দুর্নীতি ও ঘুষ : কারণ ও প্রতিকার

দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ ও জাতির উন্নতি-অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার প্রধান অন্তরায় হ’ল দুর্নীতি। এমন কোন সেক্টর
নেই যা দুর্নীতির হিংস্র থাবায় আক্রান্ত হয়নি। এক কথায় বলতে গেলে দুর্নীতি দেশ ও সমাজকে অক্টোপাসের ন্যায় অাঁকড়ে ধরে আছে। যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হ’ল-
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫
পর্যন্ত টানা পাঁচ বার বিশ্বের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে পরিচিত লাভ করা।
যা জাতির জন্য ছিল চরম অবমাননাকর। পরবর্তীতে দুর্নীতির সূচকে অন্যান্য দেশ
এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ এক নম্বরে না থাকলেও দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট আগের মতই আছে। ফলে বাস্তবতা হ’ল দুর্নীতি আগের চেয়েও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
ঘুষ দুর্নীতির অন্যতম অনুসঙ্গ। ঘুষ আদান-প্রদানকে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন
২০০৪’-এ দুর্নীতির ধারাসমূহের মধ্যে এক নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থকে
প্রতীয়মান হয় যে, ঘুষ দুর্নীতির সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম অনুসঙ্গ। মহান আল্লাহ দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যের সম্পদ গ্রাস করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন (নিসা ৪/২৯)।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘুষ গ্রহণকারী ও প্রদানকারী
উভয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন’। কেননা ঘুষের মাধ্যমে অন্যের অধিকার হরণ
করা হয়, অন্যের প্রতি যুলুম করা হয়। আর এতে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বস্তরে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিত ঘুষ-দুর্নীতির প্রকৃতি, কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। এ প্রবন্ধে উক্ত বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

দুর্নীতির পরিচয় ও প্রকৃতি :

‘দুর্নীতি’ শব্দটি নেতিবাচক শব্দ। এটি ইতিবাচক শব্দ ‘নীতি’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আভিধানিক অর্থে ‘দুর্নীতি’ হল- নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি ও অসদাচরণ। সংসদ অভিধানে
বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি’ হ’ল কুনীতি, কুরীতি, ন্যায় ও ধর্ম-বিরুদ্ধ আচরণ ও নীতি বিগর্হিত কর্মকান্ড। ‘রাজনৈতিক ও সরকারী প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে সাধারণত ঘুষ, বল প্রয়োগ
বা ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব বা ব্যক্তি বিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অফিস-আদালতকে ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বুঝায়’।
‘ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ ক্ষমতা, অর্থ প্রাপ্তি বা কোন অবৈধ সুযোগ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে
অসৎ বা কোন অসঙ্গত কাজে ব্যবহার করাকে বলা হয় দুর্নীতি’। দুর্নীতি দমন
কমিশন আইন ২০০৪ এ নিম্নোক্ত অপরাধমূলক কর্মকান্ড সমূহকে দুর্নীতি হিসাবে
চিহ্নিত করা হয়েছে।
১। ঘুষ আদান-প্রদান ২। সরকারী কর্মচারীকে অপরাধে সহায়তা করা ৩। সরকারী
কর্মচারী কর্তৃক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে কোন মূল্যবান বস্ত বিনামূল্যে
গ্রহণ (ধারা ১৬৫) ৪। কোন সরকারী কর্মচারী কর্তৃক পক্ষপাতমূলক আচরণ প্রদর্শন ৫। কোন সরকারী কর্মচারীর বেআইনীভাবে কোন ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত হওয়া
৬। কোন ব্যক্তিকে শাস্তি বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারী কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্য করা ৭। অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল নথিপত্র প্রস্তত (ধারা ২১৮)
৮। অসাধুভাবে
সম্পত্তি আত্মসাৎকরণ (ধারা ৫০৩) ৯। মৃত্যুকালে আত্মসাৎকরণ (ধারা ৪০৪) ১০। অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ (ধারা ৪০৫) ১১। অসাধুভাবে প্রবৃত্ত করা (ধারা ৪২০) ১২।
নথি জালকরণ (ধারা ৪৬৬) ১৩। খাঁটি দলীলকে জাল হিসাবে ব্যবহারকরণ (ধারা ৪৭১)
১৪। হিসাব বিকৃতিকরণমূলক কর্মকান্ড (ধারা ৪৭৭-ক) ১৫। দুর্নীতিতে সহায়তা করা,
ষড়যন্ত্র ও প্রচেষ্টা ইত্যাদি।

