ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্বারোপ করেছে। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম
হতে বিরত থাকতে সকলকে তাগীদ দিয়েছে। সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের সুরম্য প্রাসাদকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে সক্ষম এমন বিষয়গুলির অন্যতম
হল পরনিন্দা বা গীবত। এর মাধ্যমেই শয়তান সমাজে ফাটল ধরিয়ে থাকে।
গিবত বা পরনিন্দা ব্যাভিচারের চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ। গীবত পরনিন্দা মানুষের ঈমান ও আমল ধ্বংস করে দেয়। পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ দূর করে দেয়। ইসলামে কাউকে সামনে
থেকে নিন্দা করাও মারাত্মক অপরাধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পেছনে ও
সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০১)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা সামনে-পেছনে কারো নিন্দা বা গিবত করা অথবা সামনাসামনি কাউকে দোষারোপ করা ও মন্দ বলা জঘন্য পাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এর শাস্তিও ভয়াবহ। একই সুরায় শাস্তির কথা বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (জাহান্নামের একটি স্তর)। আর কিসে তোমাকে জানাবে হুতামা কি? আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন। যা হৃদপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদের আবদ্ধ করে রাখবে।প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে। ’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০৪)
গীবত এর সংজ্ঞা:
গীবত শব্দের আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা, পরচর্চা করা, দোষারোপ করা, কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ। ইবনুল আছীর বলেনঃ “গীবত হল কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে, যদিও
তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে”। এসব সংজ্ঞা মূলত হাদিস হতে নেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্
(সা:) গীবতের পরিচয় দিয়ে বলেনঃ “গীবত হল তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে।” আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আন্দাজ-অনুমান থেকে বেঁচে থেকো। কেননা অনুমান করে কথা বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। (বুখারি, হাদিস নং: ২২৮৭; মুসলিম, হাদিস নং: ২৫৬৩)
পরনিন্দার দুইটি স্তর,
গীবত ও তুহমত (অপবাদ)। একবার রাসুল (সা.) সাহাবিদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা
কি জান গিবত কাকে বলে? তারা উত্তরে বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।
তখন তিনি বলেন, গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কোনো কথা বলা, যা শুনলে
সে অপছন্দ করবে। সাহাবারা জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি সত্যিই তার
মধ্যে সেই দোষ থাকে তাহলেও কি গিবত হবে? রাসুল (সা.) বলেন, যদি সত্যিই তার
মধ্যে সেই দোষ থাকে, তবে তা গিবত হবে। আর যদি তার মধ্যে সেই দোষ না থাকে,
তবে তা তুহমত (অপবাদ) হবে। যা গীবত থেকেও মারাত্মক গুনাহ।
(মুসলিম, হাদিসনং : ২৫৮৯)
পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা আওয়াম হই আর খাওয়াস সবাই এ জঘন্য কাজগুলোতে লিপ্ত। অফিস, বাজার কিংবা রাস্তা ঘাটে পরনিন্দার চর্চা হয় হরহামেশা। অত্যন্ত দূঃখের
কথা হলো, আল্লাহর ঘর মসজিদও এ অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমদের নৈদিকতার এতই অবক্ষয় হয়েছে যে, মসজিদে বসেও আমরা অপর মুসল্লিকে নিয়ে
কটুক্তি করে থাকি। অন্যের আড়ালে তাকে নিয়ে হাসা-হাসি করি। এগুলো আমাদের
কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে
বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন
অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম।
আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ
উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতইনা নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা
করে না, তারাই তো জালিম। (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১১)
যেসব ক্ষেত্রে গীবত করা যায়
