দারিদ্র বিমোচনে এনজিওদের থেকে কওমি মাদ্রাসা ‘র অবদান বেশি!
দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এনজিওর চেয়ে দেশের কওমি মাদ্রাসা গুলোর ভূমিকা অধিক ও বেশি কার্যকর। শিক্ষাদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে
কওমি মাদ্রাসা গুলোর নিজস্ব একটা মডেল আছে। এই মডেল নিয়ে খুব বেশি আলাপ আলোচনা হয়নি। মাদ্রাসা গুলোকে অনেকেই সেকেলে, ধর্মব্যবসায়ীদের আস্তানা,
জঙ্গী তৈরির কারখানা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু পুরো কাঠামো এবং
সমাজে এর প্রভাব নিয়ে ওইভাবে কথাবার্তা হয় না।বস্তুত:এনজিওর বিপরীতে কওমী
মাদ্রাসা সামাজিক অর্থায়নের সফল উদাহরণ হচ্ছে কওমী মাদ্রাসা। কওমী মাদ্রসাগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি দেখভাল করে। প্রথমত, দেশের প্রান্তিক গোষ্ঠীর সন্তানদের এরা বিনামূল্যে পাঠদান, বইপত্র ও শিক্ষাউপকরণ সরবরাহ, আবাসন সুবিধাদানসহ
খাবার প্রদান করে। শিশু হিসাবে মাদ্রাসায় প্রবেশ করে হাফেজ, আলেম, মাওলানা,
মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির হিসাবে বের হয়ে সারা দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকতা
শুরু করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। এবং এই শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরিই
সামাজিক দানের উপর নির্ভরশীল। মূলত যাকাত, ফেতরা, কুরবানীর পশুর চামড়াসহ বিভিন্ন জনের স্বত:স্ফূর্ত দান ও সহায়তায় এসব মাদ্রাসা চলে। এটাকে সামাজিক দান
বলা হলেও মূলত এটা সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট।
অনেক মাদ্রাসা ‘য় অন্যান্য সুবিধাও আছ।
কিছু কিছু মাদ্রাসায় একই সঙ্গে প্রি স্কুলিং, স্কুল এবং আফটার স্কুল কেয়ার বা স্কুল ও ডে কেয়ারের সুবিধা আছে। ফলে অভিভাবকরা অনেকেই শিশুকে মাদ্রাসায় দিয়ে কাজে
যেতে পারেন। বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের এটা বিশেষ সুবিধা সৃষ্টি করেছে।
বাচ্চা লালন পালনের আলাদা অর্থ কিংবা শ্রম লাগে না।
এদের ব্যবস্থাপনা সরকারি স্কুলের থেকে ভালো। একটা উদাহরণ দেই। সরকার স্কুল ফিডমিল চালু করার জন্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা খরচ করছে। ২০১৩ সালে শুরু হলেও
৯ বছর পরও সরকার সব স্কুলে এই কর্মসূচি শুরু করতে পারে নাই। এই উদ্যোগে
সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তা পেয়েছে। আমাদের আমলারা বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন ফিডমিল সরাসরি দেখে শিক্ষা লাভের জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি। বর্তমানে সরকার স্কুল ফিডমিল চালুর জন্য ২,৫০০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
এই প্রকল্পে খিচুড়ির প্রস্তাব নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছে। এই বছরের কোনো এক সময়
এই প্রকল্প শুরু হতে পারে।
বিপরীতে মাদ্রাসা ‘র দিকে একটু নজর দিন।
দেখবেন এই মাদ্রাসাগুলোতে কমবেশি ২০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। এদের বেশির ভাগই আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনবেলাই এরা মাদ্রাসায় খাওয়া দাওয়া করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে ফিড মিলের মডেল আমাদের চোখের সামনেই আছে। আর সরকার এত এত
