‘যদি কোন নারী তার ওলীর অনুমতি ছাড়া বিবাহ করে, তবে তার বিবাহ বাতিল,
বাতিল, বাতিল। এইরূপ অবৈধ পন্থায় বিবাহিত নারীর সাথে সহবাস করলে তাকে
মোহর দিতে হবে। কারণ স্বামী মোহরের বিনিময়ে তার লজ্জাস্থানকে ব্যবহার করেছে।
যদি ওলীগণ বিবাদ করেন, তবে যার ওলী নেই তার ওলী দেশের শাসক’।
ছেলে-মেয়েকে লালন-পালনের পাশাপাশি অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব হ’ল যোগ্য
স্থানে বিবাহের ব্যবস্থা করা। অভিভাবক হ’ল প্রাপ্ত বয়স্ক বুদ্ধিসম্পন্ন নিকটাত্মীয়-স্বজন। যেমন- পিতা, দাদা, ভাই, চাচা ইত্যাদি। তবে পিতার উপস্থিতিতে অন্য কেউ ওলী হতে পারবে না। অপর দিক কোন মহিলাও ওলী হতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘কোন
নারী কোন নারীর বিবাহ দিতে পারে না এবং কোন নারী নিজে বিবাহ করতে পারে না।
কোন নারী নিজেই বিবাহ করলে সে ব্যভিচারী বলে গণ্য হবে’। অন্য হাদীছে এসেছে,
রাসূল (ছাঃ) জনৈকা মহিলার অনুমতিবিহীন বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করেন।
(৪) পাত্র-পাত্রীর মধ্যে সমতা : বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার আগে লক্ষ্য করতে হবে পাত্র-
পাত্রীর মধ্যে সমতা আছে কি-না। সম্পদ ও বংশ মর্যাদার সমতা হ’লে ভাল হয়, তবে
যরূরী নয়। কিন্তু দ্বীনের বিষয়ে সমতা থাকা যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘সাধারণতঃ মেয়েদের চারটি গুণ দেখে বিবাহ করা হয়- তার ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং ধর্ম। তোমরা ধার্মিক মেয়েকে অগ্রাধিকার দাও। অন্যথায় তোমাদের উভয়
হস্ত অবশ্যই ধূলায় ধূসরিত হবে’। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা বিবাহের জন্য উপযুক্ত
পাত্রী নির্বাচন কর এবং সমতা দেখে বিবাহ কর’। তবে বিবাহে সমতা হবে কেবল দ্বীনদারী
ও চরিত্রের ক্ষেত্রে। ‘তবে জানা আবশ্যক যে, সমতা হচ্ছে কেবল দ্বীনদারী ও চরিত্রের ক্ষেত্রে’। রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘যার দ্বীনদারী এবং উত্তম আচরণে তোমরা সন্তুষ্ট, তার সাথে বিবাহ দাও’।
(৫) বিবাহের প্রস্তাব :
বর অথবা কনে যে কোন এক পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসতে পারে। এমনকি বর সরাসরি কনেকে অথবা কনে সরাসরি বরকেও প্রস্তাব দিতে পারে। ইবনে ওমর (রাঃ)
হতে বর্ণিত যে, যখন ওমর (রাঃ)-এর কন্যা হাফছাহ (রাঃ) খুনায়স ইবনু হুযাইফা সাহমীর মৃত্যুতে বিধবা হ’লেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একজন ছাহাবী ছিলেন এবং মদীনায় ইন্তেকাল করেন। ওমর (রাঃ) বলেন, আমি ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর কাছে
গেলাম এবং হাফছাহকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে দেখি। তারপর আমি কয়েক রাত অপেক্ষা করলাম। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, আমার কাছে এটা প্রকাশ পেয়েছে যে, এখন আমি
যেন তাকে বিবাহ না করি। ওমর (রাঃ) বলেন, তারপর আমি আবু বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললাম, যদি আপনি চান তাহলে আপনার সঙ্গে ওমরের কন্যা হাফছাহকে বিবাহ দেই। আবূবকর (রাঃ) নীরব থাকলেন, প্রতি-উত্তরে আমাকে কিছুই বললেন না।
এতে আমি ওছমান (রাঃ)-এর চেয়ে অধিক অসন্তুষ্ট হলাম। এরপর আমি কয়েক রাত অপেক্ষা করলাম। তারপর রাসূল (ছাঃ) হাফছাহকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন এবং হাফছাহকে আমি তাঁর সঙ্গে বিবাহ দিলাম’। অন্য এক হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ)
বলেন, একজন মহিলা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এসে বলল
‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার কি আমার প্রয়োজন আছে’?
