বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চ ভাষণের প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ

একটি অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় যে ভাষণ দেন, সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন অনেকেরই প্রায়
মুখস্থ। সে দিন তাঁর ওই ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কোন পরিস্থিতিতে তিনি ওই ভাষণ দিয়েছিলেন,
তা না জানলে বর্তমান প্রজন্মের মানুষের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্র, তার শাসকশ্রেণির চরিত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটি পরিষ্কার হবে না।

বঙ্গবন্ধু-র ভাষণের প্রেক্ষাপট:

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের মধ্যে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। সেই নির্বাচনে
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে ১৬৯টি আসনের মধ্যে
১৬৭টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ছিল ৩০০ আসনবিশিষ্ট।  ওই নির্বাচন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি জনগণের রায়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব
করতে শুরু করে। এদিকে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতিতে অবিচল থাকেন। ৩ জানুয়ারি ১৯৭১, তিনি তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা
এবং জনগণের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ পাঠ করান। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া
খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি হিসেবে
১মার্চ আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হচ্ছিল পূর্বাণী হোটেলে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে রেডিওতে ঘোষণা হয় যে, প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের ১লা মার্চের  এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেছেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এবং ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে দলমত-নির্বিশেষে জনগণ রাজপথে
নেমে পড়ে। তাদের কণ্ঠে স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা—ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়।
তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হরতাল পরবর্তি এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা দেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায়
ভাষণ দেবেন। এই পটভূমিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান
পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক
ভাষণটি প্রদান করেন।

১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর
ওপর দেশের মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু তারা আশা করছিল না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণের গুরুত্ব:

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের আপোসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ
মানুষ জীবন উৎসর্গ করে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজীরবিহীন। শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ
দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে ¯পষ্ট দিকনির্দেশনা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি। সময়ের পরিসীমায় আবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। এ ভাষণের কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস, যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও চতুর্দিকে অনুরণিত। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে
তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল তাই, যা লিখিত ছিল না। এটি আকারে
ছিল নাতিদীর্ঘ।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় স্তরে ভাষণ ও বক্তব্য প্রদান করা হয়। তবে সকল ভাষণ বা বক্তব্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এক
রকম হয় না। যে ভাষণে জাতি দিক নির্দেশনা পায়, জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়, এমনকি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে বিজয়ের পতাকা ছিনিয়ে আনতে পারে বিশ্বের মানচিত্রে; এমন ধরনের ভাষণ ব্যতিক্রমী
ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে
দেয়া ভাষণ অনন্য। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ, সম্মোহনী, তেজস্বিতা, বাগ্মীতা, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, সুদুরপ্রসারী চিন্তা, পরিবেশ
পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয়তার নিরিখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় এ ভাষণ ছিল ব্যতিক্রমী।
এ ভাষণ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আবাল বৃদ্ধ বণিতাকে এক পতাকাতলে সমবেত করে। এ ভাষণ ছিল মূলত বাঙালি
জাতির মুক্তির সনদ।

ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু:

স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের এই দীর্ঘ পথে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনা
জাতিকে কাঙ্কিত লক্ষ্যে পৌছে দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান তৎকালীণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল৩.২০ মিনিটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তাঁর অনন্য বাগ্মিতা
ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আবেগ ও স্বপ্নকে একসূত্রে গেঁথে
বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত
স্বাধীনতার ডাক। ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি
জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। সঙ্গত কারণে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
কারণ ৭ই মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। সম্ভবত পৃথিবীতে অন্য কোন ভাষণ এতবার
উচ্চারিত হয়নি। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ঐ ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিল সে সময়
বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস
ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী এক মহাকাব্য। এ ভাষণে তাঁর তেজস্বিতা ও সম্মোহনী ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণ মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, এক মহামূল্যবান দলিল। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম,
জাতিভেদ-বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ
নাগরিক থেকে শুরু করে সবার জন্যই এ ভাষণে অনেক কিছু শিক্ষণীয়।

বক্তৃতা নয়, যেন জনসমুদ্রের সঙ্গে সংলাপ করছেন বঙ্গবন্ধু:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চ ভাষণের প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুসারী ও শ্রোতাদের বোধগম্য ভাষাতেই পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতির পটভূমি তুলে ধরেছেন।
সরকারি বাহিনীর হাতে মানুষ মারা যাচ্ছিল প্রতিদিন। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধু
বলেন, ‘২৫ তারিখ অ্যাসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমরা যখন মরতে শিখেছি,
তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না।’

তাঁর ঘোরতর প্রতিপক্ষ ও শত্রুকেও সৌজন্য রক্ষা করে সম্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব,
জনাব ভুট্টো সাহেব। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান এবং জাতীয় পরিষদে যোগদানের এমন চারটি শর্ত ঘোষণা করেন যা
কারও পক্ষে অযৌক্তিক বলা সম্ভব ছিল না। সে জন্য পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার
অর্জনের পথ খোলা রাখেন। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তা হতো বাঙালির জন্য চরম আত্মঘাতী। তাঁকে আখ্যায়িত
করা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে। তিনি জনগণনন্দিত গণতান্ত্রিক নেতা থাকতেন না। ৭মার্চের পরও তিনি ইয়াহিয়া,
ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। তাঁরা চেয়েছেন অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে। কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালিকে
সশস্ত্র পশুশক্তি নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়ায় বিশ্বজনমত বাঙালির পাশে দাঁড়ায়।

আট কোটি বাঙালি ওই মুহূর্তে তাদের অন্তরে যে আবেগ ও স্বপ্ন ধারণ করছিল, তারই প্রকাশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষ
বাক্যে। মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।