খতমে নবুওত ইসলামের মৌলিক আকীদা

খতমে নবুয়ত শব্দটি আরবি ﺧَﺗَﻢَ শব্দ থেকে অর্থ হল ‎‏‎(শেষ,সমাপ্তি) ও ‎ﻨَّﺒِﻭَ‏‎ নবুয়ত, পয়গম্বরী, নবীত্ব এর সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং খতমে নবুয়ত অর্থ নবীগণের সমাপ্তি। খতমে নবুয়ত ইসলামী শরীয়তে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামী পরিভাষায় হযরত মুহাম্মদ সাঃ-ই সর্বশেষ নবী ও রাসূল এরূপ বিশ্বাসকে খতমে নবুয়ত বলা হয়। অর্থাত্‍ মুহাম্মদ সাঃ-ই শেষ নবী এরূপ মেনে নেওয়া।

খতমে নবুওত-এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে নবুওত ও রিসালাতের যে পবিত্র ধারা শুরু
করেছেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে সেই ধারাকে সমাপ্ত করেছেন। ইসলামের মৌলিক আকীদা
তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, কোরআন, কেবলা ইত্যাদি বিষয় যে পর্যায়ের অকাট্য ও
সন্দেহাতীত দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত, খতমে নবুওত তথা মুহাম্মদ (স.) এর শেষ নবী হবার আকীদাও অনুরূপ দলিল দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। এজন্যই তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত, নামায, হজ, যাকাত, কুরআন ইত্যাদির অস্বীকারকারী
যেমন স্পষ্ট কাফের, তেমনিভাবে খতমে নবুওত অস্বীকারকারী এবং অবিশ্বাসীরাও কাফের। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল-এ বিশ্বাস যেমন অকাট্য তেমনি তিনি শেষ নবী, তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী নেই এ বিশ্বাসও অকাট্য। খতমে নবুওত সরাসরি অস্বীকার করা হোক কিংবা অপব্যাখ্যার অন্তরালে করা হোক সর্বাবস্থায় তা কুফর বলে গণ্য।
এজন্য ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা.) নবুওতের দাবীদার মুসাইলামা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত
কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তারা মৌলিকভাবে তাওহীদ ও রেসালাতে বিশ্বাসী ছিলো। শুধু নবুওতের দাবী তোলার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম তাদের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন।

 

খতমে নবুয়ত একটি প্রমাণিত বিষয়, যার দলীল হচ্ছেঃ

আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির প্রয়োজনানুপাতে কালক্রমে তাদের বিভিন্ন শরীয়ত দিয়েছেন। আর এর পূর্ণতা ও পরিসমাপ্তি
বিধান করেছেন মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর যেহেতু এতে কোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন নেই তাই মানবজাতির জন্য নতুন শরীয়তেরও প্রয়োজন নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা নবী-রসুল প্রেরণের ধারা
চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আজ
আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি, আর আমি তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং
দ্বীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছি।’ (সূরা মায়েদা : ৩) আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ “মুহাম্মাদ
(সা.) তোমাদের কোন পুরুষের পিতা ছিলেন না। তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।” (সূরা আহযাবঃ ৪০)

বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর কারক আল্লামা ইমাম ইবন্ কাসীর (রহঃ) বলেন, “অত্র আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয়
যে, তাঁর মুহাম্মাদ (সা.) এর পরে কোন নবী নাই। নবী যখন আসবেন না রাসুল আসার তো কোন প্রশ্নই উঠেনা। এ ব্যাপারে
রাসূল (সা.) থেকে অসংখ্য মুতাওয়াতির হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (৩য় খন্ড, ৪৯৩ পৃষ্টা, মিসরিয় ছাপা)

 

খতমে নবুওত সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর হাদীস:

১) রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনঃ “আমার উম্মতর মধ্য থেকে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী আসবে প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী
করবে। অথচ আমি হলাম শেষ নবী; আমার পরে কোন নবী নেই।” ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
(তিরমিযী ৮/১৫৬ হাদীস নং ৩৭১০)

২) আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেনঃ “আমি এবং পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীদের উদাহরণ হল,
এক লোক একটি ঘর অত্যন্ত সুন্দর করে তৈরী করল। কিন্তু ঘরের এক কোনে একটা ইট ফাঁকা রেখে দিল। লোকজন
চর্তুদিকে ঘুরে ঘরে তার সৌন্দর্য্য দেখে বিমোহিত হচ্ছে কিন্তু বলছে, এ ফাঁকা জায়গায় একটি ইট বসালে কতই না সুন্দর হত!” রাসূল (সা.) বলেন, “আমি হলাম সেই ইট এবং আমি হলাম সর্বশেষ নবী।” (বুখারী, হাদীস নং ৩২৭১ মুসলিম, হাদীস নং ৪২৩৯)

