৭. রাজনীতিতে দুর্নীতি :
আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে রাজনীতি ও দুর্নীতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, রাজনীতি ও দুর্নীতি যেন যমজ ভাই।
মূলতঃ এদেশের অনেক রাজনীতিবিদ নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতিকে সযত্নে লালন
করে চলেছেন। তারা যদি দুর্নীতিতে না জড়ান বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেন তাহলে
দুর্নীতি অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে যাবে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা রাজনীতিকরা যদি দুর্নীতি মুক্ত থাকি,
তবে দেশের দুর্নীতি অটোমেটিক্যালি অর্ধেক কমে যাবে’। ইউসিবি পাবলিক পার্লামেন্ট অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার এএফএম আমীনুল ইসলাম বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। রাজনীতিবিদরা যদি সত্যিকার অর্থে চান তাহলে
যেকোন মুহূর্তে দুর্নীতি রোধ করা যায়। কথাগুলো ধ্রুব সত্য। কারণ একটি গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন রাজনীতিবিদরা। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্ত রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। যদি ধরি একজন মন্ত্রীর কথা,
তিনি যদি দুর্নীতিতে না জড়ান তাহ’লে ঐ মন্ত্রণালয়ের সচিবের পক্ষে সম্ভব হবে না
দুর্নীতি করা। আর মন্ত্রী ও সচিব যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকেন এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেন তাহলে মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাহস হবে না দুর্নীতি করার।
এভাবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ যদি চান তাহলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
কিন্তু এগুলো হল স্বপ্নের কথা, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ সরিষার মধ্যেই ভূত
বিদ্যমান।তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে দুর্নীতির ‘আঁতুড়ঘর’ বললেও হয়ত
অত্যুক্তি হবে না। কেননা দেশের প্রতিটি সেক্টর কোন না কোন মন্ত্রীর অধীনস্ত।
এ দেশের রাজনৈতিক ক্যাডারেরা প্রভাব খাটিয়ে প্রায় প্রতিটি সেক্টর থেকেই চাঁদাবাজি করে। উইকিপিডিয়ায় রাজনৈতিক দুর্নীতি বলতে অবৈধ ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য
সরকারী কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহারকে বোঝানো হয়। সরকারী পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির কোন কাজকে কেবলমাত্র তখনই রাজনৈতিক দুর্নীতি বলা হয়,
যখন সেটি তার দাপ্তরিক কাজের সাথে সরাসরি সংশিষ্ট থাকে।
আইনের ছদ্মবেশে:
এটি আইনের ছদ্মবেশে করা হতে পারে বা প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে করা হতে পারে। রাজনৈতিক দুর্নীতির মধ্যে আছে ঘুষ, চাঁদাবাজি, চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতি, সংকীর্ণতা, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রভাব বিস্তার, রাজনৈতিক যোগাযোগ ভিত্তিক সুবিধা লাভ এবং অর্থ আত্মসাৎ। দুর্নীতির কারণে মাদক পাচার, হুন্ডি, মানব পাচার ইত্যাদির মত জঘন্য অপরাধও সহজ হয়। রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন যেমন পুলিশী নিপীড়নকেও রাজনৈতিক দুর্নীতি হিসাবে গণ্য করা হয়। রাজনৈতিক দুর্নীতির মধ্যে আরো রয়েছে, অযোগ্য লোককে নিয়োগদান, হাট-বাজার, নদী-নালা, টোল আদায় ইত্যাদি নিজেদের লোককে ইজারা দান, সন্ত্রাসী, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, মামলাবাজি, চোরাচালানী, কালোবাজারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, হল দখল, সরকারী ভূমি দখল প্রভৃতি।
৮. সামাজিক দুর্নীতি :
দুর্নীতি এখন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে পরিবার ও সমাজ জীবনকেও গ্রাস করেছে। এখন
শুধু প্রশাসনের লোকেরাই দুর্নীতি করছে না, দুর্নীতি করছে পাড়া, মহল্লা ও গ্রামের
উঠতি মাস্তান, মাতববর থেকে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সকলেই। ঘুষ বা উৎচোক দুর্নীতির
প্রধান হাতিয়ার। একে এখন আর ঘৃণার চোখে দেখা হয় না। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে
সমাজের কেউ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলে তাকে কেউ সন্দেহের চোখে বা অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে না। বরং অবৈধ অর্থ-সম্পদ বাড়ার সাথে সাথে সমাজে তার সম্মানও সমানতালে বেড়ে যায়। সমাজের মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, মাহফিল
সর্বত্রই তাদেরকে সভাপতি ও অতিথি হিসাবে আসন দেয়া হয় বড় বড় অনুদান পাওয়ার লোভে। আগের দিনে কেউ সূদখোর ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ লোকের সাথে মেয়ে বিয়ে দিত
না বা আত্মীয়তা করত না। আর এখন উপরি আয়ের ঘুষখোর বর পেলে কনের বাবা
আনন্দে বগল বাজান। এভাবে সামাজিকভাবে ঘুষ ও দুর্নীতিকে লালন করা হচ্ছে।
দুর্নীতি করা ও দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশয় দেয়া ও সম্মান করা সমান অপরাধ।
৯. বিবিধ দুর্নীতি :
উল্লিখিত খাত সমূহ ছাড়াও দুর্নীতির আরো খাত রয়েছে। যেমন তথ্য সন্ত্রাস, হলুদ সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতার অন্তরালে দেশ ও জাতি বিরোধী কর্মকান্ড তথা ব্ল্যাকমেইল করে উৎকোচ আদায়, ঘুষের বিনিময়ে বা রাজনৈতিক কারণে সত্য সংবাদ প্রচার
থেকে বিরত থাকা, সরকারী সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি চুরি ও অপচয়, আয়কর, বিক্রয়কর ও শুল্ক ফাঁকি, ত্রাণের অর্থ ও সামগ্রী আত্মসাৎ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ সরকারী স্থাপনা নির্মাণে পুকুর চুরি, নদী দখল
করে উভয় পাড়ে স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় ও গাছপালা কেটে বন উজাড়, পাহাড়ী প্রাণী
বিক্রি ও পাচার, মানব পাচার, অর্থ পাচার, দেশীয় প্রযুক্তি পাচার, অন্যের ভূমি ও সম্পদ দখল, মিথ্যা সাক্ষী দেয়া ইত্যাদি। চাঁদবাজী, টেন্ডারবাজী, মামলাবাজী ও টোলবাজী
ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়েছে সন্ত্রাসী রূপ, যাকে বলা চলে সন্ত্রাসী দুর্নীতি।
টিআইবির রিপোর্টে বাংলাদেশের ঘুষ ও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র :
বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক পরিচালিত ‘সেবাখাতে দুর্নীতি :
জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে সেবা
গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬.৫% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়, খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৪ হাযার ৫৩৮
টাকা থেকে এক হাযার ৩৯২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাযার ৯৩০ টাকা।
জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৮ হাযার ৮২১.৮ কোটি
টাকা থেকে এক হাযার ৮৬৭.১ কোটি টাকা বা ২১.২% বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে
দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাযার ৬৮৮.৯ কোটি, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয়
বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪% এবং বাংলাদেশের জিডিপির ০.৫%। জরিপে
সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭২.৫%), পাসপোর্ট (৬৭.৩%), বিআরটিএ (৬৫.৪%), বিচারিক সেবা (৬০.৫%), ভূমিসেবা
(৪৪.৯%), শিক্ষা (সরকারী ও এমপিওভুক্ত) (৪২.৯%) এবং স্বাস্থ্য (৪২.৫%)।
ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসাবে ‘ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত
সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটি চিহ্নিত করেছে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৮৯% খানা,
২০১৫ সালে যার হার ছিল ৭০.৯%। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত:
২০১৫ সালের টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে
পাসপোর্ট বিভাগ। প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষকে এখান থেকে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতি
ও ঘুষের শিকার হ’তে হয়েছে। এ খাতের পরের অবস্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী। এ সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হন ৭৪.৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০.৮ শতাংশ মানুষ।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট, বিচারিকসহ অন্তত ১৬টি খাতের
সেবা পেতে বছরে ৮ হাযার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। টিআইবির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৫ সালে প্রাক্কলিত
মোট ঘুষের পরিমাণ ৮ হাযার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতির
শিকার হন ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি ও ঘুষের বোঝা অনেক বেশী। সেবা খাতে
২০১৫ সালের জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয়
বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। সর্বশেষ
২০১২ সালে সেবা খাতের দুর্নীতি জরিপের তুলনায় এবার ১ হাযার ৪৯৭ কোটি
৩০ লাখ টাকা বেশী ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় এবার মানুষের দুর্নীতির শিকারের হার প্রায় ১ শতাংশ ও ঘুষের শিকারের হার ৬ শতাংশ। মানুষ দুর্নীতির
শিকার ও ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এ ছাড়া শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতির
শিকার ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এছাড়া শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতির
প্রকোপ বেশী ও ঘুষের শিকারও হ’তে হয় বেশী। খানা জরিপে উঠে এসেছে, ঘুষ না
দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না ৭১ শতাংশ খানার সদস্য।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের চিত্র :
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ১ম, ২০০৬ সালে ৩য়, ২০০৭ সালে
৭ম, ২০০৮ সালে ১০ম, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে
১২তম ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৪ সালে ১৪তম, ২০১৬ সালে ১৫তম এবং ২০১৭
সালে ১৭তম অবস্থানে ছিল। আন্তর্জাতিক হিসাবে দুর্নীতিতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। এছাড়া এশিয়া
প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। চলবে