ফেরেশতা শব্দের তাহকীক
ইসলামের পরিভাষায় ফেরেশতা এমন ‘নুরানি’ (আলোকিত) সৃষ্টির নাম, যারা যেকোনো সময় বিভিন্ন রূপ-আকৃতি ধারণ
করতে পারেন। তারা কখনো আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন না। বরং সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ আত্মসমর্পিত থাকেন। (কাওয়াইদুল ফিকহ, সাইয়েদ মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান, পৃষ্ঠা ৫০৪)
ফেরেশতা আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলার নুর বা ঐশী জ্যোতি থেকে তাদের সৃষ্টি করেছেন। তারা আল্লাহর
অতি সম্মানিত ও পুণ্যবান সৃষ্টি। তারা সবসময় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন। পানাহার, বৈবাহিক ও জৈবিক চাহিদা থেকে
তারা পুরোপুরি মুক্ত থাকেন। তারা পুরুষও নন, নারীও নন। ফেরেশতাগণ অদৃশ্য জগতের অংশ। আমরা তাদের বিজ্ঞান
দিয়ে প্রমাণ করতে পারব না। আমরা তাদের পরিমাপ করতে পারব না আকার আকৃতিতে ও সংখ্যায়। তাদের সংখ্যা মোট
কত, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। মানুষের মতো রক্ত-মাংসের সৃষ্টি না হওয়ায়, তাদের কামনা-বাসনা, পানাহারের প্রয়োজনীয়তা ও ঘুম-বিশ্রাম কিছুই নেই। এটা এমন বিষয় যাতে আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এই বিশ্বাসের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন, আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করি কিনা।
ফেরেশতা গণের প্রতি ঈমান:
ফেরেশতাদের অস্তিত্ব বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ তালার ইরশাদ, ‘কেউ আল্লাহ, তার ফেরেশতা, তার কিতাবসমূহ, তার রাসুলগণ ও পরকালে বিশ্বাস না করলে সে তো মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে। ’ (সুরা নিসা,
আয়াত : ১৩৬)
ফেরেশতাদের সম্মানের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘(এ কোরআন) মহান, পূত-পবিত্র লিপিকরের
(ফেরেশতার) হাতে লিপিবদ্ধ। ’ (সুরা আবাসা, আয়াত : ১৫-১৬)
ফেরেশতা সৃষ্টির ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, আল্লাহর নুর বা ঐশী আলো থেকে। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং : ২৯৯৬)
মালাইকা বা ফেরেশতা সম্পর্কে যত জ্ঞান, সবটাই আসে আমাদের জ্ঞানের মূল উৎস থেকে, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। কেবল নিজস্ব চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারব না। আমরা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ
থেকে জানতে পারি, ফেরেশতারা হলেন মহান আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট একটি ভিন্ন প্রজাতি, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে।
নবীজি সা. বলেন, ‘‘মালাইকা বা ফেরেশতদের সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে। জ্বিন সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। আর
মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে কাদামাটির মিশ্রণ থেকে।” অতএব, নূর (আলো) হল ফেরেশতা সৃষ্টির উপাদান। আগুন হল জ্বিন
সৃষ্টির উপাদান। আর আমরা (মানবজাতি) সৃষ্টি হয়েছি কাদামাটি থেকে।
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম (নিসা ১৩৬; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২)। এটি বাদ
দিলে মুমিন ঈমানের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। বস্ত্ততঃ ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস আমাদের আত্মিক জগতকে নিয়ন্ত্রিত রাখে এবং এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা ও তাঁর মহান কুদরত সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। যা তার মধ্যে পরকালীন জবাবদিহিতা সৃষ্টি করে।
ফেরেশতা গণের রূপ-বৈশিষ্ট্য:
ফেরেশতাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, ফেরেশতারা খুবই পবিত্র, ত্রুটিহীন ও আশ্চর্যজনক। তারা কখনোই মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না। তাদের অমান্য করার সামর্থ্যও নেই। তারা অবিরত মহান আল্লাহর অনুগত থাকে, আল্লাহর
ইবাদতে মগ্ন থাকে, “তারা দিন রাত ব্যাপী মহান আল্লাহর তাসবীহে রত থাকে, তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে না”। (সূরা আম্বিয়া, ২০)
তারা অবিরতভাবে তাসবীহ পাঠ করছে। কোনো খাওয়া দাওয়া নেই, পান করা নেই, ঘুম নেই। তারা কখনোই ক্লান্ত হয় না। এভাবেই আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের ডানা রয়েছে। অনায়াসে তারা যেখানে-সেখানে বিচরণ করতে
পারেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘সব প্রশংসা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহর, যিনি ফেরেশতাদের বার্তাবাহক করেন,
যারা দুই দুই, তিন তিন বা চার চার পক্ষবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা
ফাতির, আয়াত : ০১)
ফেরেশতারা অত্যন্ত সুন্দর আকৃতির অধিকারী। মহান আল্লাহ হজরত জিবরাঈল (আ.) সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘তাকে (হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়েছে শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাবান এমন একজন (ফেরেশতা), যে নিজে (সুন্দর আকৃতিতে) স্থির ছিল। ’
(সুরা নাজম, আয়াত : ৫-৬) সাধারণ ভাবে বললে, ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি। তারা অতি সুদর্শন। কেবল শাস্তিদানের ফেরেশতারা দেখতে ভয়ংকর রকমের। অন্যথায়, তারা সাধারণভাবেই অতি সুদর্শন। ফেরেশতাদের রূপ ও
সৌন্দর্য উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই হজরত ইউসুফ (আ.)-কে দেখে নারীরা বলেছিল, ‘অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য!
