ধৈর্য্য ইসলামের সৌন্দর্য:

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই এর মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদি যুগ থেকে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ
নবী মুহাম্মাদ সা. কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. বলেন, অর্থাৎ আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা
প্রদানের জন্য। (মুসলিম ও তিরমিজি)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কোরআনে  বলেন, অর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সা.), নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সূরা কলম, আয়াত: ৪)।
মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে
স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় দান
করেছেন। ধৈর্যের আরবি হলো ছবর। সহিষ্ণুতার আরবি হলো হিলম। ছবর ও হিলম শব্দদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ তাত্ত্বিক পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। সাধারণত ছবর তথা ধৈর্য
হলো অপারগতার কারণে বা অসমর্থ হয়ে প্রতিকারের চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করা।
আর হিলম, অর্থাৎ সহিষ্ণুতার মানে হলো শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ
না করা। এ অর্থে হিলম ছবর অপেক্ষা উন্নততর পর্যায়। তবে এ উভয় শব্দ কখনো
কখনো অভিন্ন অর্থে তথা উভয় অর্থে এবং একে অন্যের স্থানে ব্যবহৃত হয়। হিলম
তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে  আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ এবং আল্লাহই
তো সম্যক প্রজ্ঞাময় পরম সহনশীল। (সূরা হজ আয়াত: ৫৯)। ছবর, অর্থাৎ ধৈর্য্য
সম্পর্কে কোরআন মজিদে আল্লাহ বলেন, অর্থ: আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্য্যশীল।
কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। (সূরা সাদ, আয়াত: ৪৪)। অর্থ: নিশ্চয়
এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্য্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৫)।

ধৈর্যের গুরুত্ব:

ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের
শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। (সূরা আসর, আয়াত: ১-৩)।
এই সূরার শেষে আল্লাহ ধৈর্য্যকে সাফল্যের নিয়ামকরূপে বর্ণনা করেছেন।আল্লাহ
তাআলা বলেছেন, অর্থ: হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম
হতে পারো। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)। ধৈর্য্য ধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত,
কারণ আল্লাহ তাআলা ধৈর্য্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর আল্লাহ  যার সঙ্গে থাকবেন, তার সফলতা অবধারিত। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেন,  অর্থ: হে মুমিনগণ! ধৈর্য্য
ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।

ধৈর্য্য মানবজীবনে পরীক্ষাস্বরূপ:

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,  অর্থ: মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত;
তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। (সূরা
মুলক, আয়াত: ১-২)। ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সফলতার সুসংবাদ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন, ‘আমি তোমাদিগকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না
ইলাইহি রাজিউন) ‘আমরা তো আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)। আজও আমরা বিপদ-আপদে পড়লে পড়ি,
‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (নিশ্চয় আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁর নিকটেই প্রত্যাবর্তনকারী)। কিন্তু এটি আমরা পড়ি অধৈর্য হয়ে পড়লে
তখনই। মূলত আমরা এর দর্শন ভুলে গিয়ে এটিকে প্রথায় পরিণত করেছি। হাদিস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি বিপদে-মুসিবতে এই দোয়া পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার বিপদ দূর
করবেন এবং তার যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন।
(বুখারি ও মুসলিম)। ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ুব আ. ১৮ বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার
চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস আ.কে
সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংস্র
মাছের উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থ: অতএব, তুমি ধৈর্য্য   ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচরের (ইউনুস আলাইহিস সালাম)
ন্যায় অধৈর্য্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল। (সূরা কলম, আয়াত: ৪৮)। আমরা সাধারণত বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতে বিচলিত না হওয়াকেই
ধৈর্য্য বলে মনে করি। মূলত ধৈর্য্য অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে।

ধৈর্য্য তিন প্রকার:

যথা: ‘ছবর আনিল মাছিয়াত’ অর্থাৎ অন্যায়–অপরাধ হতে বিরত থাকা। ‘ছবর
আলাত তআত’, অর্থাৎ ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা।
‘ছবর আলাল মুছিবাত’, অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া। (তাফসিরে বায়জাবি)।
কোনো ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অর্থে ধৈর্য্য অবলম্বন করে, তবে তার জীবনে পূর্ণতা
ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায়–অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে
বিরত থাকা সকল প্রকার অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।
দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান। তৃতীয়ত, প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং ‘ছবর কামিল’
বা পরিপূর্ণ ধৈর্য্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সকল
অনভিপ্রেত অবস্থায়, যে কোনো অযাচিত পরিবেশে ও অনাহূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথি হবে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন। যেমন, হজরত মুসা আ. নদীপাড়ে এসে নদী পারাপারের উপায় না দেখে সমূহ বিপদ দর্শনে উম্মতকে সান্ত্বনা দিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের
সঙ্গে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, অর্থ: (মুসা আলাইহিস সালাম) বলল, ‘কখনোই নয়!
(আমরা ধরা পড়ব না, পরাজিতও হব না, কারণ) আমার সঙ্গে আছেন আমার
প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।’ (সূরা শোআরা, আয়াত: ৬২)।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফ যাওয়ার
পথে সুর পর্বতগুহায় যখন আত্মগোপন করে ছিলেন, তখন তাঁর প্রিয় সাথি হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা. কে অভয় দিয়ে এভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন। কোরআনে তা
উল্লেখ হয়েছে, ‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন, যখন কাফিরেরা তাকে বহিষ্কার করেছিল এবং সে ছিল দুজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল; সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিল, ‘বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ তো আমাদের সঙ্গে আছেন।’ অতঃপর আল্লাহ তার ওপর তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ
করেন এবং শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা, যা তোমরা দেখনি এবং
তিনি কাফিরদের কথা তুচ্ছ করেন। আল্লাহর কথাই সর্বোপরি এবং আল্লাহ
পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ ( সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৪০)।