দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতি: ইসলামী দৃষ্টিকোণ:

দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতির পদতলে জনজীবন পিষ্ট। দ্রব্যমূল্য এর পাগলা ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে
ছুটছে তো ছুটছেই। এর মুখে লাগাম দেয়া যাচ্ছে না। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা মেটাতে পরিবার প্রধানদের উঠছে নাভিশ্বাস। ‘কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব)-এর ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ। একই সঙ্গে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বছর সব ধরনের চালের গড় মূল্য বেড়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, মাছের দাম সাড়ে ১৩ শতাংশ, শাকসবজিতে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, তরল
দুধে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, গোশতে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ডিমে বেড়েছে ৭ দশমিক
৭১ শতাংশ। দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ী ভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ হ’ল মজুদদারী। মূলতঃ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন,

‘মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যহ্রাস এ দু’টি ঐ সকল ঘটনার অন্যতম, যার স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ
ছাড়া অন্য কেউ নন। তাঁর ইচ্ছা ও ক্ষমতা ছাড়া এর কিছুই সংঘটিত হয় না। তবে
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনা ঘটার
কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যেমন হত্যাকারীর হত্যাকে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর
কারণ করেছেন। বান্দাদের যুলুমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো
কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন’।

ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতি :

পণ্য সরবরাহ ও ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ইসলাম বাজার ব্যবস্থা ও দ্রব্যমূল্যকে
স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে চায়। সমাজতন্ত্রের মত বাজার প্রক্রিয়াকে সমূলে
উচ্ছেদ করে ‘মূল্য নির্ধারণ কমিশন গঠন’ করে সরকার কর্তৃক দ্রব্যের দাম নির্ধারণ
করা ইসলামে নিষেধ। বস্ত্ততঃ ইসলামী অর্থনীতিতে দামকে মানবিক প্রেক্ষিতেই
বিবেচনা করা হয়। ইসলামী অর্থনীতির দাম নীতি বাস্তবসম্মত দাম নীতি । স্বাভাবিক
বাজার দর অনুযায়ী পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে এটাই ইসলামের কাম্য। হাদীছে
এসেছে, আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ)! দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব আপনি আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করুন!
তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণকারী, তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং তিনি রিযিকদাতা। আমি আল্লাহর
সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার
জান ও মালের ব্যাপারে যুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে’।

ড. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন,

‘এই হাদীছের মাধ্যমে ইসলামের নবী ঘোষণা দিচ্ছেন যে, বিনা প্রয়োজনে ব্যক্তি
স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যুলুম। রাসূল (ছাঃ) যুলুমের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থেকে
আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করেন। কিন্তু বাজারে যখন অস্বাভাবিক
কার্যকারণ অনুপ্রবেশ করবে যেমন কতিপয় ব্যবসায়ীর পণ্য মজুদকরণ এবং
তাদের মূল্য কারসাজি, তখন কতিপয় ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর সামষ্টিক স্বার্থ প্রাধান্য
লাভ করবে। এমতাবস্থায় সমাজের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদা পূরণার্থে এবং লোভী সুবিধাভোগীদের থেকে সমাজকে রক্ষাকল্পে মূল্য নির্ধারণ করা জায়েয। তাদের
অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ  করতে না দেয়ার জন্য এ নীতি স্বতঃসিদ্ধ’।

অন্য হাদীছে আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একজন লোক এসে বলল, হে আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)! দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বরং আমি (আল্লাহর কাছে) দো‘আ করব। অতঃপর অপর এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর
রাসূল! দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করুন! তখন তিনি বললেন, ‘বরং আল্লাহই দ্রব্যমূল্যের
হ্রাস-বৃদ্ধি করেন। আমি এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার আশা করি,
যেন আমার বিরুদ্ধে কারো প্রতি যুলুম করার অভিযোগের সুযোগ না থাকে’।
উল্লেখিত হাদীছ দু’টি থেকে বুঝা গেল যে, দ্রব্যমূল্য এর হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর হুকুমেই
ঘটে থাকে। এজন্য কতিপয় বিদ্বান অভিমত প্রকাশ করেছেন যে,اَلْمُسَعِّرُ  আল্লাহর
একটি গুণবাচক নাম।

শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আমার অভিমত হ’ল, এটি সংবাদ প্রদানের উদ্দেশ্যে
বলা হয়েছে; আল্লাহর নাম বর্ণনা করার জন্য নয়’। তিনি আরো বলেন, ‘আমার মতে,
এটি আল্লাহর কর্মবাচক গুণ। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ জিনিসের মূল্য কম-বেশী করেন। তাই আমার মতে এটি আল্লাহর নাম নয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত’। এ মতটিই সঠিক
বলে প্রতিভাত হয়।

ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, ‘আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দ্বারা দু’দিক থেকে দ্রব্যমূল্য
নির্ধারণ বৈধ না হওয়ার দলীল সাব্যস্ত হয়। এক. লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের আহবান জানালেও তা তিনি করেননি। যদি সেটি জায়েয হত,
তাহলে তিনি তাদের আহবানে সাড়া দিতেন। দুই. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ না করার কারণ
হিসাবে তিনি বলেছেন, এটি যুলুম। আর যুলুম হারাম। তাছাড়া তা বিক্রেতার মাল।
সুতরাং ক্রেতা-বিক্রেতা ঐক্যমত পোষণ করলে বিক্রেতাকে তার মাল বিক্রি করা
থেকে নিষেধ করা জায়েয নয়’।

ইমাম শাওকানী (রহঃ) দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে বলেন,

‘আনাস (রাঃ)-এর হাদীছ ও একই মর্মে বর্ণিত অন্য হাদীছগুলো দ্বারা মূল্য নির্ধারণ
হারাম ও  যুলুম হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে। এর কারণ হ’ল, মানুষ তাদের
মালের উপর কর্তৃত্বশীল। অথচ তাস‘ঈর তাদের জন্য প্রতিবন্ধক। আর রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে আদিষ্ট। বর্ধিত মূল্যে বিক্রির ব্যাপারে বিক্রেতার স্বার্থ
দেখার চেয়ে সস্তা দামে ক্রয়ের ব্যাপারে ক্রেতার স্বার্থের প্রতি দৃকপাত করা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য উত্তম নয়। আর পণ্যের মালিককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য
করা আল্লাহর বাণী ‘তবে ব্যবসা যদি হয় ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে
তবে ভিন্ন কথা’ (নিসা ৪/২৯)-এর বিরোধী। অধিকাংশ বিদ্বান এ মতের প্রবক্তা’।
উল্লেখ্য যে, তাসঈর হল  ‘সরকার অথবা তার প্রতিনিধি কর্তৃক পণ্যের দাম নির্ধারণ
করে দেয়া’।

তাছাড়া যারা সরকার কর্তৃক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা বৈধ নয় মনে করেন তাদের
আরেকটি দলীল হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণী ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের
মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না’ (নিসা ৪/২৯)। কারণ বিক্রেতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার
উপর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য চাপিয়ে দেয়া যুলুম, যা অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ
ভক্ষণ করার পর্যায়ে পড়ে।

কতিপয় হাম্বলী ফকীহ মনে করেন,

‘সরকার কর্তৃক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ। কেননা যখন আমদানীকারকদের কাছে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের খবর পৌঁছবে, তখন তারা এমন শহরে তাদের পণ্য নিয়ে
আসবে না যেখানে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে। ফলে যার
কাছে পণ্য রয়েছে সে তা বিক্রি করা হ’তে বিরত থাকবে এবং লুকিয়ে ফেলবে। আর ভোক্তারা তা চাইবে, কিন্তু যৎসামান্য বৈ পাবে না। তখন দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের জন্য
তারা উচ্চমূল্য প্রদান করবে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে এবং বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়
পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিক্রেতা পক্ষকে তাদের মাল বিক্রি করা থেকে নিষেধ করার
কারণে এবং ক্রেতাকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে নিষেধ করার কারণে। ফলে তা
হারাম হবে’।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা বৈধ
নয়। তবে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অন্যায়ভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া
হয়, তবে সরকারকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ
করে দিতে হবে।

ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে বলেন:

‘মূল্য নির্ধারণ যদি মানুষের প্রতি যুলুম করা এবং তাদেরকে অন্যায়ভাবে এমন মূল্যে
পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করাকে শামিল করে, যাতে তারা সন্তুষ্ট নয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য যা বৈধ করেছেন তা থেকে শাসক নিষেধ করেন, তাহ’লে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ হারাম। কিন্তু মানুষের মাঝে ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে যদি মূল্য নির্ধারণ করা হয় যেমন, বাজারের প্রচলিত দামে তাদেরকে বিক্রি করতে বাধ্য করা এবং প্রচলিত বিনিময় মূল্যের অধিক
গ্রহণ করা থেকে শাসক তাদেরকে নিষেধ করেন, তাহ’লে তা শুধু জায়েযই নয়; রবং ওয়াজিব’।তিনি আরো বলেন, ‘মানুষেরা যখন প্রচলিত নিয়মে কোন রকম যুলুম ছাড়াই তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করবে আর পণ্যদ্রব্যের স্বল্পতা বা জনসংখ্যার আধিক্যের
কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, তখন তা আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করতে হবে। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে জনগণকে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা অন্যায় বা
বাড়াবাড়ি বৈ কিছুই নয়’। তাঁর মতে, তবে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও
পণ্যের মালিকগণ যদি প্রচলিত দামের চেয়ে বেশী দাম গ্রহণ ছাড়া পণ্য বিক্রি করা
হতে বিরত থাকে, তখন তাদেরকে প্রচলিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা ওয়াজিব’।
তদীয় ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এ সংক্রান্ত আলোচনার উপসংহারে বলেন, ‘মোটকথা, মূল্য নির্ধারণ ব্যতীত যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহ’লে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায়
করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং
কল্যাণ সাধিত হয়, তাহ’লে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না’।

‘আল-হেদায়া’ প্রণেতা বলেন,

‘লোকদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা শাসকের উচিত নয়। তবে খাদ্যদ্রব্যের মালিকরা
যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং দামের ক্ষেত্রে প্রচন্ড সীমালংঘন করে (মাত্রাতিরিক্ত দাম নেয়) আর বিচারক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ ছাড়া মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষণ করতে
অপারগ হন, তখন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের পরামর্শে মূল্য নির্ধারণ করাতে কোন দোষ নেই’।

সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের এক ফৎওয়ায় বলা হয়েছে,
‘যখন বিক্রেতারা তথা ব্যবসায়ী ও অন্যরা তাদের নিজেদের কাছে যে পণ্য আছে তার
দাম তাদের ইচ্ছামত বৃদ্ধি করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করবে, তখন ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা এবং জনসাধারণের কল্যাণ করা ও ফিতনা-ফাসাদ দূর করার সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান বিক্রেয় দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করবেন। আর যদি তাদের মধ্যে ঐক্যমত্য না হয়; বরং কোন প্রকার প্রতারণা ছাড়াই পর্যাপ্ত চাহিদা
ও পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ কম হওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, তাহ’লে রাষ্ট্রপ্রধানের
জন্য মূল্য নির্ধারণ করা উচিত নয়। বরং তিনি প্রজাদেরকে এমনভাবে ছেড়ে দেবেন যে, আল্লাহ তাদের কারো দ্বারা কাউকে রিযিক দিবেন’।

শায়খ ছালেহ ফাওযান বলেন,

‘পণ্যের স্বল্পতা ও সরবরাহ কম হওয়ার কারণে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহ’লে এতে কারো কিছুই করার নেই। তবে ব্যবসায়ীদেরকে বলা হবে, মানুষেরা যে দামে বিক্রি করছে সে বাজার মূল্যে তোমরা বিক্রি করো। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। পক্ষান্তরে মাল গুদামজাত করার কারণে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে পণ্যের ঘাটতি হেতু তারা বেশী দামে মাল বিক্রি করে, তাহ’লে শাসক এতে হস্তক্ষেপ করবেন। মানুষেরা
যে দামে বিক্রি করছে সে দামে বিক্রি করতে তিনি তাদেরকে বাধ্য করবেন। এটাই আদল বা ন্যায়-নীতি’।

দ্রব্যমূল্য এর ঊর্ধ্বগতির কারণ :

১. মজুদদারী : 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম প্রধান কারণ মজুদদারী। একশ্রেণীর মুনাফালোভী সুযোগসন্ধানী অসৎ ব্যবসায়ী সস্তা দামে পণ্য ক্রয় করে এবং ভবিষ্যতে চড়া দামে বিক্রয় করার মানসে তা মজুদ করে রাখে। ফলে বাজারে দুষ্প্রাপ্যতার দরুন পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং পণ্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যায়। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

