কিসের রঙ?
তিনি বললেন, আমি একটি মেয়েকে খেজুরের আট পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে বিয়ে করেছি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন,
আল্লাহ তা‘আলা তোমার এ বিয়েতে বরকত দান করুন। তুমি একটি ছাগলের দ্বারা হ’লেও ওয়ালীমার ব্যবস্থা কর’।
(৭) বিবাহ অনুষ্ঠানে গান-বাদ্য বাজানো :
আমাদের সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানের অন্যতম ব্যঞ্জন হল বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী বিভিন্ন অশ্লীল গান-বাদ্যের আয়োজন
করা। বিবাহের ২/৩ দিন আগে থেকেই এই নাচ-গানের আসর চলে, শেষ হয় বিবাহের কয়েকদিন পর। অথচ ইসলামে
এই অশ্লীল গান-বাদ্যকে হারাম করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো
দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জ্ঞান করবে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন
‘আল্লাহ আমার উপর হারাম করেছেন অথবা হারাম করা হয়েছে মদ, জুয়া ও তবলা’। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে বিবাহসহ
বিভিন্ন সময় দফ বাজানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। বিবাহ র ঘোষণা করার জন্য দফ বা একমুখা ঢোল বাজানো বৈধ।
(৮) মহিলা বরযাত্রী : মহিলাদের যে কোন সময়ই বেপর্দা হয়ে সাজসজ্জা করে বের হওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু বিবাহের সময়
মহিলারা সাজগোজ করে পাতলা কাপড় পরিধান করে পর্দাহীনভাবে বরের সাথে কনের বাড়ীতে যায়। এটা ইসলামে
বৈধ নয়। যদি মহিলাদেরকে একান্তই যেতে হয় তাহ’লে পর্দার সাথে শালীন হয়ে যেতে হবে।
(৯) বিবাহ উপলক্ষে সাজগোজ করা :
বর্তমানে বিবাহ অনুষ্ঠানে পাত্র-পাত্রীকে বিভিন্নভাবে সাজানোর প্রথা চালু আছে। বিউটি পার্লার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
অনেকে সাজ নষ্টের আশংকায় ছালাত পরিত্যাগ করে। এসব সাজসজ্জা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি।
তবে স্বাভাবিক সাজসজ্জা দোষণীয় নয়। আবার বিবাহে বরকে স্বর্ণের আংটি উপহার দেওয়া হয়। যা শরী‘আতে নিষিদ্ধ।
কেননা পুরুষদের সোনা ব্যবহার হারাম। এতদ্ব্যতীত নেইল পালিশ ব্যবহার, কপালে টিপ দেওয়া, নখ বড় রাখা ইত্যাদি
সবই বিধর্মীদের আচরণ। এগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে,
সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’।
(১০) অপচয় করা : আজকাল অধিকাংশ বিবাহে অপচয় করতে দেখা যায়। অনেকে আবার অপচয় করতে গিয়ে ঋণী
হয়ে পড়ে। যেমন বিবাহের দাওয়াতের জন্য দামী কার্ড ছাপানো, শুধু বিবাহে ব্যবহারের জন্য বাহারী দামী পোশাক ক্রয়
করা, পটকা-আতশবাজি ফুটান, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, রঙ ছিটাছিটি করা ইত্যাদি। ইসলামে এসব অপচয় হারাম। কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।
শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৭)।
(১১) অনৈসলামী রীতি : বিবাহের অনুষ্ঠানে বাঁশের কুলায় চন্দন, মেহেদি, হলুদ, কিছু ধান-দূর্বা ঘাস, কিছু কলা, সিঁদুর ও
মাটির চাটি নিয়ে মাটির চাটিতে তৈল দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। তারপর বর-কনের কপালে তিনবার হলুদ মাখায়।
এমনকি মূর্তিপূজার ন্যায় কুলাতে রাখা আগুন জ্বালানো, বর-কনের মুখে আগুনের ধোঁয়া ও কুলা হেলিয়ে-দুলিয়ে বাতাস
দেওয়া হয়। কোন কোন এলাকায় বর-কনেকে গোসল করতে নিয়ে যাওয়ার সময় মাথার উপরে বড় চাদরের চার কোণা
চারজন ধরে নিয়ে যায়। বিবাহ করতে যাওয়ার সময় বরকে পিঁড়িতে বসিয়ে বা সিল-পাটায় দাঁড় করিয়ে দুধ-ভাত খাওয়ানো
হয়। সম্মানের নামে বর-কনে মুরববীদের কদমবুসি করে। এছাড়া বিবাহের পর বর দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম করে।
এসব প্রথা ইসলামে নেই। এতদ্ব্যতীত আজকাল মহিলারা তাদের চোখের ভুরু উঠায়, মাথায় কৃত্রিম চুল লাগায়, দাঁতের
মাঝে কেটে ফাঁকা করে, হাত-পায়ের নখ বড় রাখে, যা শরী‘আত সমর্থিত নয়।
(১২) বিবাহ র বয়স নির্ধারণ :
আমাদের দেশে ছেলে-মেয়ের বিবাহের জন্য বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত বয়সের পূর্বে কেউ বিবাহ
করতে পারবে না, করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটা শরী‘আতবিরোধী আইন। ইসলাম প্রত্যেক প্রাপ্ত
বয়স্ক সামর্থ্যবান নারী-পুরুষকে চরিত্র সংরক্ষণের জন্য বিবাহের নির্দেশ ও অনুমতি দিয়েছে। যখন নবী করীম (ছাঃ)
আয়েশা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর এবং যখন বাসর করেন তখন তার বয়স ছিল ৯ বছর এবং
তিনি ৯ বছর নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে জীবন কাটান।
পরিশেষে বলা যায়, বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যা ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্দেশিত। এতে পার্থিব ও পরকালীন
কল্যাণ রয়েছে। কিন্তু তা পূর্ণ ইখলাছ সহকারে শরী‘আতসিদ্ধ পন্থায় সম্পন্ন হ’তে হবে। অন্যথা তা ইহকালে যেমন কল্যাণ
বয়ে আনবে না; পরকালেও কোন ছওয়াব বা বিনিময় পাওয়া যাবে না। তাই এ বিষয়ে সকলকে সজাগ ও সচেতন হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!