ঘুষের পরিচয় ও প্রকৃতি :

আভিধানিক অর্থে ঘুষ হল- উৎকোচ, অবৈধ সহায়তার জন্য প্রদত্ত গোপন
পারিতোষিক, ঘুষের আরবী প্রতিশব্দ হ’ল الرِّشْوَةُ (আর-রিশওয়াতু)। যার অর্থ ঘুষ,
উৎকোচ।পারিভাষিক অর্থ  ‘যা কোন ন্যায্য অধিকার (হক্ব)-কে বাতিল করার জন্য
অথবা কোন বাতিল (নাহক্ব)-কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রদান করা হয় তাই ঘুষ’।
ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, ‘ঘুষ (রিশওয়াত) ঐ বস্ত্ত, যা কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি
অথবা অন্য কোন সাধারণ কর্মচারীকে দেয়া হয়ে থাকে, যাতে তিনি ঘুষদাতার পক্ষে
অথবা তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফায়ছালা প্রদান করেন অথবা তার জন্য অন্যায়ভাবে
কোন কাজ সম্পাদন করে দেন বা তার প্রতিপক্ষের জন্য কোন কাজকে বিলম্বিত করে
দেন ইত্যাদি’।

দুর্নীতি ‘র ধরন :

দুর্নীতি একটি চলমান অপরাধ। বাংলাদেশের এমন কোন সেক্টর পাওয়া যাবে না
যেখানে দুর্নীতি নেই। এককথায় বলতে গেলে দেশের প্রতিটি সেক্টর আপাদমস্তক
দুর্নীতিতে জর্জরিত। তবে একেক সেক্টরের দুর্নীতির ধরন একেক রকম। নিম্নে
কতিপয় ক্ষেত্রের বর্ণনা পেশ করা হল।-
১. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে :
উৎকোচ বা ঘুষ গ্রহণ। বর্তমানে এর রকমারী উপনাম রয়েছে। যেমন- বখশিশ, হাদিয়া,
হাত খরচ, অফিস খরচ, চা-পান খরচ, মিষ্টি খাওয়ার টাকা, বসকে খুশি ইত্যাদি।
এগুলো না দিলে ফাইল চলে না, ফাইলে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। এছাড়াও
রয়েছে সরকারী অর্থ অপচয় ও আত্মসাৎ। স্বজনপ্রীতি, আপনজনকে পদোন্নতি বা
বদলী, বিদেশে ট্রেনিং-এর সুযোগ প্রদান ইত্যাদি। নিয়োগ বাণিজ্য, মিথ্যা ভাউচারের
মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, ব্যক্তি স্বার্থে নিয়োগবিধি ইচ্ছা মাফিক পরিবর্তন-পরিবর্ধন,
অন্যায় সেবা দান, দালাল চক্রের মাধ্যমে সেবা দান, অধীনস্তদের নিকট থেকে
মাসোহারা গ্রহণ ইত্যাদি।

২. আইন-শৃংখলার ক্ষেত্রে দুর্নীতি:

নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার, গ্রেফতার ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়।
বিভিন্ন সেক্টর থেকে চাঁদা আদায়, অর্থের বিনিময়ে বা সরকারী দলের লোক হওয়ায় অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া বা গ্রেফতার না করা, অপরাধীকে অপরাধ করার সুযোগ দেয়া, আদালতে অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা, ৪৪ ধারায় গ্রেফতার
করে পূর্বের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখানো, নিরপরাধ জানা সত্ত্বেও রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতন, নিরপরাধ মানুষের পকেট, গাড়ী, বাড়ী বা প্রতিষ্ঠানে মাদক বা অস্ত্র রেখে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করা ইত্যাদি। ২০১৭ সালের টিআইবির জরিপে দেশের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্তরি ভাগ হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাকে। তাদের দুর্নীতির পরিমাণ ৭২.৫%।

