পিতা-মাতা এর উপর সন্তানের অধিকার (তৃতীয় পর্ব)

৭. বাবা-মা আদব-কায়দা শিক্ষা দিবেন :
আজকের শিশু আগামী দিনে সুস্থ পরিবার, সুন্দর সমাজ ও জাতি গঠনের মৌলিক স্তম্ভ। শিশুর মন অত্যন্ত কোমল। এ
সময় তাকে সুশিক্ষা দিলে ভবিষ্যত জীবনে তা তার পাথেয় হিসাবে কাজ করবে। সেজন্য তার চরিত্র, মন-মানসিকতা, মানবিক
ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ইসলামের উন্নততর আদর্শ ও নীতিমালার রং-রূপ-গন্ধে ভরে দেয়া পিতার অবশ্য করণীয়। সততা, পরোপকারিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, দানশীলতা, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ ইত্যাদি সৎগুণাবলী শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে। অপরপক্ষে অহংকার, মিথ্যা, ধোঁকাবাজী, গীবত, চোগলখোরী, মূর্খতা, উদাসীনতা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, কারো প্রতি হিংসা
বিদ্বেষ পোষণ করা ইত্যাদির প্রতি তাদের হৃদয়ে ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে।

পিতা-মাতা শিশুর আচার-আচরণের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, যেন সে বিকৃত স্বভাব, অপসংস্কৃতি ও কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী
হয়ে বিপথে পরিচালিত না হয়। বৃহত্তর বিশ্বের চলমান চাকা তলে পিষ্ট হয়ে তার ব্যক্তিত্ব যেন গোড়াতেই বিধ্বস্ত না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।

 

৮. ইসলামের অনুশাসনে জ্ঞান দান ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত করা :

প্রতিটি শিশু ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতা সহ জন্মগ্রহণ করে। সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হবার যোগ্যতা প্রতিটি
শিশুর মধ্যেই বিদ্যমান আছে; যদি পিতা এ ব্যাপারে যত্নবান হন এবং পরিবেশ অনুকূলে থাকে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র,
আসমান-যমীন সব কিছুতেই আল্লাহর অস্তিত্ব বিদ্যমান এ ধারণাটি শিশুদের মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনা, অতঃপর রাসূল, ফেরেশতা, কুরআন মাজীদ সহ অন্যান্য ইলাহী গ্রন্থ সমূহ,
কবর, হাশর-নশর, আখেরাত ইত্যাদির উপর ঈমান আনয়নের ব্যাপারে শিক্ষা দিতে হবে। পিতা-মাতা শিশুকে লোকমান
(আঃ)-এর ছেলেকে প্রদত্ত নছীহতের অনুসরণে উপদেশ প্রদান করবেন এবং তা যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য উৎসাহ
প্রদান করবেন। লোকমান স্বীয় সন্তানকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক কর না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে
বড় যুলুম’। ‘হে বৎস! কোন বস্তত যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা
ভুগর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত। ‘হে বৎস! ছালাত প্রতিষ্ঠা করবে।
সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করবে। এটাই দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহংকারবশতঃ তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করবে না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করবে না। কারণ আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পসন্দ করেন না। তুমি চলাফেরা করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করবে। নিশ্চয়ই গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর’ (লোকমান ৩১/১৬-১৯)। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একজন শিশুকে আদর্শ মানুষের মূর্তপ্রতীক
হিসাবে বিশ্বদরবারে পেশ করার জন্য লোকমান (আঃ)-এর উপদেশ ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসাবে গৃহীত। এই মডেল তৈরী করার
জন্য পিতাকে যত্নবান হওয়া অবশ্যই দরকার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বৎসর
বয়সে ছালাত আদায়ের জন্য আদেশ করবে এবং দশ বৎসর বয়সে ছালাত আদায় না করলে প্রহার করবে, আর তাদের
শয্যা পৃথক করে দিবে’।

৯. পিতা-মাতা সকল সন্তানের মধ্যে সমতা বিধান করা :