গিবত বা অন্যের দোষচর্চা করা মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু কখনো কখনো কোনো ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে ব্যক্তি, দেশ কিংবা জাতিকে বাঁচাতে গিবত করা আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।
যেমন, কোনো ব্যক্তি মানুষের ঈমান ধ্বংস করার প্রোপাগাণ্ডা চালালে, সূক্ষ্ণভাবে সাহাবাদের ব্যাপারে বিদ্বেষ ছড়ালে—জাতিকে সচেতন করতে তাদের দোষগুলো
মানুষকে জানিয়ে দেওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে গিবত করা জায়েজ।
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসুল (সা.) এর নিকট বসে ছিলাম। তখন
জনৈক ব্যক্তি আমাদের সামনে হাজির হলো। ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বললেন,
‘এ ব্যক্তি তার গোত্রের খারাপ লোক। ’ আয়েশা (রা.) বলেন, একথা শুনে আমি জড়সড়
হয়ে বসে গেলাম। কারণ ওই ব্যক্তি খারাপ লোক তাই সতর্ক থাকা দরকার। রাসুল (সা.) অভ্যাসমতো ওই ব্যক্তির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ কথোপকথন করতে লাগলেন।
সে ব্যক্তি চলে যাওয়ার পর আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা
আপনি বললেন, ওই ব্যক্তি খারাপ লোক। তথাপি তার সঙ্গে এত সুন্দর করে নরম
ভাষায় কথা বললেন, পাশে বসালেন, এটি কেমন কথা! তখন রাসুল (সা.) বললেন,
‘দেখো! ওই ব্যক্তি খারাপ লোক তাই লোকেরা তার চরিত্রের আক্রমন থেকে বাঁচার
জন্য তাকে নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়। এমনটা না করলে সে ফেতনা সৃষ্টি করে
বসতে পারে। এজন্য আমি আমার অভ্যাস অনুযায়ী তার
সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলেছি। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৬০৩২)
কিন্তু যদি কেউ কারো সম্ভ্রমহানীর উদ্দেশে তার দোষচর্চা করে। তবে এই গিবত তার সারা জীবনের আমলকে তুচ্ছ করে দিতে পারে। আটকে দিতে পারে জান্নাতে যাওয়ার পথ।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানী বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই (দুনিয়াতে থাকতেই) তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়, ওই দিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো নেক আমল থাকলে সেখান থেকে জুলুমের সমপরিমাণ তার থেকে কর্তন করে নেয়া হবে। আর তার কোনো নেক আমল না থাকলে মাজলুমের গুনাহের কিছু অংশ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ২২৮৭)
যারা অহেতুক অন্যের দোষচর্চায় লেগে থাকে
কোরআনে কারিমে তাদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তুমি আনুগত্য করো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্চিত। পিছনে নিন্দাকারী ও যে চোগলখুরী করে বেড়ায়। ভালো কাজে বাধা দানকারী, সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ। দুষ্ট প্রকৃতির, তা ছাড়া নিচু বংশীয় (কোনো কোনো অনুবাদে ‘যানিম’ এর অর্থ ‘নিচুবংশীয়’ এর স্থলে ‘জারজ’ও করা হয়েছে)। ’ (সুরা ক্বালাম, আয়াত: ১০-১৩)
কেউ কারো দেখাদেখিতে তাল মিলাতে গিয়েও পরনিন্দা করে। নিজের সঙ্গী কারো সম্পর্কে কেউ মন্দ আলোচনা করলে তখন সে নিজেও তার বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে অথবা সে তার উপর নারাজ হবে এ ভয়ে তারা পরনিন্দাকে সমর্থন করে। কেউ কেউ কোন কারণ ছাড়াই কারো প্রতি অপরের মন বিষিয়ে তোলার জন্য দোষ বর্ণনা করে। মনে রাখতে হবে, কারো প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা তার কার্যকলাপ নিয়ে হাসাহাসি করাও পরনিন্দা।
কারো দৈহিক, চারিত্রিক, বংশগত, পেশাগত, ব্যক্তিগত ত্রুটি অথবা কাজ, আচার-আচরণের কথা বর্ণনা করা অথবা নিন্দা করাও পরনিন্দা। আবার এটা শুধু মুখে বলার উপর নির্ভর করে না বরং আকার ইঙ্গিতে অপরের দোষ প্রকাশ করাও পরনিন্দা। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা এক মহিলা রসুল (স.) এর কাছে আগমন করলো, যখন সে চলে গেলো তখন আমি বললাম, যে মহিলাটি এখানে এসেছিল সে বেঁটে। রসূল (স.) বললেন, তুমি গীবত করলে। হাদীস শরীফে এসেছে শ্রোতা ও পরনিন্দাকারীদের একজন কোন জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান, ঈমাম, কামেল, ফাজেল অথবা যে কোন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির কাছে কারো সম্পর্কে নিন্দা করছে, তিনি কোন প্রকার বাঁধা প্রদান না করে নীরবে শুনতেন, কোন প্রতিবাদ করতেন না। কারণ পরনিন্দা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করাও পরনিন্দা এতে পরনিন্দাকারী আরোও উৎসাহিত হয়।