দক্ষজনবল দিয়ে কর্মসূচি মাঠে নামাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ শূন্য। সরকার ও বেসরকারি এনজিওর শূন্য বিনিয়োগে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের এমন এন্ড টু এন্ড মডেল বিরল। এবং এই মডেল খুবই টেকসই।
কওমী মাদ্রাসা ও এনজিও; উভয়েই একে অপরের সমালোচক । মাদ্রাসাগুলো মনে
করে এনজিওরা সমাজ ও ধর্মকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ
হচ্ছে ধর্মান্তকরণের। অপরদিকে এনজিওরা মনে করে মাদ্রাসগুলো নারী স্বাধীনতা
ও অধিকারের পথ রুদ্ধ করে রাখছে। সমাজে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরিতে
মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা জোরালো। মূলত মুখোমুখী অবস্থানের কারণেই দুই প্রতিষ্ঠান
নিয়ে লেখার আগ্রহ। এই দুইটি প্রতিষ্ঠান বিপরীত অবস্থানে থেকে কীভাবে কাজ করে, একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তা দেখার জন্য দারিদ্র বিমোচনে দুই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে লিখছি স্বল্প পরিসরে।
সবাই দানের টাকাতেই চলে এটা সত্য। কিন্তু কেবল মাদ্রাসার ক্ষেত্রেই বলা হয় এরা
দান খয়রাতের পয়সায় চলে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাইকিং করে অর্থ উত্তোলন করে,
তাই একে আমরা ভিক্ষাবৃত্তি মনে করি। আর কর্পোরেট লোকজন অনলাইনে ব্যাংক ট্রান্সফার করে বিধায় বিদ্যানন্দকে অর্থ দান করাকে ডোনেশন বলি। আর বিদেশ
থেকে টাকা পায় বলে এনজিওর অর্থকে আমরা ফরেন এইড বলি। তিনটাই কার্যত
দানের টাকা।
ইহলৌকিক কাজকর্মকে নিরুৎসাহিত করে মাদ্রাসা ‘গুলো
অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করেন। এটা ভুল ধারণা। মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামিক
থিওলজি পড়ানো হয়। থিওলজি পঠন পাঠের ফলাফলের প্রয়োগ কিন্তু ইহজগতেই
করা হয়। পরকালে এই জ্ঞানের প্রয়োগ সম্ভব নয়। ইসলাম বৈরাগ্যবাদকে সমর্থন
করে না। বরং আমল করতে বলে। আমল মানে কেবল নামায, রোযা, হজ্জ বা
যাকাত না। বরং পুরো জীবনটাই আমলে পরিপূর্ণ। বড় আলেম হলেই হবে না।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনও আমলের অংশ। এই আমলে উপর
পরকাল নির্ভর করে ইসলামের ব্যখ্যা অনুসারে।
এটাও ভুল ধারণা। উৎপাদন মানেই কেবল কলকারখানা বা কৃষি উৎপাদন নয়।
শ্রমও পণ্য। এটাও উৎপাদিত হয়। মাদ্রাসাগুলোকে ঘিরে বড় ধরনের শ্রম উৎপাদন
হয়। হতে পারে এই শ্রমের মূল্য কম। কিন্তু মাদ্রাসাগুলোকে ঘিরে বড় ধরনের
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়। জ্ঞান বা নলেজকেও সম্পদ ও ক্ষমতা হিসাবে
গণ্য করা হয়। এই সম্পদের লেনদেন হয়। মাদ্রাসাগুলোতে জ্ঞান চর্চা করা হয়।
এখন আপনার পছন্দ না বলে এটাকে বাতিল করতে চাইছেন। কিন্তু কওমী মাদ্রাসার
অনেক শিক্ষার্থীর দক্ষতা অনেক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি।
সমাজ ও দর্শন নিয়ে এরা বেশ গভীরে গিয়ে পড়াশোনা করে।
মাদ্রাসা ও এনজিওদের পরিচালনা ব্যয়
মাদ্রাগুলো সংগৃহীত অর্থের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের জন্যই খরচ করে। বিপরীতে এনজিওগুলোও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু সংগৃহীত
অর্থের ৮০ শতাংশ অর্থ এনজিওরা পরিচালনা ব্যয় হিসাবে খরচ করে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এনজিওগুলোর থেকে মাদ্রাসাগুলো বেশি বিনিয়োগ বা খরচ করে তাদের প্রোগ্রামের জন্য। যে কারণে মাদ্রাসার শিক্ষকরা খুবই কম বেতন পান। আর এনজিও কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ৬ ডিজিটের বেতন পান অনায়াসেই।