‘কেননা মজুদদার মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে মজুদ করে রাখে এবং তাদের নিকট চড়া দামে বিক্রি করতে চায়। ক্রেতা সাধারণের উপর সে যুলুমকারী। এজন্য শাসক মানুষের প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের নিকট মজুদকৃত জিনিস প্রকৃত মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারেন। যেমন, কারো নিকট এমন খাদ্য মজুদ আছে যার প্রয়োজন তার নেই। আর এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। তবে তাকে প্রচলিত বাজার মূল্যে মানুষের কাছে তা বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে’।

মজুদদারির অশুভ প্রভাব সম্পর্কে ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফসলের পরিবর্তে মুদ্রা রাজস্ব আদায়ের একমাত্র মাধ্যমে পরিণত হয়। ফলে খাজনার টাকা সংগ্রহের জন্য কৃষককে তার সারা বছরের খাদ্য ফসল বিক্রি করতে হ’ত। এই সুযোগে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাংলা-বিহারের বিভিন্ন স্থানে ধান-চাল ক্রয়ের জন্য ক্রয়কেন্দ্র খুলে বসে। শুধু তাই নয়, বেশী মুনাফা লাভের আশায় এসব ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা শুরু করে। পরে সুযোগ-সুবিধামতো এসব খাদ্যই চড়ামূল্যে সেই চাষীদের নিকট আবার বিক্রি করত। ফলে খাদ্য গুদামজাতকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির কারণেই এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে এল। ১৭৬৯ সালে ক্রয়কৃত সমস্ত ফসল কোম্পানীর লোকেরা ১৭৭০ সালেই বেশী দামে হতভাগ্য চাষীদের নিকট বিক্রি করতে লাগল। বাংলার চাষী তা ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়ে নযীরবিহীন দুর্ভিক্ষের শিকার হ’ল। মারা গেল কয়েক লক্ষ বনু আদম। বাংলা ১১৭৬ (১৭৬৯-৭০ খৃ.) সালের এই দুর্ভিক্ষই ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে ইতিহাসে খ্যাত।

ইয়ং হাসব্যান্ড এর ভাষায়:

প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ ঐতিহাসিক ইয়ং হাসব্যান্ড এর ভাষায়, ‘তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফার পরবর্তী উপায় ছিল চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এ দ্রব্যটির জন্য তারা যে মূল্যই চাইবে, তা পাবে। চাষীরা তাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফল অপরের গুদামে মজুদ থাকতে দেখে চাষ-বাস সম্পর্কে এক রকম উদাসীন হয়ে পড়ল। ফলে দেখা দিল ভয়ানক খাদ্যাভাব। দেশে যেসব খাদ্য ছিল, তা ইংরেজ বণিকদের দখলে। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে থাকল, ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃখময় জীবনের ওপর পতিত হ’ল এই পুঞ্জীভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।

এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোন অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নয়। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিল, তা ভারতবাসীরাও আর কোনদিন চোখে দেখেনি বা কানে শোনেনি। চরম খাদ্যাভাবের এক ভয়াবহ ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিল ১৭৬৯ সাল। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা-বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক তাদের সকল আমলা, গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান-চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায়ে মুনাফা এত শীঘ্র ও এত বিপুল পরিমাণ ছিল যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এ ব্যবসা করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ৬০ হাযার পাউন্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) দেশে পাঠিয়েছিল (Young Husband : Transaction in India, 1786)

ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টারের বর্ণনানুযায়ী এই দুর্ভিক্ষের ফলে মানুষজন তাদের গরু-বাছুর, লাঙ্গল-জোঁয়াল বিক্রি করে ফেলে এবং বীজধান খেয়ে অবশেষে ছেলে-মেয়ে বেচতে শুরু করে। এমনকি এক পর্যায়ে ক্ষুধার তাড়নায় জীবিত মানুষ মরা মানুষের গোশত পর্যন্ত খেতে শুরু করে

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : 

অনেক সময় মহান আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য কিংবা তাদের কৃতকর্মের দরুণ শাস্তি দানের উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জালোচ্ছ্বাস, খরা প্রভৃতি নাযিল করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(আখেরাতে) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা তাদের লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো। যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)। তিনি আরো বলেন,

‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন ও প্রাণের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-শস্যাদি বিনষ্টের মাধ্যমে ’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)

মূলতঃ মানুষের পাপের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘স্থলে ও সমুদ্রে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসাবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের কর্মের কিছু শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (পাপ ছেড়ে আল্লাহর দিকে) ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। ফলে উক্ত পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী কম উৎপাদন হেতু মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও একশ্রেণীর ব্যবসায়ী এটিকে মুনাফা লাভের মওকা হিসাবে গ্রহণ করে। দেশের একটি অঞ্চলের বন্যা যেন সারা দেশে দাম বাড়ানোর মোক্ষম সুযোগ ও হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। বন্যা কমে গেলেও একবার বেড়ে যাওয়া পণ্যের দাম কমতে চায় না। মজার ব্যাপার হ’ল, বন্যার অজুহাতে বিদেশ থেকে আমদানী করা পণ্য কিংবা যেসব পণ্য বন্যাকবলিত এলাকার বাইরে উৎপন্ন হয় সেগুলিরও দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়।[23] বন্যার  সময় বাংলাদেশের এটি চিরচেনা চিত্র।

৩. সূদ : সূদের ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সূদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী উৎপাদন খরচের উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক (যদি থাকে), অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে পণ্যদ্রব্যের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের উপর উপর্যুপরি সূদ যোগ করা হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চার বা তার চেয়েও বেশী সূদ যুক্ত হয়ে থাকে। ফলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই সূদের জন্য সৃষ্ট এই চড়ামূল্য দিতে হয়। সূদনির্ভর অর্থনীতিতে এছাড়া তার গত্যন্তর নেই।

৪. মধ্যস্বত্বভোগীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ :

অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে যে মূল্যে ব্যবসায়ী ও মধ্যস্তত্বভোগীরা তা ক্রয় করে থাকে কিংবা সেখানে যে মূল্যে সে দ্রব্য বিক্রি হয়, বাজারে তা বিক্রি করে অনেক বেশী চড়া দামে। মধ্যস্বত্বভোগীদের অত্যধিক মুনাফা লাভের এ হীন মানসিকতার ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। অনেক সময় পাইকারী বাজারে পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে খুচরা বাজারে সেটি ২০-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হয়। আবার পাইকারী বাজারে কোন পণ্যের দাম ২০ শতাংশ কমলে খুচরা বাজারে সেটি ১০ শতাংশও কমে না।

৫. কালো টাকার দৌরাত্ম্য : 

কালো টাকার মালিকদের কালো টাকার একটা নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত বলে তারা ২০ টাকার জিনিস ৪০ টাকায় ক্রয় করতে দ্বিধা করে না। আর সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়।

৬. চাঁদাবাজি ও অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া : 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এর অন্যতম কারণ হল চাঁদাবাজি  ও অতিরিক্ত পরিবহন খরচ। শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজরা মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে। তারা এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। আর এর বলি হন সাধারণ জনগণ। তাছাড়া অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়ার ফলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। কারণ দ্রব্যসামগ্রীর পরিবহন খরচ বেশী এ অজুহাতেও ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়।

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে দৈনিক চার লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। পণ্যবাহী ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ চাঁদাবাজির শিকার হন।[26] ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন গত ১০ই মে’১৯ তারিখে মন্তব্য করেছিলেন,  গাবতলী পশুর হাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে গোশতের দাম কিছুটা হ’লেও কমবে।

৭. ব্যাংক কর্মকর্তা ও আমদানীকারকদের অশুভ আঁতাত :

আমদানীকারকরা যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিদেশ থেকে আনেন সেগুলির কোটেশন অনেক বেশী করে দেন। আর এভাবেই ওভার ইনভয়েসিং (চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশী দেখানো) হয়। শুল্ক হার কমিয়ে বেশী মুনাফা অর্জন করতেই ওভার ইনভয়েসিং করা হয়। এই ওভার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে অসাধু আমদানীকারকরা একদিকে বেশী করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, অন্যদিকে পণ্যমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে এ দোহাই পেড়ে বেশী দামে আমদানীকৃত পণ্য বাজারে ছাড়েন। এর ফলে স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। তাছাড়া ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণে আমদানির নামে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়।

৮. অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রভাব পড়ে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়।                                              [চলবে]