প্রযুক্তি ব্যবহার সমকালীন বিশ্বে ইসলাম প্রচারের কৌশল।

নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজনে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমন ও
প্রস্থানে বহু নিদর্শন আছে ঐসব বুদ্ধিমানের জন্য যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায়
আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং
তা লক্ষ্য করে বলে ওঠে) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে
সৃষ্টি করেননি। আপনি অনর্থক কাজ থেকে পবিত্র (আলে ইমরান ৩/১৯০-১৯১)

শেষ নবী মুহাম্মাদ  সা. সহ সকল নবীকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন
দীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য। তাঁরা আমৃত্যু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সমবেত সাহাবাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি কি (দীনের দাওয়াত) পৌঁছিয়েছি?’ সাহাবাগণ প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছেন।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তর্জনি  উঁচু করে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন।’ অতঃপর তিনি সমবেতদের
উদ্দেশে বলেন, ‘উপস্থিতরা যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়। কেননা, যাদের
কাছে পৌঁছানো হবে তাদের মধ্যে অনেক ব্যক্তি এমন থাকে, যারা শ্রবণকারীর
চেয়ে অধিক সংরক্ষণকারী।’ তখন থেকে এখন পর্যন্ত দাওয়াতের ধারা চলমান আছে, কিয়ামত অবধি চলমান থাকবে ইন-শা-আল্লাহ। প্রত্যেক যুগের দা‘য়ীরা সে যুগের ভাষা, ভঙ্গি, কৌশল, পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে দাওয়াতের কাজ করেছেন।
এটাই দাওয়াতের নিয়ম। এভাবেই ইসলাম আরব ভূখণ্ড থেকে দিকে দিকে ছড়িয়ে
পড়েছে। ইসলামের আলোয় আলোকিত করে চলেছে জনপদের পর জনপদ।
কিয়ামতের আগে এভাবেই ইসলাম প্রতিটি জনপদে পৌঁছে যাবে।

প্রত্যেক যুগে ততকালীন প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে

সময়ের ভাষা আয়ত্ব করে আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে দাওয়াতের
কাজ করলে এ যুগেও ইসলামের দাওয়াত ফলপ্রসূ হবে ইন-শা-আল্লাহ। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি বিবেচনায় দাওয়াতের মাধ্যম, পদ্ধতি ও কৌশল কী হতে পারে, এটাই
বক্ষমান নিবন্ধের প্রতিপাদ্য। এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তি পৃথিবীকে
মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে; এর
মাধ্যমে মানবজীবনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এটি অনিবার্য এক বাস্তবতা। এই
বাস্তবতা স্বীকার করে এর সফল ও কার্যকর ব্যবহার করে দাওয়াতের কাজ করলে
অনেক সফলতা আসবে ইন-শা-আল্লাহ। এটিকে অস্বীকার করলে অথবা অবজ্ঞা
করলে দাওয়াতি কাজ অনেকখানিই পিছিয়ে যাবে।
বস্তুত দুনিয়ার নবআবিষ্কৃত সব প্রযুক্তিই আল্লাহর সৃষ্টি থেকে সৃষ্ট। কারণ মৌলিক পদার্থ
সব আল্লাহর দান। আল্লাহর সৃষ্ট পদার্থসমূহের পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমে মানুষ
নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন আসমান-যমীন, আগুন-পানি, মাটি, বাতাস ইত্যাদি ছাড়াও লাখ লাখ মাখলূক। দুনিয়াতে যা কিছু আমরা মানুষের আবিষ্কার বলে মনে করি সেগুলিও মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্টি। কারণ তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। তিনি ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই কালের স্রষ্টা, কালের সব নবাবিষ্কারও তাঁরই সৃষ্টির সহায়তায় সৃষ্ট। আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু’ (বাক্বারাহ ২/২৯)। সুতরাং বর্তমান
বিশ্বে যত সব আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবই মহান আল্লাহর সৃষ্টিকে কেন্দ্র করেই
সৃষ্ট। উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন
যে, মানুষ জগতের যা কিছু দ্বারা উপকার লাভ করে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার দান।
এর প্রত্যেকটি জিনিস আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের নিদর্শন।

প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্বই এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তের মাঝে এক দেশের খবর চলে আসে অন্য দেশে। হাযার হাযার মাইল দূরে অবস্থানরত মানুষের সাথে কথা বলা যায় অনায়াসে। পৃথিবীর এই তাবৎ আবিষ্কার, প্রযুক্তির এই সব উন্নয়ন সবই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত। যার শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য আবশ্যক।

প্রত্যেক যুগে তৎকালীন প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে

এমন কোন প্রযুক্তি পণ্য বা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নেই, যেটা ইসলামের খেদমতেব্যবহারযোগ্য নয়। তবে  প্রতিটি প্রযুক্তিকে  ভালো কাজেও ব্যবহার করা যায়, আবার মন্দ কাজেও ব্যবহার করা যায়। দোষ কিন্তু  প্রযুক্তির নয়। বরং এখানে ব্যবহারকারী মূলতঃ দায়ী। যেমন টেলিভিশনের মাধ্যমে মন্দ ছবিও দেখ যায়, আবার সারাদিন ইসলামিক অনুষ্ঠানও দেখা যায়। লক্ষণীয় যে, প্রযুক্তিকে আমরা কোন কাজে ব্যবহার করছি সেটাই বিবেচ্য বিষয়। আমরা যদি প্রযুক্তিকে ইসলাম প্রচারের কাজে লাগাই তাহ’লে সব ধরনের প্রযুক্তিই কল্যাণের মাধ্যম হবে। আর যদি এই কথা বলে পিছিয়ে থাকি যে, এগুলো ব্যবহার করা হারাম। তাহ’লে এগুলোর সুফল থেকে জাতি বঞ্চিত হবে।সব নবী-রাসূলই তাদের যামানায় তৎকালীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছেনএবং নিজস্ব ধর্মের প্রচার-প্রসার করেছেন। তাঁরা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করেছেন। আমরাও যদি প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করি তাহ’লে তা  হবে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর।

যে জাতি যত বেশি শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, সে জাতি তত বেশি বৈষয়িকভাবে উন্নত। ইসলাম মানুষের জন্য যে কোনো কল্যাণকর প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার অনুমোদন করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি যখন আয়াত নাযিল হয় ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করুন’, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে বিভিন্ন গোত্রের নাম ধরে ধরে তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দেন এবং কুফরের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। পহাড়ের উপর আরোহণের কারণ, এতে আওয়াজ বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দাওয়াত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য বৈধ মাধ্যম গ্রহণ করা অনুমোদিত, বরং সুন্নাতে নববী
দ্বারা নির্দেশিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধ্যমত সে যুগের মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। এখন
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এ যুগে দাওয়াতের কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সুন্নাহ বলে বিবেচিত হবে। আমরা যারা দাওয়াতি কাজে নিয়োযিত আছি, তারা এর ইতিবাচক কল্যাণকর ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে এবং উম্মাহকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারি; বরং তা-ই করা উচিত। কেননা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম সময়ে
বেশি মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব।