দারুল উলুম দেওবন্দ: প্রতিষ্ঠা,প্রেক্ষাপট ও কার্যক্রম

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা,প্রেক্ষাপট ও কার্যক্রম  ঃ

পরিচিতিঃ দারুল উলুম দেওবন্দ। বর্তমান বিশ্বের একমাত্র নিখুঁত ইসলামি মারকাজ৷
ইলমে ওহী বা ইলমে মানকুলের মাকবুল এবং অনন্য দরসগাহ। আউলিয়ায়ে কেরাম
এবং মাশায়িখে হিন্দের একমাত্র রুহানি দীক্ষাগার। মজলিসে শুরা কতৃক পরিচালিত
একটি অনন্য বিদ্যালয়৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্র সৈনিকদের একমাত্র
অবস্থান কেন্দ্রই হলো ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’। বর্তমানে যা ‘আযহারে হিন্দ’ নামেও
খ্যাত৷ উলামায়ে ইসলামের ‘ইখলাস কা তাজমাহাল’ এই দারুল উলুম দেওবন্দ।
এখানেই শেষ নয়৷ দেওবন্দ এমন একটি বৃক্ষ, যেটাকে আল্লাহ প্রেমিকরা তারই ইশারা
ও ইলহামের মাধ্যমেই তার উপর পূর্ণ ভরসা রেখেই একনিষ্ঠতা ও লিল্লাহিয়্যাতকে ধারণ করে রোপণ করেছেন। যার শাখা প্রশাখা আজ ভারতবর্ষ পাড়ি দিয়ে বিশ্বের রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ছে৷পুরো জাতীকে বিলিয়ে দিচ্ছে তার সুবাস। আলোকিত করছে তার
আলোয়। দারুল উলুম দেওবন্দ এমন একটি চিন্তাচেতনার জ্ঞান সমুদ্র, যা নবুওয়াতের
বক্ষ থেকে প্রবাহ হয়ে সাহাবাদের বক্ষ বেয়ে হিন্দুস্তান এসে আল্লামা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর বক্ষ ঘেসে মাওলানা কাসিম নানুতুবি রহ., মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ., মাওলানা ইয়াকুব নানুতবি রাহ. প্রমুখের মাধ্যমে দেওবন্দের পুষ্পবাগানে এসে স্তম্ভিত হয়। এর নদীমালা আজ ভারতবর্ষ অতিক্রম করে বিশ্বের মানচিত্রে বিস্তৃত হয়ে আছে স্বগর্বে। এর ডাল পালা সারা বিশ্বে মাথা উঁচিয়ে জানান
দিচ্ছে তার গৌরবময় উপস্থিতি৷ সমগ্র বিশ্বের ইলম পিপাসুরা এর ইলমের পেয়ালা
থেকে নিবারণ করছে তাদের ইলমের পিপাসা।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটঃ

মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে যখন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ পুরো ভারত বর্ষের ক্ষমতা
নিজ হাতে নিয়ে এ ফরমান জারি করে যে, ‘এখন থেকে বাদশাহ সালামতের রাজ্যে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই হুকুমত চলবে।’ সেই দিন মুসনাদুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. এর সুযোগ্য সন্তান হযরত শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে
দেহলভি রহ. দীপ্ত কণ্ঠে এই ঘোষণা করেন যে- ‘ভারতবর্ষ এখন দারুল হরব তথা শত্রুকবলিত দেশ৷ তাই প্রত্যেক ভারতবাসির উপর ফরজ হলো, একে স্বাধীন করা।
তার এই সাহসী উচ্চারণ পুরো দিক-দিগন্তে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের ন্যায়।
ফলে দিশেহারা মুসলিম জাতি উলামায়ে কেরামেরর নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে সিপাহি
বিপ্লব শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয়, আলেম-উলামার উপর দমন-নিপীড়ন। হাজার হাজার আলেম-উলামাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দিল্লির প্রতিটা অলিগলি আলেম ওলামার রক্তে রঞ্জিত হয়। এহেন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ইসলামের নামটুকু হয়তো আর বাকি থাকবে না। বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যত আরো খতরনাকই হবে।
জাতীর এ ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরলেন যুগের সীপাহসালার মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ.৷
তার চিন্তায় এলো একদল দীক্ষাপ্রাপ্ত সচেতন মুজাহিদ তৈরি করে তাদের মাধ্যমে
আযাদি আন্দোলনের স্রোতধারাকে ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়াই
উপযুক্ত হবে। তাই দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা, শলা-পরামর্শের পর সাময়িকভাবে সশস্ত্র
সংগ্রাম বন্ধ রেখে সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায়
উজ্জীবিত, দীনি চেতনায় উৎসর্গ একদল জানবায মুজাহিদ তৈরির লক্ষ্যে এবং
ইলমে নববির সংরক্ষণ ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দেওবন্দ নামক এলাকার ঐতিহাসিক সাত্তা মসজিদ প্রাঙ্গনে একটি
ডালিম গাছের ছায়ায়, ইলহামিভাবে কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে প্রতিষ্ঠা করা হয় আজকের দারুল উলুম দেওবন্দ।

দারুল উলুম প্রতিষ্ঠাঃ

১৮৬৬ ঈসায়ী সাল মোতাবেক ১২৮৩ হিজরি সনে হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলায় দেওবন্দ নামক গ্রামের মহল্লায়ে দেওয়ানে স্বীয় শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসেন। বাড়ি সংলগ্ন সাত্তা মসজিদের ইমাম ছিলেন হযরত মাওলানা হাজী আবিদ হোসাইন সাহেব রহ.৷ পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত, দীনি চেতনায় উৎসর্গ একদল জানবায মুজাহিদ তৈরির লক্ষ্যে এবং ইলমে নববির সংরক্ষণ ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে তার সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ.৷ আলোচনা হওয়ার পর সেখানেই একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন তারা। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মিরাট থেকে মোল্লা মাহমুদ সাহেবকে ডেকে এনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। অবশেষে ১৮৬৬ ঈসায়ী সালের ৩০ মে মোতাবেক ১২৮৩ হিজরির ১৫ই মুহাররম রোজ বুধবার সাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহাসিক দ্বীনি দরসগাহ উদ্বোধন হয়।