তবে বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার পূর্বে লক্ষ্য করতে হবে যে
এই মহিলাকে অন্য কেউ বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে কি-না? যদি দিয়ে থাকে তাহলে
নতুন করে প্রস্তাব দেয়া যাবে না। নবী করীম (ছাঃ) এক ভাই (ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে)
দর-দাম করলে অন্যকে দরদাম করতে নিষেধ করেছেন এবং এক মুসলিম ভাইয়ের বিবাহের প্রস্তাবের উপর অন্য ভাইকে প্রস্তাব দিতে নিষেধ করেছেন, যতক্ষণ না প্রথম প্রস্তাবকারী তার প্রস্তাব উঠিয়ে নেয় বা তাকে অনুমতি দেয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যেন তার ভাইয়ের প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব না করে, যতক্ষণ না সে বিবাহ করে অথবা ছেড়ে দেয়’।
যাদেরকে বিবাহ করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে তাদেরকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়া
থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ নিম্নোক্ত মহিলাদেরকে হারাম করেছেন। তিনি
বলেন ‘তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা,
ভাতিজী, ভাগিনী, তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা
যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গুনাহ নেই। তোমাদের ঔরষজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোন একত্রে বিবাহ করা, কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (নিসা ৪/২৩)।
(৬) বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রী দর্শন :
বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে দেখে নেওয়া উচিত। আল্লাহ বলেন ‘তোমরা
বিবাহ কর সেই স্ত্রীলোক, যাদেরকে তোমাদের ভাল লাগে’ (নিসা ৪/৩)।
মুগীরা ইবনে শু‘বা (রাঃ) বলেন, আমি জনৈক নারীকে বিবাহের প্রস্তাব করলাম।
রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, ‘তুমি কি তাকে দেখেছ? আমি বললাম, না। তিনি
বললেন, তাকে দেখে নাও। কেননা এতে তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালবাসা জন্মাবে’।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একজন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল যে,
সে আনছারী একটি মেয়েকে বিবাহ করার ইচ্ছা করেছে। রাসূল (ছাঃ) বললেন
‘তাকে দেখেছ কি? কেননা আনছারদের লোকের চোখে দোষ থাকে’।
পাত্রী দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে পাত্রের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন মিলে ১০/১২
জনের একটি দল পাত্রীর বাড়ীতে যায়। তারা পাত্রীকে সবার সামনে বসিয়ে মাথার
কাপড় সরিয়ে, দাঁত বের করে, হাঁটিয়ে দেখার যে পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত আছে, তা
ইসলাম সম্মত নয়। বিবাহের পূর্বে পাত্র ব্যতীত অন্যদের এভাবে পাত্রী দেখা চোখের
যেনার শামিল। অনেক সময় পাত্র-পাত্রীর ধর্মীয় বিষয়কে না দেখে তার রূপ-লাবণ্য,
বংশ ও সম্পদ দেখেই বিবাহের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম
পাত্রের উচিত রূপ, বংশ ও সম্পদের চেয়ে পাত্রীর দ্বীনদারীকে বেশী গুরুত্ব দেয়া।
পরিপূর্ণ দ্বীনদারী পাওয়া গেলে অন্য গুণ কম হলেও দ্বীনদার মহিলাকেই বিবাহ করা
উচিত, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মেয়েদের চারটি
গুণ বিবেচনা করে বিবাহ করা হয়; তার সম্পদ, তার বংশ মর্যাদা, তার রূপ ও সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী। কিন্তু তুমি দ্বীনদার মহিলাকেই প্রাধান্য দাও। নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন ‘যখন তোমাদের নিকট কোন বর বিবাহের প্রস্তাব দেয়,
যার দ্বীনদারী ও চরিত্রকে পসন্দ কর, তাহ’লে তার সাথে বিবাহ সম্পন্ন কর। অন্যথা
যমীনে বড় বিপদ দেখা দিবে এবং সুদূরপ্রসারী বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে’।
আমাদের সমাজে যেসব কুসংস্কার হয়:
এছাড়া দেখার নাম করে আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ের একসাথে একাকী সময়
কাটানো, পার্কে বসে বসে আলাপ করা, হবু বধুকে নিয়ে নির্জনে চলে যাওয়া ইসলামে
সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘কোন পুরুষ যেন অপর মহিলার সঙ্গে নিভৃতে অবস্থান না করে, কোন স্ত্রীলোক যেন কোন মাহরাম সঙ্গী ছাড়া সফর না করে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন কোন পুরুষ-মহিলা নির্জনে একত্রিত হয়, তখন তৃতীয়জন
হিসাবে সেখানে শয়তান উপস্থিত হয়’।
(৭) সাক্ষী : বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ন্যায়পরায়ণ ঈমানদার দু’জন সাক্ষী থাকবে।
সাক্ষীগণ মহরের পরিমাণ ও বরের স্বীকারোক্তি নিজ কানে শুনবেন। আল্লাহ বলেন
‘যখন তারা ইদ্দতে পৌঁছে যায়, তখন যথাবিধি তাদেরকে রেখে দিবে, নতুবা তাদেরকে যথাবিধি বিচ্ছিন্ন করে দিবে এবং তোমাদের মধ্য হ’তে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে
সাক্ষী রাখবে’ (তালাক্ব ৬৫/২)। সাক্ষীগণ পুরুষই হ’তে হবে। একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা কিংবা চারজন মহিলা হ’লেও চলবে না। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন ‘বিবাহ সংগঠিত হবে না অভিভাবক ও দুজন সাক্ষী ব্যতীত’।
চলবে।