বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল কিভাবে?

পরিকল্পনা করেই আজ থেকে ২২ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল মৌলবাদী হিন্দু সংগঠন। কোবরাপোস্ট
নামে এক বেসরকারি সংস্থার স্টিং অপারেশনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর অযোধ্যার রামজন্মভূমি আন্দোলনের  নামে ষোড়শ
শতাব্দীর বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মৌলবাদী হিন্দু সংগঠন বজরং দল এবং
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছু ধর্মান্ধ সদস্য। এতদিন পর্যন্ত দাবি করা হতো, নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যাওয়া উন্মত্ত জনতা নাকি ধ্বংসের জন্য দায়ী। কিন্তু কোবরাপোস্ট নামে
এক বেসরকারি সংস্থার স্টিং অপারেশনে বদলে গেল ধ্বংসের নেপথ্য কাহিনীটা। বিস্ফোরক এই নেপথ্য কাহিনিটা কী?
রামজন্মভূমি আন্দোলনের গবেষণাধর্মী ইতিহাস রচনার নামে কোবরাপোস্টের অ্যাসোসিয়েটেড এডিটর অযোধ্যা, ফয়জাবাদ, মথুরা, লক্ষ্ণৌ , মোরাদাবাদ, মুম্বাই, গোয়ালিয়রসহ ১১টি জায়গা সফর করে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ২৩জন শীর্ষ
ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের কথোপকথনের গোপন রেকর্ডিং-এর ভিত্তিতে দাবি
করা হয় যে, ‘অপারেশন জন্মভূমি’ নামে বাবরি মসজিদ ভাঙার ছক কষা হয়েছিল
অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে। ধ্বংসকাজ যাতে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হয়,
তার জন্য সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখার ৩৮ জন স্বেচ্ছাসেবককে বেছে নিয়ে তাঁদের ঐ কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। ‘লক্ষণ সেনা’ নামে
ঐ ৩৮ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মী। প্রথম চেষ্টায়
যদি বাবরি মসজিদ ভাঙা না যায়, তাহলে দ্বিতীয় বিকল্প হবে ডিনামাইট ব্যবহার করা।
কথিত এই চক্রান্তের কথা জানতেন লালকৃষ্ণ আদভানি, উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহ বিজেপির কিছু শীর্ষ নেতা। শুধু তাই নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও নাকি পরিকল্পনার কথা টের পেয়েছিলেন, কিন্তু ঠেকাবার কোনো কড়া পদক্ষেপ নেননি এমনও অভিযোগ করা হয়।

উর্দূ সংবাদপত্রের খবর:

এই প্রসঙ্গে এক উর্দু সংবাদপত্রের সম্পাদক মনে করেন, বাবরি মসজিদ এমন
প্রযুক্তিতে তৈরি, যা ধ্বংস করা সাধারণ লোহার রড, শাবল, কোদাল, গাঁইতির দ্বারা
সম্ভব নয়। ব্যবহার করা হয়েছিল কম শক্তির বিস্ফোরক, যার জন্য দরকার হয়েছিল
বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞের। হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম
মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবর শাহ-র আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি
নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের
৬ই ডিসেম্বর তারিখে।

বাবরি মসজিদ এর ইতিহাস:

রামায়ণখ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায়
অবস্থিত। তারই কাছে রামকোট পর্বত। ১৫২৭ সালে সেখানে মোগল সাম্রাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে
মসজিদটির নাম জনমুখে বাবরি মসজিদ। আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর
চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ বলেও পরিচিত ছিল।
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি। তিনি একটি প্রাচীনতর
রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে কথিত আছে। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবার পর মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে সংশ্লিষ্ট বিচারকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল।
আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী’-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির। মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে মসজিদের নীচে মন্দির থাকার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। ভারতের স্বাধীনতা
প্রাপ্তির মাত্র দু’বছর পরেই অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়। তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি
লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, কেননা ‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে ‘। সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার যে সব বিবরণের উপর নির্ভর করে তাদের দাবি পেশ করে থাকে, মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে সেই সব রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার।

অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী ১৮৫৫ সাল অবধি নাকি
হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পুজা করেছে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর মসজিদের সামনাটা ঘিরে দেওয়া হয় এবং হিন্দুরা বহিরাঙ্গণের
একটি ‘চবুতরা’-র উপর তাদের পুজাপাঠ করতে থাকে। ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা ঐ
চবুতরার উপর একটি মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করলে জেলা প্রশাসন তা নিষিদ্ধ করেন।
১৯৩৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মসজিদের চারপাশের প্রাচীর ও একটি গম্বুজ
ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তা পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৯ সালের
২২শে ডিসেম্বর মধ্যরাতে পুলিশ গাডরা নিদ্রিত থাকা অবস্থায় মসজিদে রাম-সীতার
মূর্তি ঢুকিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু যে আন্দোলনে শেষমেষ বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবে,
তা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার
দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকার
ঠিক সেই নির্দেশই দেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস’-এর অনুমতি পায়। ভারতীয় জনতা পার্টির
প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে তাঁর দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রথযাত্রা’ শুরু করেন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে
আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়ার ইত্যাদি নেতারা পুজা প্ল্যাটফর্মে
পৌঁছে একটি প্রতীকী ‘কার সেবা’ করেন। সেদিন দুপুরে এক কিশোর ‘কার সেবক’
একটি গম্বুজে চড়ে যার পরেই মসজিদের বাইরের কর্ডন ভেঙে ফেলা হয়। অতঃপর
বাবরি মসজিদ বিনাশের পথে আর কোনো বাঁধাই থাকে না। এর মাধ্যমে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকাকৃত ইতিহাসে আর একটি কলঙ্কিত অধ্যায় যুক্ত হয়।
লেখক- মাওঃ হাবিবুর রহমান, প্রতিষ্টাতা পরিচালক দারুল উলূম মাদ্রাসাতুল উম্মাহ ফ্রান্স।