পুত্র-কন্যা পিতার নিকট সবাই সমান। তাই সন্তানের মধ্যে আচরণে সমতা বিধান করে পিতাকে অবশ্যই চলতে হবে। সাম্য,
ন্যায় ও ইনছাফের পথ থেকে ফিরে যাওয়া সহজ-সরল পথ থেকে ফিরে যাওয়ার নামান্তর। ইসলাম সন্তানদের মধ্যে সাম্য বিধানের জোরালো নির্দেশ দিয়েছে। অন্যসব সন্তানদের বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট একজন সন্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া বা কন্যা
সন্তানদের বাদ দিয়ে পুত্র সন্তানদেরকে প্রাধান্য দেয়া সম্পূর্ণরূপে ইনছাফ পরিপন্থী। ইসলাম ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করার অনুমতি প্রদান করে না। তারা উভয়ে যেন একই মানদন্ডের দুই প্রান্ত। পিতা-মাতার উপর সকল সন্তানের এ অধিকার স্বীকৃত যে, তারা দান ও ব্যয়ের ব্যাপারে সন্তানদের মাঝে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন নীতি অবলম্বন করবেন। সকলের
সমান কল্যাণ কামনা করবেন। কারো প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়বেন না এবং কাউকে বঞ্চিত করবেন না। ন্যায় ও সুষম নীতি অবলম্বন করবেন। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করলেন। আমার মা ‘আমরাহ বিনতে রাওয়াহা বললেন, আমি এতে সন্তুষ্ট নই যতক্ষণ আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এর সাক্ষী না বানান। তখন
আমার পিতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললেন, আমি ‘আমরাহ বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার এই সন্তানকে
একটা বস্ত দান করেছি। এতে ‘আমরাহ আমাকে বলেছে, আমি যেন আপনাকে সাক্ষী করি। তিনি (ছাঃ) বললেন, তুমি
কি তোমার সকল সন্তানকে এর অনুরূপ দান করেছ। তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং
সকল সন্তানদের মধ্যে সমতা বিধান কর। নু‘মান (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমার পিতা ফিরে এলেন এবং আপন দান ফিরিয়ে নিলেন’। সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে এ দু’য়ের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ অসম আচরণে সন্তানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে তাদের অন্তরে গোপন রাখে একে অপরের প্রতি দুঃখ, ভালবাসার স্থলে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব স্থান পায়, পরস্পরের মধ্যে ঐক্যের স্থলে সৃষ্টি হয় বিবাদ ও অনৈক্য। তাই এহেন পক্ষপাতমূলক কাজ হতে পিতা-মাতা উভয় অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।

 

১০. বিবাহ প্রদান এবং বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা কন্যাকে আশ্রয় দান :

সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। শিশু যখন যৌবনে পদার্পন করে তখন তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটে, তখন সে নতুন কিছুর সন্ধানে উন্মুখ হয়। সে যেকোন সময় বিপদগামী হতে পারে। তাই পিতার একান্ত উচিৎ উপযুক্ত
পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। বিবাহ মানুষকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বিবাহ দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে’।
কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হয় কিংবা বিধবা বা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন পিতা সেই কন্যাকে সাদরে
গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, আশ্রয় ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবেন। কোন অবস্থাতেই পিতা তার ব্যাপারে বিমুখ হবেন না। সন্তানের এ অধিকার পিতার নিকট প্রাপ্য।

 

১১. পিতা-মাতা সন্তানের দাম্পত্য সম্প্রীতি বৃদ্ধি পূর্বক কল্যাণ কামনা করা :

শিশু সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয় তার পিতা-মাতার দ্বারা। কারণ শিশু তার আচার-আচরণে তাদেরকেই আদর্শরূপে গ্রহণ করে।
তাই মাতা-পিতার কর্তব্য সন্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক মন-মানসিকতা বিকাশের জন্য তাদের সামনে সুন্দর চরিত্র ও উত্তম
আচরণ প্রকাশ করা। অর্থাৎ পিতা-মাতা উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন বজায় রাখা। পিতা-মাতার মধ্যে কলহ
বিবাদ থাকলে সন্তানের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। যে সমস্ত পিতা-মাতার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ বিরাজমান থাকে, সেসব
মা-বাবার সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে। সন্তানের ব্যাপারে পিতা-মাতার মাঝে যেন কোন প্রকার অন্যমনস্কতা
ও শৈথিল্যের সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা, লালন-পালন ও জাগতিক ব্যাপারে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার পর পিতা-মাতা উভয়ের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করা।
যেমন- ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের এমন স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য নেতা নিযুক্ত কর’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)। অপরপক্ষে
সন্তানকে কোন অভিশাপ বা বদদো‘আ করা পিতার জন্য শোভনীয় নয়। এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর
নিকট এসে নিজের এক পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল। তিনি বললেন, ‘তাকে তুমি কোনরূপ বদদো‘আ করেছ কি?
সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তবে তুমি তাকে নষ্ট করেছ’।

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, সন্তান দাম্পত্য জীবনের কাঙ্খিত ফসল। তাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য
তাদেরকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা বাবা-মার দায়িত্ব। যাতে ‘সৎ সন্তান’ হিসাবে তারা পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের
জন্য আমল জারী থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায়, তখন তিনটি ব্যতীত তার
সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। (১) ছাদাক্বায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ছাদাকা (২) ইলম, যার দ্বারা মানুষের উপকার হয়
(৩) সুসন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’। আল্লাহ তালা আমাদের বুঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।