বইমেলা বা অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস ও প্রয়োজনীয়তা

‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’  আমাদের প্রানের মেলা। যা সর্বসাধারণের কাছে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত। স্বাধীন
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। যে মেলা
বইপ্রেমী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণে দোলা দেয়। ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় বইটি হাতে পাওয়ার পর আনন্দে চিক চিক করে
ওঠে মুখ। এসবই আমাদের কাছে খুব চেনা এবং জানা একটি বিষয়। কিন্তু আমরা অনেকেই এই মেলার ইতিহাস জানি না।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে
অম্লান রাখতেই এই মাসে আয়োজিত এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। ২০২০ সাল পর্যন্ত সার্বজনিন বাঙালির অন্যতম প্রধান এই সাংস্কৃতিক আয়োজনটির দাপ্তরিক
বা অফিসিয়াল নাম লেখা হতো ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ২১ সাল থেকে এই মেলার দাপ্তরিক নাম লেখা হচ্ছে ‘অমর একুশে বইমেলা’।

একুশে বইমেলা- শুধু বইয়ের মেলা নয়, এ মেলা ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোরও এক উপলক্ষ।
যে কারণে, বাংলাদেশে হাজারো মেলার মাঝে প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত
এই বইমেলার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে মূলত এ মেলাকে কেন্দ্র
করে। বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি বোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলার ভিত্তি। লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের কাছে
অমর একুশে বইমেলা এক সেরা উৎসব। আর এ কারণেই আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই মিলন মেলা এই গ্রন্থমেলা সকলের
কাছে পরিচিত একুশে বইমেলা নামে। এদেশের সকল শ্রেনীর পাঠক এই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র জন্য সারা বছর অপেক্ষা
করে থাকে।

 

বইমেলা-র ইতিহাস:

বইমেলার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা। বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক,
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে
তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। সরদার জয়েনউদদীন যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা
একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল ‘Wonderful World of Books’। এই বইটি পড়তে গিয়ে
তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো : ‘Book’ এবং ‘Fair’, কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন।

বইটি পড়ার পরেই তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার
পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তাঁর মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন?
এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলাই করা যায়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। সরদার একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই
করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায়, যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিত। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে।

শিশু গ্রন্থমেলা করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। আরও বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার তিনি
সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়।
এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন
প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এই মেলায় সরদার একটি
মজার কাণ্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকেরাও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও।

মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। সরদার জয়েনউদদীন সাহেবের
এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলে জানান বাংলা একাডেমির একসময়কার মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

বইমেলা এর আমেজ

বাংলা একাডেমিতে বইমেলা-র সূচনা:

এখানেই সরদার জয়েনউদদীন থেমে থাকেননি। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই
বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে
১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক
টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন
সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে
অবস্থানকারী বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রায় একাই বইমেলা চালিয়ে যান। তবে ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী মহান একুশে
মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ ছাড়ে বা হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির
ব্যবস্থা করে।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন
করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ঐ গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে
বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমি তার প্রাঙ্গণের খোলা জায়গা ব্যবহার করতে দিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

 

বইমেলা থেকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’:

১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। সেই চিহ্নিত স্থানে প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্যরা অণুপ্রাণিত হন। এ সময়
পর্যন্ত এই আয়োজনের কোন স্বীকৃতি ছিল না। কোন নামও দেয়া হয়নি।  ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে
যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ঐ সময় অমর
একুশে উপলক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। মেলার তখন নাম ছিল ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮১ সালের একুশে বইমেলার মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২
সালে মেলার মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করে করা হয় ২১ দিন। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর
সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির সরাসরি তত্বাবধানে সাড়ম্বরে বর্তমানের
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এই মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমী চত্বরে
স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে নতুন রূপ পায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আর তখন থেকেই পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অমর একুশে স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি
ও স্বাধীনতার স্মৃতিধন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে এই মেলা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

 

বইমেলা এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:

প্রতিটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগৎ বা লাইব্রেরি। একই সাথে দেশের সকল মেধার
সংগ্রহশালাও হচ্ছে এই লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে।
এতে এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার চলে আসে সকলের হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবনিতা এই বিশাল জ্ঞান-সমুদের সাথে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ পায়।

জতিগতভাবে বাঙ্গালি আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষনের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দূর্লভ বই হাতের
নাগালে পাওয়া যায় অন্য সময়ে তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। বাঙ্গালিকে বইমুখী করে তোলার জন্য কিছু কালজয়ী সাহিত্যিকদের সঙ্গে বইমেলার রয়েছে এক অনবদ্য অবদান। সব বয়সের মানুষের জন্য বইমেলায় থাকে উপযুক্ত বইয়ের
পর্যাপ্ত সংগ্রহ। শিশুরা পরিচিত হতে পারে নতুন নতুন বইয়ের সাথে। বয়সীরাও খুঁজে পান তাদের মনের খোরাকসমৃদ্ধ বইটি।

বইমেলা বর্তমানে লেখক-লেখিকাগণের বই এর মোড়ক উন্মোচনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যিকরা স্বতস্ফূর্তভাবে
মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সাথে দেখা-সাক্ষাতে একজন পাঠক পান পাঠের নতুন প্রেরণা। লেখকের অটোগ্রাফসমেত
বই কিনে পাঠক তার পাঠের ও বই কেনার চাহিদকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও পাঠকের সারা বছরের
পাঠাভ্যাসকে একটু ঝালিয়ে নিতে বইমেলার রয়েছে এক আশ্চর্য ভূমিকা। লেখক-পাঠকের এ মহা মিলন-মেলার উষ্ণতায়
চঞ্চল হয়ে ওঠে নবপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত একজন পাঠকের মন-প্রাণ।