৩. শিক্ষা খাতে :

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা
ব্যতীত কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। কিন্তু সে শিক্ষা হ’তে হবে নৈতিক
শিক্ষা। শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা হয়ে থাকে, নৈতিকতাহীন শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর। উদ্বেগের বিষয় হ’ল, দেশের শিক্ষাখাত
ঘুষ-দুর্নীতি তথা অনৈতিকতায় জর্জরিত। এটি গোটা জাতির জন্য অশনি সংকেত। শিক্ষাখাতে দুর্নীতি বর্তমানে ‘ওপেন সিক্রেট’। যে দেশের খোদ শিক্ষামন্ত্রী কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ খেতে অনুপ্রাণিত করে সে দেশের শিক্ষা খাতের ঘুষ-দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ হতে
পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিগত ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষা প্রকৌশল
অধিদফতরের এক সভায় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনারা খাবেন, কিন্তু সহনশীল
হয়ে খাবেন। কেননা আমার সাহস নেই বলার যে, আপনারা ঘুষ খাবেন না’। উক্ত
অনুষ্ঠানে মাননীয় মন্ত্রী আরো বলেছেন, নানা জায়গায় এরকম হইছে, সব জায়গাতে
হইছে। খালি যে অফিসার চোর তা না, মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর’। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে মহোৎসব হয়ে গেল তা সত্যিই লজ্জাকর। জাতিকে মেধাশূন্য করার এটি  ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মেডিকেল, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এমনকি প্রাইমারী সমাপনী পরীক্ষার সময়ও দেখা গেছে কোমলমতি ছাত্র/ছাত্রীরা সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিল ছেড়ে কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানে পরের দিনের প্রশ্নের জন্য ভিড় করছে। এর চেয়ে চরম দুর্নীতি আর কি হ’তে পারে? এছাড়াও শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে, পরীক্ষায় নকল করা এবং নকলে সহযোগিতা করা। ক্লাসে ভালভাবে না পড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রাইভেট বা কোচিং করতে বাধ্য করা, ক্লাস ফাঁকি দেয়া,
কারোর প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে প্রাপ্য নম্বরে কম-বেশী করা।

স্বজনপ্রীতি,

দলীয় বিবেচনা অথবা ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়া, প্রতিষ্ঠানের
অর্থ তছরুফ করা, জাল পরীক্ষা সনদ বা জাল শিক্ষক নিবন্ধন সনদ তৈরী করে চাকুরী
করা বা এদেরকে নিয়োগ দেয়া, উচ্চ শিক্ষার নামে বছরের পর বছর ক্লাস থেকে দূরে
থাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নামে মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্য। শিক্ষক নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, একাডেমিক অনুমতি ও স্বীকৃতি, শাখা খোলার অনুমোদন, এমপিওভুক্তি, মিনিষ্ট্রি অর্ডার, জাতীয়করণ, সার্টিফিকেট সত্যায়ন, সাময়িক অথবা দ্বি-নকল সনদ ও নম্বরপত্র প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষাবোর্ড, আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলো যেন ঘুষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কথিত আছে শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা বোর্ড এবং তাদের অধঃস্তন অফিস সমূহের
ইটও নাকি ঘুষ খায়। টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষাখাতে দুর্নীতির হার ৪২.৯%।

৪. স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি :

