বিদ্রোহের আগের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের
উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল রাইফেলস সপ্তাহের তিন দিনের বর্ণিল
আয়োজন। কিন্তু তার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিয়ার জওয়ানদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পিলখানার চার দেয়ালের ভেতরের নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ বুঝতে সময় লেগে যায় আরও দুইদিন। বাহির থেকে
কেউ কল্পনাও করতে পারেনি ভিতরে চলছিলো কি। পরদিন রাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় ৩৬ ঘণ্টার বিদ্রোহের
অবসান ঘটলে পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ। ২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের।
সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। উদ্ধার করা হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।
পিলখানা ট্রাজেডি: যেভাবে শুরু হয় :
যথারীতি ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বার্ষিক দরবার বসে পিলখানায় দরবার হলে। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআরের
বিপুলসংখ্যক সদস্যে তখন দরবার হল পরিপূর্ণ। হলের মঞ্চে ছিলেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা
পদের সদস্যরা। জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন-বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে ছিলো অসন্তোষ। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওইদিন দরবারে
উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।
দরবার শুরুর পর বক্তব্য দিচ্ছিলেন মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের
বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিত মঞ্চে প্রবেশ করেন। মহাপরিচালকের সামনে নানা দাবি নিয়ে তারা
শুরু করে চিৎকার-চেঁচামেচি। ডিজির সামনে বন্দুকের নল তাক্ করে সিপাহি মঈন। এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ
বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে এ ঘাতক গুলি চালাতে না
পারলেও অপর জওয়ানরা শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলি। মহাপরিচালক শাকিল সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে
প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। এরপরই সিপাহী সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র
অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে সব পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভেতরে শুরু হয় গোলাগুলি। প্রায় তিন হাজার
সৈনিক মুহূর্তের মধ্যে যে যেভাবে পারে কেউ জানালা দিয়ে, কেউ দরজা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যান।
পিলখানা ট্রাজেডি: সেদিন যা ঘটেছিল:
ডিজি, ডিডিজি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ ৪৫-৫০ জন দরবার হলে অবস্থান করে আলোচনা করতে থাকেন। দরবার হলের
বাইরে থেকেও গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ
বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন।
দরবার হলের মঞ্চের পর্দার আড়ালে উত্তর দিকে ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। বিদ্রোহীরা হ্যান্ডমাইকে বলছিলো, ‘ভেতরে কেউ থাকলে বের হয়ে আসেন। ’ মুখে কাপড় বাঁধা একজন সৈনিক অস্ত্রহাতে পর্দা সরিয়ে মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে
বলে, ‘ভেতরে কেউ আছেন? সবাই বের হন। ’ একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে দুটি গুলি করেন তিনি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে
কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। চলে নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর
অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। তারা অস্ত্রাগারটিও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। একের পর এক গোলাবারুদ আর গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পিলখানাকে। নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে বিপথগামী বিদ্রোহীরা। মুহূর্তের
মধ্যেই দেশের অন্যান্য বিডিআর ব্যাটালিয়নেও ছড়িয়ে পড়ে সেই বিদ্রোহ।
পিলখানা ট্রাজেডি সামলাতে প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতা:
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনা সদস্যরা ভারী অস্ত্র এবং সাঁজোয়া যান নিয়ে এসে সকাল ১১টার
দিকে ধানমণ্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি
গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে
গুলি ছুড়তে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা। তারা মাইকে জানান, আলোচনার
জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে। এ অবস্তায় বড় ধরনের রক্তপাতের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজধানীতে। দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদাপতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান জাহাঙ্গীর
কবির নানক ও মির্জা আজম।
বিদ্রোহ শুরুর পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী তার বাসভবনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ ও বিদ্রোহী
বিডিআর সদস্যদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। মাঠপর্যায়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা বৈঠক চলতে
থাকে ধানমণ্ডির আম্বালা ইন-এ। বিদ্রোহ দমনে নানাভাবে দফায় দফায় বৈঠক করেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, পরিস্থিতি সামাল দিতে চালিয়ে যান প্রাণপণ চেষ্টা।
ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ঐ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং
অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দেন। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ
মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।
যেভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয় পিলখানা ট্রাজেডি:
২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের
অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। অস্ত্র সমর্পণের
পর সিভিল পোশাকে পালিয়ে যান অধিকাংশ বিদ্রোহী। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তারা অস্ত্র
এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান
হয় ৩৬ ঘণ্টার বিদ্রোহের। ২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। তবে এ ঘটনায় প্রাণ হারান
৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। দীর্ঘ ১৪ বছরেও ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা।
জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নিহত সেনা সদস্যদের স্মরণ করা হয়। ‘শহীদ পরিবারবর্গ’
এবং ‘দেশ উই আর কনসার্নড’ নামক সংগঠন যৌথভাবে এ আয়োজন করে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি এবং প্রশ্ন
কেন এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড, নিহত সেনা সদস্যদের কী অপরাধ ছিল? কারাইবা এই নৃশংসতার পরকিল্পনা করেছিল?
‘সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অধীনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হলে এই হত্যাকান্ডের মূল
রহস্য হয়তো উন্মোচন হতো।’ নিহত সেনাদের স্মরণে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ এবং দিনটিকে সরকারি ছুটির
দিন ঘোষণা করার দাবি জানান।