বিবাহের গুরুত্ব ও পদ্ধতি (তৃতিয় পর্ব)

(৮) মোহরানা নির্ধারণ : বিবাহের আগে মোহরানা নির্ধারণ করা এবং বিবাহের পর তা স্ত্রীকে দিয়ে দেওয়া ফরয।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহরানা খুশী মনে প্রদান কর’ (নিসা ৪/৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,
‘তোমরা স্ত্রীদের মোহরানা ফরয হিসাবে প্রদান কর’ (নিসা ৪/২৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘(বিবাহে) সবচেয়ে বড়
শর্ত যেটা তোমরা পূর্ণ করবে, সেটা হল যা দ্বারা তোমরা লজ্জাস্থানকে হালাল কর’। অর্থাৎ মোহর।
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, জনৈক মহিলা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)!
আমি আমার জীবনকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে এসেছি। নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে তাকালেন এবং
তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করলেন। তারপর তিনি মাথা নিচু করলেন। যখন মহিলাটি দেখল নবী করীম (ছাঃ) তার
সম্পর্কে কোন ফায়ছালা দিচ্ছেন না, তখন সে বসে পড়ল। এরপর নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের মধ্যে একজন
দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আপনার বিবাহের প্রয়োজন না থাকে, তবে আমার সঙ্গে
এর বিবাহ দিয়ে দিন। রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে কী? সে উত্তর দিল, না, আল্লাহর
কসম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার কাছে কিছুই নেই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের
কাছে গিয়ে দেখ, কিছু পাও কি-না। তারপর লোকটি চলে গেল। ফিরে এসে বলল, আল্লাহর কসম! আমি কিছুই পাইনি।
এরপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, আবার দেখ, লোহার একটি আংটিও যদি পাও। তারপর লোকটি আবার চলে গেল।
ফিরে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! লোহার আংটিও পেলাম না। কিন্তু এই আমার লুঙ্গি (শুধু এটাই আছে)।
সাহল (রাঃ) বলেন, তার কাছে কোন চাদর ছিল না। লোকটি লুঙ্গির অর্ধেক মহিলাকে দিতে চাইল। তখন রাসূল (ছাঃ)
বললেন, সে তোমার লুঙ্গি দিয়ে কি করবে? যদি তুমি পরিধান কর, তাহলে তার কোন কাজে আসবে না। আর সে যদি
পরিধান করে, তবে তোমার কোন কাজে আসবে না। এরপর বেশ কিছুক্ষণ লোকটি নীরবে বসে থাকল। তারপর সে
উঠে দাঁড়াল ও নবী করীম (ছাঃ) তাকে যেতে দেখে ডেকে আনলেন এবং

কুরআন মাজীদ মুখস্থকে মোহরানা সাব্যস্ত করলেন:

জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি পরিমাণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ আছে? সে বলল, আমার অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে
এবং সে গণনা করল। নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী তোমার মুখস্থ আছে। সে বলল, হ্যাঁ। নবী করীম
(ছাঃ) বললেন, যে পরিমাণ কুরআন তোমার মুখস্থ আছে তার বিনিময়ে তোমার কাছে এ মহিলাকে তোমার অধীনস্থ
করে দিলাম’। স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীকে মোহরানা দিতে হবে। যখন আলী (রাঃ) ফাতিমা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন
তখন রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি ফাতিমাকে (মোহরানা স্বরূপ) কিছু দাও। আলী (রাঃ) বললেন, আমার নিকট
কিছু নেই। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার হুতামী বর্মটি কোথায়’? অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ছাঃ)
এক ব্যক্তিকে বললেন,  ‘তুমি বিবাহ কর, একটি লোহার আংটির বিনিময়ে হলেও’।
উল্লেখ্য যে, কারণবশতঃ মোহর বাকী রাখা যায়। তবে সেটা ঋণের অন্তর্ভুক্ত। তাই যত দ্রুত সম্ভব তা পরিশোধ করা
কর্তব্য। মোহর বাকী থাকলে সন্তান অবৈধ হবে একথা ঠিক নয়। কেননা বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মোহর পরিশোধ
করা শর্ত নয়। রাসূল (ছাঃ) একজন ব্যক্তিকে বললেন, অমুক মহিলার সাথে তোমাকে বিবাহ দিব তুমি কি রাযী?
সে বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, অমুক ব্যক্তির সাথে তোমাকে বিবাহ দিব তুমি কি রাযী? মহিলা বলল, হ্যাঁ।
তিনি তাদের বিবাহ দিলেন। কিন্তু কোন মোহর নির্ধারণ করলেন না এবং মহিলাকে কিছু দিলেন না। ঐ ব্যক্তি
হোদায়বিয়ার ছাহাবী ছিলেন। পরে তিনি খায়বরের গণীমতের অংশ পান। এ সময় তাঁর মৃত্যু উপস্থিত হ’লে তিনি
বলেন, স্ত্রীর জন্য আমার কোন মোহর নির্ধারিত ছিল না। এক্ষণে আমি আমার খায়বরের প্রাপ্ত অংশ তাকে মোহর
হিসাবে দান করলাম। যার মূল্য ছিল এক লক্ষ দিরহাম’। নবী করীম (ছাঃ) একদা মোহর বাকী রেখে এক ব্যক্তির
বিবাহ দেন এবং কুরআন শিক্ষাদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা আদায় করতে বলেন। তবে সমাজে মৃত্যুর সময় স্ত্রীর
নিকট থেকে মোহর মাফ করিয়ে নেওয়ার যে প্রচলন রয়েছে, তা চরম অন্যায় ও প্রতারণাপূর্ণ। এ থেকে অবশ্যই
বিরত থাকতে হবে এবং হাতে অর্থ এলেই সর্বাগ্রে স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করতে হবে।

(৯) বিবাহের খুৎবা পড়া ও কবুল বলানো :

আমাদের সমাজে কবুল বলানোর জন্য কাযী বা যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি বরের অনুমতি নিয়ে দু’জন সাক্ষীসহ
কনের নিকট চলে যান। কাযী গিয়ে বরের ঠিকানা ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করে কবুল বলতে বলেন। কবুল বলার
পর কাযী ছাহেব বরের নিকট ফিরে আসেন এবং মেয়ের ঠিকানা ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করে মেয়েকে গ্রহণ
করার জন্য কবুল বলতে বলেন। তিন বার কবুল বলার পর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এভাবে বিবাহ পড়ানো শারঈ পদ্ধতি নয়। ইসলামের নিয়ম হ’ল বিবাহের পূর্বে একজন বিবাহের খুৎবা পাঠ করবেন। এরপর মেয়ের পিতা বা অভিভাবক বরের
সামনে মেয়ের পরিচয় ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখপূর্বক বিবাহের প্রস্তাব করবেন। এসময় দু’জন সাক্ষীও উপস্থিত
থাকবেন। তখন বর সরবে ‘কবুল’ অথবা ‘আমি গ্রহণ করলাম’ বলবেন। এরূপ তিনবার বলা উত্তম। শুধু বরকেই
কবুল বলাতে হবে। কনের নিকট থেকে কনের অভিভাবক শুধু অনুমতি নিবেন। বর বোবা হ’লে সাক্ষীদ্বয়ের
উপস্থিতিতে পরিচিতিমূলক ইশারা বা লেখার মাধ্যমেও বিবাহ হ’তে পারে। বিবাহের খুৎবা নিম্নরূপ-
অতঃপর বিবাহ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কথা বলবেন।
(১০) বিবাহ শেষে দো‘আ পাঠ : বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর উপস্থিত সকলে বর-কনের জন্য নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বে-
‘আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার প্রতি বরকত নাযিল করুন এবং তোমাদের উভয়কে কল্যাণে মিলিত করুন’।
(১১) বাসর ঘর ও কনে সাজানো : বিয়ের পর বর-কনেকে একত্রে থাকার জন্য বাসর ঘরের ব্যবস্থা করা ও কনেকে
সাজিয়ে সুন্দর করে বরের সামনে উপস্থিত করা সুন্নাত।

(১২) বিবাহের ঘোষণা দেওয়া :

