স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
জনসংখ্যার অধিক চাপে ফসলি জমি উজাড় করে তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি।
হরদম কাটা হচ্ছে গাছপালা। মানছে না কেউ নিয়ম-নীতি। তাই পরিবেশ আজ
হুমকির মুখে। ব্যাপক হারে গাছপালা ও ফসলি জমি বিলীন হতে থাকলে প্রাকৃতিক
দুর্যোগে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।খাদ্য সমস্যা একসময় প্রকট আকার ধারণ করবে।
পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর বিকল্প নেই। আগেকার দিনে
চারদিকে যে গাছপালা দেখা যেত, তার তিনভাগের একভাগও এখন দেখা যায় না।
এমন চলতে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশ এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব
পড়বে। এমনিতেই বর্ষা মওসুমে পানিতে ডুবে যাওয়ার সতর্কবাণী দেয়া হচ্ছে।
সবুজ শ্যামল এ দেশটা আগের মতো নেই। যেসব গুণের কারণে আমাদের
এ দেশকে সবুজ-শ্যামল বলা হতো তা হল চারদিকে ঘন গাছপালা আর সবুজের
সমারোহ। এখন সেই সবুজ-শ্যামল রূপ খুব কমই চোখে পড়ে। গাছপালা ও
ফসলি জমি ধ্বংসের কারণে পাখপাখালিও আগের মতো দেখা যায় না। গাছপালা
কাটার ফলে পাখিদের আশ্রয়স্থল কমে যাচ্ছে। হরদম গাছপালা কাটা হলে
পাখিদের বংশবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বেপরোয়াভাবে কেউ গাছপালা কাটলে তেমন কোনো প্রতিবাদও হয় না এখন।
ফলে নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের মিছিলে নেমে পড়ছে অসাধু চক্র। তাই পরিবেশগত
সমস্যা বেড়েই চলেছে।
‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’- এই হোক আমাদের প্রাণের স্লোগান।
ফসলি জমি ও গাছপালা বিনষ্ট করে দালানকোঠা নির্মাণ করার ফলে একসময় দেশে
দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তাছাড়া এভাবে গাছপালা কমতে থাকলে মানুষ অক্সিজেনের
অভাবে ভুগবে। বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধবে।
আগে গাছে যে পরিমাণ ফল পাওয়া যেত, এখন আর সে পরিমাণ ফল পাওয়া যায় না। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে আম, জাম, লিচু, কাঠাল, পেয়ারা, ছফেদা, লেবু, সুপারি, নারিকেলসহ হরেক প্রজাতির ফল উৎপাদিত হতো। এখন যে পরিমাণ ফল
উৎপাদন হয়, তা দিয়ে মানুষের চাহিদাই পূরণ হয় না। কারণ এসব গাছ এখন
আর আগের মতো দেখা যায় না। ফলবান বৃক্ষ নিধন করে মানববসতি গড়ে তোলা
হচ্ছে।
সেই দিন আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য দরকার অধিক হারে বৃক্ষরোপণ।
গাছে গাছে, ফুলে-ফলে ভরে উঠুক আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা। স্কুল প্রতিষ্ঠানে,
বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
বৃক্ষ নিধনের মিছিল এভাবে চলমান থাকলে মানবজীবন হুমকির মুখে পড়বে,
পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।
তাই গাছ লাগিয়ে পরিবেশ এর ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।
স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
আর ভারসাম্যপূর্ণ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বৃক্ষের।
বৃক্ষ শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়; বরং ধর্মীয় কারণেও মানুষের বৃক্ষরোপণ
করা চাই। মহানবী (সা.) পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও তা পরিচর্যার
কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন হাদিসে উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার
২৫ শতাংশই বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের কল্পনা করা অবান্তর।
ইসলাম সঙ্গত কারণেই পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে উৎসাহিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতিক পরিবেশ নিয়ে কোরআনের বর্ণনা
আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি
ও সবুজ-শ্যামল সৃষ্টি করেছেন।
বনভূমির মাধ্যমে পৃথিবীকে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন।
গাছপালার মাধ্যমে ভূমণ্ডল ও পরিবেশ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণের শিক্ষা
দিয়েছেন।পবিত্র কোরআনে তাই ঘোষণা এসেছে—‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি
ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত
করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। (সুরা কাফ, আয়াত: ৭-৯)
বৃক্ষরাজি যে কত বড় নিয়ামত, পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে তা প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর
ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের
গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে। ’ (সুরা সাজদা, আয়াত: ২৭)
একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য কত?
গাছবিহীন এক মুহূর্তও অসম্ভব। মানুষের যাপিত জীবনের সব কিছুই গাছকে ঘিরে
ও গাছকে নিয়ে। তাই গাছ নিধন হলে গাছ শুধু একাই মরে না। মানুষসহ সব
প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ
বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের
বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়।
ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক
একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী
একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার
(সূত্র : ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম-১১, সংখ্যা-১-২)
বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহ ও নির্দেশনা
হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে,
তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে। ’ (বুখারি, হাদিস: ২৩২০, মুসলিম, হাদিস: ১৫৬৩/১২)
এ হাদিসটি আরও স্পষ্ট করে অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ
করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি
ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সদকার নেকি দেবেন। ’ (মুসনাদ আহমাদ: ১৬৭০২)
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর
বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫৬৭)
বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা সম্পর্কে হাদিস
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী
(সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি
একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।
(বুখারি : ৪৭৯)
অন্য বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামত এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারো হাতে যদি ছোট একটি খেজুরগাছ থাকে, তাহলে সে যেন গাছটি
রোপণ করে দেয়। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১২৯০২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৪৭৯)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘মক্কা এবং মদীনার মাঝে অবস্থিত
একটি বৃক্ষের নিকট যখন তিনি আসতেন তখন তার নীচে শুয়ে বিশ্রাম করতেন।
তিনি বলতেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এরূপ করতেন। (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব,
হাদিস: ৪৭)গাছ-বৃক্ষ প্রকৃতি ও পরিবেশ এর ‘বন্ধু’। তাই নির্বিচারে গাছ না কেটে
প্রচুর বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।