ঘুষ ও দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার : একক কোন কারণে দুর্নীতি হয় না। দুর্নীতির
বহুবিদ কারণ রয়েছে এবং এর প্রতিকারেরও বিভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন-
১. ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব :
ঘুষ ও দুর্নীতির প্রধান ও মুখ্য কারণ হল জবাবদিহিতার অনুভূতি। জবাবদিহিতা
দু’প্রকার : (১) ইহকালীন জবাবদিহিতা (২) পরকালীন জবাবদিহিতা। ইহকালীন
জবাবদিহি বলতে জনগণ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহিতা বুঝায়।
ছলে-বলে-কৌশলে মানুষ অনেক সময় এ জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পায় বলেই ঘুষ
ও দুর্নীতি প্রতিটি সেক্টরেই সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কৌশলে ইহকালীন জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেলেও পরকালীন তথা আল্লাহর নিকট
জবাবদিহিতা থেকে কোনভাবেই রক্ষা পাওয়া যাবে না। মূলতঃ ইহকালীন অসৎ
কর্মকান্ডের বিষয়েই পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। এ অনুভূতি কারো মাঝে
জাগ্রত থাকলে সে কখনো ঘুষ লেনদেন ও অন্যান্য দুর্নীতি করতে পারে না। মহান
আল্লাহ পরকালীন জবাবদিহিতার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার
পালনকর্তার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন’ (বুরূজ ৮৫/১২)।
মানুষ তার দুর্নীতিকে দুনিয়ার মানুষের নিকট থেকে লুকাতে পারলেও আল্লাহর নিকট
থেকে কিছুতেই লুকাতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি জানেন তোমাদের
চোখের চুরি ও অন্তরের লুকানো বিষয়সমূহ’ (মুমিন ৪০/১৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,
‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু
পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তাদের বিষয়ে বিজ্ঞাসিত হবেন। একজন পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের দায়িত্বশীল, সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।
স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।
আর কৃতদাস আপন মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে বিষয়ে
সে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ
নিজ দায়িত্ব সম্পাদনে জিজ্ঞাসিত হবে’। হাশরের মাঠে আদম সন্তান আল্লাহ তা‘আলার পাঁচটি প্রশেণর জবাব না দিয়ে এক পাও সামনে এগুতে পারবে না। তার মধ্যে একটি
প্রশ্ন হল ‘সে তার সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে যে, সে কিভাবে তা অর্জন করেছে
এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে’।
২. হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করা :
ঘুষ ও দুর্নীতির আরেকটি অন্যতম কারণ হল হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
‘হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। অন্য হাদীছে এসেছে, ‘অতঃপর
তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন। যে দীর্ঘ সফর করছে। যার চুল উষ্কখুষ্ক, কাপড় ধূলিমলিন। সে আকাশ পানে দু’হাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক!
হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারা দেহ গঠিত। কাজেই এমন ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হ’তে পারে’?
উল্লেখিত হাদীছ মেনে চললে ঘুষ ও দুর্নীতি বিদূরিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
৩. ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া :
কোন অপরাধ করা সত্ত্বেও যদি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহ’লে অপরাধীরা
সে অপরাধ করতে আরো বেশী উৎসাহিত হয়। একই কারণে প্রতিটি সেক্টরে আজ
ঘুষ ও দুর্নীতি বিষবাষ্পের মত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের চোখের সামনে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়লেও প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিকার।
কেননা অনেকাংশে তারা নিজেরাই এর সাথে সম্পৃক্ত। ২০১৭ সালের টিআইবির
রিপোর্টে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ
হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত
করা গেলে ঘুষ ও দুর্নীতি অনেকাংশেই হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা :
দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকার উপর অনেকটাই নির্ভর করে ঘুষ ও দুর্নীতির
হ্রাস-বৃদ্ধি। দলমত নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে ঘুষ ও দুর্নীতি দমনে যদি দুর্নীতি দমন কমিশন আন্তরিক হত, তাহলে দুর্নীতি দেশ থেকে বিদায় নিত। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হল প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখা যায় দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন অবস্থায় যে এমপি, মন্ত্রী, নেতা, আমলা দুর্নীতির জম হিসাবে পরিচিত হন, তিনিই ক্ষমতাহীন হওয়ার পর শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিত হন এবং
তার নামে ডজন ডজন মামলা হয়।
৫. আইন প্রণয়ন করে দুর্নীতি লালন :
অনুমতি ছাড়া সরকারী কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না, এমনই আইন পাস
হয়েছে মন্ত্রীসভায়। এই আইনের ফলে ফৌজদারী মামলায় কোন সরকারী কর্মচারীকে পূর্বানুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না। তবে কোন মামলায় কোন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হ’লে কোন অনুমতি ছাড়াই তাকে গ্রেফতার
করা যাবে। এই আইন পাসের ফলে দুদক ফাঁদ পেতে কোন সরকারী কর্মচারীকে
গ্রেফতার করতে পারবে কি-না? এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, চার্জশীট
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নতুন আইনের ফলে দুদক আইন বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত
হবে না কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাধাগ্রস্ত না হ’লেও কিছুটা বিলম্বিত হবে।
নতুন এই আইনের মাধ্যমে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার পথকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন। কেননা চার্জশীটের
আগে তাদেরকে গ্রেফতার না করার ফলে তারা স্বপদে বহাল থেকে প্রভাব খাটিয়ে বা বিভিন্নভাবে তদবীর করে চার্জশীটকে হাল্কা বা তা থেকে অব্যাহতি লাভের যথেষ্ট সুযোগ পাবে। ফলে দুর্নীতি হ্রাস না পেয়ে বরং আরো বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবতাও তাই। সুতরাং
দুর্নীতির প্রতিকার বা প্রতিরোধ করতে হ’লে অবিলম্বে এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন।
৬. রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি :
সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় অল্প সময়ের মধ্যে ঘুষ ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি। কারণ হাযারো দুর্নীতি করেও পার পাওয়া যায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। আবার অনেকেই দুর্নীতি না করেও দুর্নীতিতে ফেঁসে যায় রাজনৈতিক কারণে। একেই বলে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’। ঘুষ ও দুর্নীতি মুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে
চাইলে রাজনীতিবিদদের দ্বারাই সেটা সম্ভব। সুতরাং ঘুষ ও দুর্নীতি প্রতিকারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই।
৭. ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে সামাজিক প্রতিরোধ :
ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ না থাকায় তারা এ ধরনের
অপকর্ম করতে প্ররোচিত হয়। আগের দিনে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদেরকে ঘৃণার চোখে
দেখা হত। তাদেরকে সমাজের কোন সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করা হ’ত না, তাদের সাথে আত্মীয়তা করা হ’ত না। বর্তমান দৃশ্যপট পুরোটাই উল্টো। বর্তমান সমাজে এদেরকে ঘৃণা করা তো দূরের কথা, সমাজের প্রতিটি সম্মানজনক আসনে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের সমাসীন করা হয় তাদের অঢেল অবৈধ টাকা হ’তে অনুদান পাওয়ার আশায়। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় মেয়ের পিতারা তাদেরকেই জামাই হিসাবে গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এতে তারা আরো দুর্নীতি করতে প্ররোচিত হয়। সুতরাং
ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করতে চাইলে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে
তুলতে হবে। এতে যার যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে ততটুকু প্রয়োগ করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অসৎ কাজ (অন্যায়-দুর্নীতি) সংঘটিত হতে দেখলে, সে যেন উহা হাত দ্বারা তথা শক্তি প্রয়োগে প্রতিহত করে। এতে সক্ষম না হ’লে সে যেন কথার মাধ্যমে প্রতিবাদ করে। তাতেও সক্ষম না হ’লে সে যেন আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে। আর এটাই হ’ল সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক’।
৮. গণসচেতনতা :
ঘুষ ও দুর্নীতি সম্পর্কে জনগণ সচেতন না থাকায় তা মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে।
তাই ঘুষ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চাইলে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ায মাহফিল, জুম‘আর খুৎবা ইত্যাদির মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি
করতে হবে। এছাড়া ঘুষ ও দুর্নীতি বিরোধী পোস্টার, লিফলেট ও স্টিকারের মাধ্যমে দুর্নীতি বিরোধী জনমত সৃষ্টি করা যেতে পারে।
৯. নিরপেক্ষ অডিট ব্যবস্থা :
অফিস-আদালত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ও নিরপেক্ষ অডিট
ব্যবস্থা না থাকায় ঘুষ ও দুর্নীতি বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসনের মত মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার কারণে খাদ্যে, পণ্যে ও ঔষধে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও দ্রব্য বিক্রিসহ নানা ধরনের দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তবতা হল
যারা অডিট করতে আসেন তারা অধিকাংশই ঘুষের বিনিময়ে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেন
এবং মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোও ঘুষের বিনিময়ে নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য, পণ্য ও ঔষধ উৎপাদনকারী কোম্পানীকে অনুমোদন দিয়ে থাকে। আর একেই বলে দুর্নীতির উপর দুর্নীতি। এমনও দেখা যায় মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন না নিয়েই অনেক
কোম্পানী খাদ্য, পণ্য, ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন করে থাকে। কিন্তু মাননিয়ন্ত্রণকারী
সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘুষের বিনিময়ে এ ক্ষেত্রেও নীরব ভূমিকা
পালন করে। সুতরাং ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতিকার করতে হ’লে সৎ, যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল লোকদেরকে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি
নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে সময়োপযোগী বেতন-ভাতা :
প্রবাদ আছে, ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’। চলমান বাজারের সাথে মানানসই বেতন-ভাতার
ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেকেই ঘুষ খেতে ও দুর্নীতি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদমর্যাদা ও দ্রব্যমূল্য সামনে রেখে সম্মানজনক জীবন-জীবিকা উপযোগী বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সুইডেনে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেশী বলে সেখানে দুর্নীতি কম। অনেক ক্ষেত্রে
দেখা যায়, দুর্নীতির সূচনা হয় Due to need এর মাধ্যমে। পরে তা Due to greed এ পর্যবসিত হয়। আর্জেন্টিনা এবং পেরুতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-
ভাতা বৃদ্ধি করে দেয়ার পর সেখানে দুর্নীতির মাত্রা অনেক কমে গেছে।
১১. দুর্নীতিই দুর্নীতি ডেকে আনে :
যে সকল চাকুরীজীবি মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেয়, তারা চাকুরীতে প্রবেশ
করেই ধান্ধায় থাকে কিভাবে প্রদত্ত টাকা ফেরত পাওয়া যায়। তাই তারা ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে ঘুষ ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তার দেয়া ঘুষের সমপরিমাণ টাকা ফেরত পাওয়ার পরেও তা থেকে ফিরে আসতে পারে না অভ্যস্থ
হয়ে যাওয়ার কারণে। কেউ কেউ এ সমস্ত অপকর্ম থেকে ফিরে আসতে চাইলেও
ফিরে আসতে পারে না ঘুষখোর দুর্নীতিপরায়ণ সহকর্মীদের কারণে। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে
ফিরে আসতে চাইলে সহকর্মীরা তাকে ভয় দেখায় তার বিগত অপকর্মগুলো ফাঁস
করে দেয়ার। আর এভাবেই কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং চাকুরী গ্রহণকালে ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করা গেলে ঘুষ ও দুর্নীতি অনেকটাই হ্রাস পাবে।
১২. সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ :
দুর্নীতির অন্যতম কারণ হচ্ছে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ
ও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দান। অথচ প্রশাসনকে দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে
রক্ষা করার জন্য ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ লোককে নিয়োগ করা।
আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, ‘অতঃপর মেয়ে দু’টির একজন বলল, হে পিতা!
একে কর্মচারী নিযুক্ত করুন! নিশ্চয়ই আপনার কর্মসহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে,
যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২৬)। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার
যথার্থ হকদারগণের নিকটে পৌঁছে দাও’ (নিসা ৪/৫৮)।
১৩. ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব :
ঘুষ ও দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ হ’ল যথোপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। ধর্মীয়
শিক্ষা মানুষকে সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও নীতিবান হ’তে শেখায় এবং ঘুষ ও দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। তাই তারা এ সকল অন্যায়-অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। পক্ষান্তরে ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে স্বার্থবাদী, ভোগবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হতে
প্ররোচিত করে এবং পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে উদাসীন হ’তে শেখায়। তাই তারা
দুর্নীতি করতে পরোয়া করে না। সুতরাং ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের আবশ্যিক
পূর্বশর্ত হ’ল ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা।
সমাপনী :
ঘুষ ও দুর্নীতি দেশ ও জাতির জন্য চরম অভিশাপ। দেশের সুনাম-সুখ্যাতি ও মর্যাদা ঘুষ
ও দুর্নীতির কারণে বিপন্ন ও ভূলুণ্ঠিত। সুতরাং সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে
ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ঘুষ ও দুর্নীতি একেবারে মূলোৎপাটন হবে না কিছুতেই যতক্ষণ না সরকার, প্রশাসন ও সমাজের দায়িত্বশীলগণ দ্বীনদার, পরহেযগার, তাক্বওয়াসম্পন্ন না হবেন। কারণ একমাত্র আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতিই পারে ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে সমাজকে রেহাই দিতে। যার বাস্তব উদাহরণ হল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদার সময়কার ইসলামী রাষ্ট্র। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মারামারি-হানাহানিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত
আইয়ামে জাহিলিয়াতের গাঢ় অন্ধকার অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়ে
বিশ্বের সবচেয়ে আদর্শ, নিরাপদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল চিরশান্তিময় ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে তাক্বওয়া অবলম্বন করার কারণে।
তাই সরকার, প্রশাসন ও সমাজের সকলকে সত্যিকার তাক্বওয়াশীল হওয়ার জন্য
আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন- আমীন!