বিবাহ হচ্ছে একটি প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। তাই বিয়ের অনুষ্ঠান সকলকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। রাসূল (ছাঃ)
বলেছেন, ‘তোমরা বিবাহের অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার কর’। এজন্য বিবাহের সময় ইসলামে দফ বা একমুখা ঢোল
বাজানোকে জায়েয বলা হয়েছে। রুবাই বিনত মুআবিবয ইবনু আফরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার বাসর
রাতের পরের দিন নবী করীম (ছাঃ) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার বিছানার
ওপর বসে আছ। সে সময় আমাদের ছোট মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং বদরের যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত আমাদের
বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল’।

বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য :

(১) স্ত্রীর মাথার অগ্রভাগে হাত রেখে দো‘আ করা : নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোন মহিলাকে
বিবাহ করবে অথবা চাকর ক্রয় করবে, সে যেন তার কপালে হাত রেখে বিসমিল্লাহ পড়ে বলে, ‘হে আল্লাহ! আমি
আপনার নিকট তার মঙ্গল ও যে মঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন তা প্রার্থনা করছি। আর তার অমঙ্গল ও যে
অমঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।
(২) স্বামী-স্ত্রী জামা‘আতে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা : শাকীক (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি আগমন করল, তাকে
আবু হারীয বলে ডাকা হত। তারপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আমি একজন যুবতী কুমারী মহিলাকে বিবাহ করেছি। আর
আমি ভয় করছি যে, সে আমাকে অসন্তুষ্ট করবে। তারপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ বলেন, নিশ্চয়ই বন্ধুত্ব-ভালবাসা
আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং রাগ-অসন্তুষ্টি শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান ইচ্ছা করছে যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা
বৈধ করেছেন তা সে তোমাদের নিকট ঘৃণা সৃষ্টি করবে। সুতরাং সে (তোমার স্ত্রী) যখন তোমার কাছে আসবে তখন
তাকে জামা‘আত সহকারে তোমার পিছনে দু’রাক‘আত ছালাত পড়তে নির্দেশ দিবে।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,

স্ত্রী স্বামীর কাছে গেলে স্বামী দাঁড়িয়ে যাবে এবং স্ত্রী তার পিছনে দাঁড়াবে। অতঃপর তারা একসঙ্গে দুই রাক‘আত ছালাত
আদায় করবে এবং বলবে,  ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দিন এবং আমার ভিতরেও বরকত
দিন পরিবারের জন্য। হে আল্লাহ! আপনি তাদের থেকে আমাকে রিযিক দিন আর আমার থেকে তাদেরকেও রিযিক দিন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যতদিন একত্রে রাখেন কল্যাণেই একত্রে রাখুন। আর আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলে কল্যাণের পথেই বিচ্ছেদ ঘটান’।
(৩) সহবাসকালে দো‘আ পাঠ : রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ স্ত্রীর কাছে আসলে সে যেন বলে, উচ্চারণ:
‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা জান্নিবনাশ শায়তা-না ও জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা’। অর্থ: ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তানের প্রভাব থেকে দূরে রাখুন এবং আমাদের যে সন্তান দান করবেন তাদের শয়তানের
প্রভাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুন’।
(৪) সহবাসের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সময় ও জায়গা থেকে বিরত থাকা : বিবাহের পর মহিলা ঋতুবতী হ’লে সময় শেষ না হওয়া
পর্যন্ত এবং মহিলাদের পিছন দ্বারে সহবাস করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘যে ব্যক্তি কোন ঋতুবতী মহিলার
সঙ্গে কিংবা স্ত্রীর পিছনপথে সঙ্গম করে অথবা গণকের কাছে যায় এবং তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল’।
(৫) স্ত্রী সহবাসের পর ঘুমানোর পূর্বে ওযূ করা : সহবাসের পরে ঘুমাতে ও পানাহার করতে চাইলে কিংবা পুনরায়
মিলিত হতে চাইলে মাঝে ওযূ করে নেওয়া সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন ‘তিন ব্যক্তির কাছে ফেরেশতা আসে না;
কাফের ব্যক্তির লাশ, জাফরান ব্যবহারকারী এবং অপবিত্র ব্যক্তি যতক্ষণ না সে ওযূ করে’।