দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ (তৃতীয় পর্ব)

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় শারঈ দৃষ্টিতে কিছু করণীয় :
১. দো‘আ ও তওবা-ইস্তিগফার : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে সমাজের মানুষের উপর আপতিত একটি বিপদ। এথেকে মুক্তি লাভের জন্য অবশ্যই আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতিসহ দো‘আ করতে হবে এবং বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। মহান
আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে প্রচুর বারি বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন এবং তোমাদের জন্য
বাগিচাসমূহ সৃষ্টি করবেন ও নদীসমূহ প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ৭১/১০-১২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে একজন ব্যক্তি এসে তাঁকে মূল্য নির্ধারণের আবেদন জানালেন। তখন তিনি বললেন, ‘বরং আমি আল্লাহর কাছে দো‘আ করব’।
এ হাদীছ থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে আল্লাহর নিকট মূল্য
হ্রাসের জন্য বেশী বেশী দো‘আ করতে হবে। এ সময় নিম্নোক্ত দো‘আগুলি পড়া যায়।-
১.‘(হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (আম্বিয়া ২১/৮৭)।
২. ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমত কামনা করি। তুমি আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও আমার নিজের হাতে ছেড়ে দিও না। বরং তুমি স্বয়ং আমার সমস্ত ব্যাপার ঠিক করে দাও। তুমি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই’।
‘সহনশীল মহান আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই,
যিনি মহান আরশের অধিপতি। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যিনি আসমান সমূহ
ও যমীনের রব এবং মহান আরশের রব’।
২. অপচয় পরিহার : অপচয় যেকোন সময় পরিত্যাজ্য। বিশেষতঃ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির
সময় এটি আরো বেশী পরিত্যাজ্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান কর।
কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’
(আ‘রাফ ৭/৩১)। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা খাও, পান করো, পরিধান করো
এবং অপচয় ও অহংকার ছাড়াই দান করো’।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অল্পে তুষ্ট থাকা:

৩. অল্পে তুষ্টি : অল্পে তুষ্টি মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ তোমার ভাগ্যে আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তাতে খুশী থাকলে তুমি সবচেয়ে সুখী মানুষ
বলে গণ্য হবে’। তিনি আরো বলেন, ‘যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ রিযিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তাতে পরিতৃপ্ত হওয়ার শক্তি দিয়েছেন, সেই সফলতা লাভ করেছে’।
৪. বর্ধিত মূল্যের জিনিস পরিহার : ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর যুগে লোকেরা তাঁর
নিকটে এসে বলল, আমরা আপনার নিকটে গোশতের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ করছি। অতএব আপনি আমাদের জন্য এর মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন তিনি বললেন,
তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তখন তারা বলল, আমরা মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ করছি। গোশত কসাইদের নিকটে আছে এবং আমরা এর প্রয়োজন অনুভব করছি। আর আপনি কি-না বলছেন, তোমরা নিজেরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও? আমরা কি গোশতের মালিক
যে, এর মূল্য কমিয়ে দিব? যে জিনিস আমাদের হাতে নেই, তার মূল্য আমরা কিভাবে
হ্রাস করব? তখন তিনি তার সেই মূল্যবান উক্তিটি করলেন, ‘তাদের নিকট থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও’।
আববাসীয় কবি মাহমূদ আল-অর্রাক (মৃঃ ৮৪৪ খৃ.) বলেন,
‘যখন আমার উপর কোন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পায়, তখন আমি তা ক্রয় করা পরিহার
করি। তখন মূল্যবৃদ্ধির সময় তা সস্তায় পরিণত হয়’।
৫. আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা : যেকোন বিপদ-আপদ আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলে এবং তাঁর সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করলে আল্লাহ তা আমাদের জন্য সহজ
করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্যে উত্তরণের
পথ তৈরী করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করবেন’
(তালাক ৬৫/২-৩)।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা:

এ ক্ষেত্রে ৪টি বিষয় লক্ষ্যণীয় :
(ক) আল্লাহর প্রতি কেউ সুধারণা পোষণ করলে আল্লাহ তাকে সেই জিনিসটি দান
করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ বলেন, আমি
সে রকমই, যে রকম আমার প্রতি বান্দা ধারণা রাখে’।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
‘যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই সেই সত্তার কসম করে বলছি, মহান আল্লাহর প্রতি
সুধারণা পোষণের চেয়ে উত্তম কোন জিনিস মুমিন বান্দাকে প্রদান করা হয়নি। কোন বান্দা যদি আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে তার ধারণাকৃত জিনিসটি প্রদান করেন। এ কারণে যে, যাবতীয় কল্যাণ আল্লাহর হাতে রয়েছে’।
(খ) আল্লাহ কষ্টের পর সহজতার ওয়াদা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর
নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (শরহ ৫-৬)।
(গ) আল্লাহর চেয়ে বান্দার প্রতি অধিক দয়ালু আর কেউ নেই। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন সৃষ্টির কাজ শেষ করলেন, তখন তিনি
তাঁর কিতাবে (লওহে মাহফূযে) লিখেন, যা আরশের ওপর তাঁর নিকট আছে। ‘নিশ্চয়ই আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল’।
(ঘ) আল্লাহ প্রত্যেকের জন্য রিযিক লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা অন্য
কিছু আপনার ও রিযিকের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। মহান
আল্লাহ বলেন, ‘আর ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিক আল্লাহর
যিম্মায় নেই। আর তিনি জানেন তার অবস্থানস্থল ও সমর্পণস্থল। সবকিছুই সুস্পষ্ট
কিতাবে (লওহে মাহফূযে) লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (হূদ ১১/৬)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আদম সন্তান যদি তার রিযিক থেকে পলায়ন করত, যেমন
সে মৃত্যু থেকে পলায়ন করে, তবুও তার রিযিক তার নাগাল পেয়ে যেত, যেভাবে মৃত্যু
তার নাগাল পায়’।
৬. রিযিকে বরকত বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রিযিক বৃদ্ধি হয় এমন কর্ম সমূহ সম্পাদনে মনোযোগী হতে হবে। কারণ
সম্পদ বেশী হওয়াটা মুখ্য নয়; বরং মুখ্য হল তাতে বরকত লাভ।