৩) আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনঃ “বনী ইসরাইলকে পরিচালনা করতেন তাদের নবীগণ।
এক নবী মৃত্যু বরণ করলে আরেক নবী তার স্থানে এসে দায়িত্ব পালন করতেন। তবে আমার পরে কোন নবী আসবে না;
আসবে খলীফাগণ।”(সহীহ বুখারী)

৪) রাসূল (সা.) আলী (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বলেনঃ “মুসা (আঃ) এর নিকট হারুন (আঃ) যেমন তুমি আমার নিকট ঠিক তদ্রুপ। তবে আমার পরে কোন নবী নেই।” (বুখারী-৪০৬৪, মুসলিম হাদীস নং ৪৪১৮)

৫) রাসূল (সা.) বলেনঃ “আমার পরে কেউ নবী হলে উমার ইবনুল খাত্তাব নবী হতেন।” (সুনান তিরমিযী হাদীস নং-৩৬১৯)

৬) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনঃ ‘অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় আমাকে ছয়টি বিষয় দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয়েছে,’ তার মধ্যে দুটি বিষয় হলো, ‘আমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের রসুলরূপে প্রেরণ করা হয়েছে এবং
আমার দ্বারা নবীদের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।’ (মুসলিম হাদীস নং- ৫২৩/৭১২)। এছাড়াও এরূপ অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস দ্বারা দ্যার্থহীনভাবে প্রমাণিত ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা এই যে, মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী আগমণ করবেনা বা প্রেরিত হবেন না।

 

খতমে নবুওত এর যৌক্তিক প্রমাণ:

যুক্তি থেকে বিচার করলে দেখা যায় নবীরা আসতেন তিনটি কারণেঃ

  1. পূর্ববর্তী নবীর ধর্মের আইন বিকৃত হয়ে গেলে
  2. পূর্ববর্তী নবী কোনো নির্দিষ্ট কাল বা স্থানের জন্য প্রেরিত হলে,
  3. পূর্ববর্তী নবীর শরিয়তে সংযোজন বা বিয়োজন প্রয়োজন হলে

কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্য এদের একটিরও প্রয়োজন নেই। তাই আর নবী আসার প্রয়োজন নেই।

কাদিয়ানীদের আকীদা:

বর্তমান যুগে কাদিয়ানীরা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পরে ভিন্ন এক নবীর অস্তিত্ব স্বীকার করে। সুতরাং
তাদেরকে মুসলমান বলার অর্থ হবে এটা মেনে নেওয়া যে, ইসলামে নতুন নবী আসার এবং তার উপরও ঈমান আনার
সুযোগ রয়েছে। কোনো মুমিনের পক্ষে এমন বিভ্রান্তিকর কুফরী আকীদা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা, খতমে নবুওতের বিষয়টি যুগপরস্পরায় প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত আকীদা এবং ইসলামের মৌলিক বিষয় ।

কাদিয়ানীদের বই পত্রের মাঝে কাদিয়ানীকে যারা নবী হিসেবে স্বীকার করে না তাদেরকে কাফের আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
তাদের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হাকীকাতুন নুবুওয়াহ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মির্জা গোলাম আহমদ ঐ অর্থে নবী, যে অর্থে পূর্ববর্তী
হযরত মুসা ও ঈসা (আ.) নবী ছিলেন। যেমনিভাবে কোনো একজন নবীকে অস্বীকারকারী কাফের, তেমনিভাবে মির্জা
গোলাম আহমদের নবুওত অস্বীকারকারীও কাফের।’ এভাবে কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে ধোকা
ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ইসলামের নামে একটি নতুন ধর্মমতের প্রচারণা চালিয়ে সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

মুহাম্মাদ (সা.) শেষ নবী নয় (!) গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রচার করতে থাকে যে,মুহাম্মাদ (সা.) শেষ নবী নয় বরং যুগের
চহিদা মোতাবেক নবুওয়াতের ধারা অব্যহত থাকবে এবং অন্যান্য নবী ও রাসূলগণের মত সে ও একজন নবী এবং রাসূল।

পূর্ববর্তী সালাফে সালেহীন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। যুগে যুগে মুসাইলামাতুল কায্যাব, তুলাইহা, আসওয়াদ আনাসীর
মত অনেক ভন্ড ও মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হয়েছে কিন্তু সবাইকে আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশম্পাতের অধিকারী হয়ে
লাঞ্ছিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এবং তারই ধারাবহিকতায় মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও নিকৃষ্ট
অবস্থায় পায়খানায় পড়ে মৃত্যবরণ করে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে
খতমে নবুওতের হেফাজতের জন্য কবুল করুন। আ-মীন।