এ তো মানুষ নয়, এ তো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৩১)
ফেরেশতা দায়িত্ব পালনে তাদের ক্লান্তি ও অবাধ্যতা নেই:
সৃষ্টিগতভাবে ফেরেশতাদের আল্লাহর অবাধ্যতার শক্তি দেওয়া হয়নি। সর্বদা তারা আল্লাহর হুকুম পালন করেন। মহান
আল্লাহ বলেন, ‘তারা (ফেরেশতারা) তা অমান্য করে না, যা আল্লাহ তাদের আদেশ করেন। তারা যা করতে আদিষ্ট হয়,
তাই করে। ’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬) নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে কোনো ক্লান্তি-শ্রান্তি ও অবসাদ ফেরেশতাদের আসে না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা তোমার প্রতিপালকের সামনে আছে, তারা তো দিন ও রাতে তার পবিত্রতা ও মহিমা
ঘোষণা করে। তারা ক্লান্তি বোধ করে না। ’ (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত : ৩৮)
তারা খুবই শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকেন:
ফেরেশতারা খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। তাদের শৃঙ্খলা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘(কিয়ামতের দিন) তোমার প্রতিপালক উপস্থিত
হবেন। সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতারাও (উপস্থিত হবেন)। ’ (সুরা : ফাজর, আয়াত : ২২)
জিবরিল ফেরেশতা ও অন্যান্যদের রয়েছে বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য:
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত করে রেখেছেন। কোরআন ও হাদিসে তাঁদের কাজের কিছু কিছু
বর্ণনাও পাওয়া যায়। এর বাইরেও আল্লাহর অসংখ্য ফেরেশতা এমন আছেন, যাঁদের সংখ্যা ও কাজ মহান আল্লাহ ছাড়া
আর কেউ জানে না। নিম্নে ফেরেশতাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শ্রেণি ও তাঁদের কাজগুলো উল্লেখ করা হলো—
যা তার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং যা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৯৭)২) মিকাইল (আ.) : তাঁর কাজ হলো বৃষ্টি বর্ষণ ও উদ্ভিদ উৎপাদন। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লেখেন, ‘মিকাইল
আল্লাহর নৈকট্যশীল ও মর্যাদাবান ফেরেশতাদের একজন। তিনি বৃষ্টি ও উদ্ভিদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।’ (আল বিদায়া
ওয়ান-নিহায়া : ১/১০৫)
৩) ইসরাফিল (আ.): আল্লাহ তাঁকে সিঙ্গার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লেখেন, ‘ইসরাফিলকে
সিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কবর থেকে ওঠা এবং হাশরের মাঠে পুনরুত্থানের জন্য সিঙ্গায় ফুঁ
দেবেন।’ (আল বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১/১০৬)
৪) আজরাইল (আ.) : আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুর ফেরেশতা হিসেবে মনোনীত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, তোমাদের
জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমার প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছেই প্রত্যানীত হবে।’ (সুরা : সাজদা, আয়াত : ১১)
হেফাজতকারী বা রক্ষাকারী ফেরেশতা:
৫) রক্ষাকারী ফেরেশতা: আল্লাহর একদল ফেরেশতা সর্বাবস্থায় বান্দাদের রক্ষা করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১১)
৬) ভাগ্য লেখে যারা: মাতৃগর্ভে সন্তান মাংসপিণ্ডে পরিণত হওয়ার পর একজন ফেরেশতা তার ভাগ্য লেখেন। রাসুলুল্লাহ
(সা.) বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। আর তাঁকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। তাঁকে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়, তার আমল, জীবিকা, আয়ু এবং সে কি পাপী হবে, না নেককার হবে তা। অতঃপর তার মধ্যে আত্মা ফুঁকে
দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২০৮)
৭) কিরামুন-কাতিবুন: তাঁরা হলেন এমন একদল ফেরেশতা, যাঁরা মানুষের ভালো-মন্দ কাজ লিপিবদ্ধ করেন। পবিত্র
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি মনে করে যে আমি তাদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না। অবশ্যই রাখি।
আমার ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৮০)
৮) আরশ বহনকারী: আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী একদল ফেরেশতা আল্লাহর আরশ বহন করে আছেন। ইরশাদ হয়েছে,
‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশ ঘিরে আছে।’ (সুরা : মুমিন, আয়াত : ৭)
৯) মুনকার-নাকির : মানুষকে কবরে রাখার পর মুনকার-নাকির নামে দুজন ফেরেশতা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগমন
করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মৃত লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন কালো বর্ণের নীল
চোখবিশিষ্ট দুজন ফেরেশতা আসেন তার কাছে। তাঁদের একজনকে মুনকার ও অন্যজনকে নাকির বলা হয়।’ (সুনানে
তিরমিজি, হাদিস : ১০৭১)
১০) জান্নাতের রক্ষী : জান্নাতের দায়িত্বশীল ফেরেশতারা জান্নাতিদের স্বাগত জানাবেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর জান্নাতের
রক্ষীরা তাদের বলবে, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করো স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য।’ (সুরা :
ঝুমার, আয়াত : ৭৩)