রিযিক বৃদ্ধির মৌলিক কয়েকটি উপায়:

(ক) আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় যে, তার
রিযিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বর্ধিত হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখে’।
(খ) বরকতের দো‘আ করা। নবী করীম (ছাঃ) দো‘আ করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের
ছা-য়ে বরকত দান করুন! হে আল্লাহ! আমাদের মুদে বরকত দান করুন! হে আল্লাহ! আমাদের মদীনায় বরকত দান করুন! হে আল্লাহ! বরকতের সাথে আরো দু’টি বরকত
দান করুন’।
(গ) আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা। প্রত্যেক দিন সকালে দানশীল ব্যক্তির জন্য ফেরেশতা দো‘আ করেন, ‘হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন’।
(ঘ) ঋণ পরিশোধ করা। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে
বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘যে তার ঋণ পরিশোধের নিয়ত করে, সে আল্লাহর পক্ষ
থেকে সাহায্য লাভ করে এবং আল্লাহ তার জন্য রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন’।
৭. দুর্বল ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো : দুর্বল, অসহায় ও গরীব-দুঃখীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অন্যান্য বালা-
মুছীবত থেকে মুক্তির উপায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’। আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা দুর্বলদের মধ্যে আমাকে অনুসন্ধান করো। কারণ তোমরা তোমাদের মধ্যকার দুর্বলদের কারণেই রিযিক এবং সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাক’।
৮. ইবাদতে মনোযোগী হওয়া : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় রিযিকের চিন্তায় বিভোর
হয়ে আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফেল থাকা যাবে না। বরং ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে
আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতঃ (বাক্বারাহ ২/৪৩, ১৫৩) রিযিকের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকতে হবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলে লেনদেন সহজ করা:

৯. লেনদেনে সহজতা অবলম্বন : সহজতা ইসলামী শরী‘আতের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষেরা সহজতার প্রয়োজন বেশী অনুভব করে।
বিশেষত মুসলিম উম্মাহর উপর আপতিত সংকটের সময়। এজন্য সৎ ব্যবসায়ীর
বৈশিষ্ট্য হ’ল তার সাথে যারা লেনদেন করে তাদের সাথে সহজতা অবলম্বন করা।
উক্ববা বিন আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ সম্পদ দান করেছিলেন তাঁর এমন এক বান্দাকে ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত করে বলবেন, তুমি
দুনিয়ায় কি আমল করেছ? সে বলবে,
‘প্রভু হে! আমি কোন আমল করিনি। তবে আপনি আমাকে সম্পদ দান করেছিলেন।
আমি মানুষের নিকট কেনাবেচা করতাম। আমার বৈশিষ্ট্য ছিল, আমি স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্য সহজতা অবলম্বন করতাম এবং গরীব ব্যক্তিদের অবকাশ দিতাম। আল্লাহ বলেন,
তোমার চেয়ে আমিই এর অধিক হকদার। তোমরা আমার বান্দার দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাও’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন
যে ক্রেতা, বিক্রেতা, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী অবস্থায় সহজতা অবলম্বনকারী ছিল’।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্রয়, বিক্রয় ও বিচারের ক্ষেত্রে উদারতাকে পসন্দ করেন’।
১০. তাক্বওয়া অবলম্বন করা : সর্বোপরি তাক্বওয়া অবলম্বন করা একান্ত কর্তব্য। কারণ তাক্বওয়াই রিযিকে বরকত ও প্রশস্ততা আনয়ন করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হত, তাহলে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল।
ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)।

উপসংহার :

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিভিন্ন দেশের জনগণ এতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। এটি আমাদের উপর মুছীবত হিসাবে আপতিত হয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিকতাবোধের উজ্জীবন ঘটাতে হবে। এর দুনিয়াবী প্রতিকারের সাথে সাথে শারঈ যেসব করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি পরিপালন করতে হবে। বেশী বেশী দো‘আ ও তওবা-ইস্তিগফার পাঠ করতে হবে। সর্বোপরি মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে। তাহলে সব চিন্তা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যাবে। বিশর ইবনুল হারিছ যথার্থই বলেছেন ‘তুমি যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য উদ্বিগ্ন হবে তখন মৃত্যুকে স্মরণ করবে। কারণ মৃত্যুকে স্মরণ তোমার মন থেকে মূল্যবৃদ্ধির দুঃশ্চিন্তা দূরীভূত করে দিবে’।