স্বাস্থ্যখাতে বদলি, পদোন্নতি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানিং সবচেয়ে বেশী হরিলুট চলছে কেনাকাটা, নিয়োগ ও টেন্ডারে। হাসপাতালের সরঞ্জামসহ নানা কিছু কেনাকাটার ক্ষেত্রে রীতিমত তো পুকুরচুরির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এখাতে অ্যাডহক চিকিৎসক
ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬৫ লাখ টাকা, বদলির ক্ষেত্রে
১০ হাযার থেকে ১০ লাখ টাকা, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অসদুপায় অবলম্বন বা ঘুষের বিনিময়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি, কমিশন বা ঘুষের বিনিময়ে প্রেসক্রিপশনে নিম্নমানের ঔষধ লেখা, মেডিকেল টেস্ট থেকে কমিশন নেয়া, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেয়া, সরকারী হাসপাতালগুলোতে ভাল চিকিৎসা সেবা না দিয়ে রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে
চিকিৎসা নিতে প্ররোচিত করা, নিয়মিত ও নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সরকারী হাসপাতালে
রোগী না দেখা, বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগী সংগ্রহের জন্য দালাল নিয়োগ করা, কৌশলে দীর্ঘদিন রোগীর চিকিৎসা করা, সরকারী হাসপাতালে ওটি চার্জ নেয়া, কেবিন বা সিটের জন্য ঘুষ নেয়া, সরকারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি চুরি করা অথবা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রদত্ত অর্থ আত্মসাৎ করা বা নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা, সরকারী ঔষধ চুরি করা, ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেমের মিথ্যা
রির্পোট দেয়া, রোগী মারা যাওয়ার পরেও আইসিইউতে রেখে চার্জ আদায় করা,
মাত্রাতিরিক্ত চার্জ আদায় করা, ভেজাল ঔষধ বিক্রি এবং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে
অতিরিক্ত মূল্য আদায় ইত্যাদি। টিআইবির রির্পোটে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির হার ৪২.৫%।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে :
মজুদদারী, কালোবাজারী, চোরাচালানী, ফটকাবাজারী, মুনাফাখোরী, ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, প্রতারণা, দালালী, ওযনে কমবেশী করা, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজী, খাদ্যে ফরমালিন
ও কেমিকেল মেশানো, ভালো খাদ্যদ্রব্য বা পণ্যের সাথে নিম্নমানের পণ্য মিশ্রণ, পণ্যের দোষ গোপন করা, আমদানী-রফতানীতে কাস্টমস ও বন্দরগুলোতে ঘুষ বাণিজ্য ও মালামাল খালাসে দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি।

৬. ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি :

ঘুষ, জালিয়াতী, দুর্নীতি ইত্যাদিতে ব্যাংকিং খাতও পিছিয়ে নেই। বরং সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া কেলেংকারীগুলো সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে হয়ত
প্রমাণিত হবে দুর্নীতিতে ব্যাংকিং খাত শীর্ষে রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্নীতি হ’ল যে, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে
বেসরকারী ব্যাংকসমূহের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস’ (বিএবি) প্রস্তাব পেশ করেছে। দুর্নীতি লালনকারীদের এ জঘন্য প্রস্তাবের বিরোধিতা করে
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুযযামান  বলেছেন, ‘প্রস্তাবটি শুধু উটপাখি
সম আচরণের বহিঃপ্রকাশই নয়, এটি ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতির
তথ্য গোপন রেখে এসবের সুরক্ষা দেয়া ও আরো বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির অপপ্রয়াস।
কোন অবস্থায়ই এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হ’তে পারে না’।
ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- ঘুষের বিনিময়ে ঋণদান, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, চেক জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং,
অর্থ পাচার, অন্য ব্যাংকের খেলাপি ক্রয়, সিআইবি রিপোর্ট ও গ্রাহকের আবেদনের
আগেই ঋণ অনুমোদন, একই পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা ঋণদান, শাখার বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও ঋণ অনুমোদন, ঋণ খেলাপির নামে পুনরায় ঋণ
অনুমোদন, খেলাপি ঋণের সূদ মওকূফ, ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা না করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাকে দীর্ঘায়িত করা ইত্যাদি, সাম্প্রতিকালের শেয়ার বাজার
কেলেংকারী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা দেশের অন্যান্য দুর্নীতিকে
ম্লান করে দিয়েছে এবং ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
                                                                                                                      [চলবে]