ক্রোধ দমনের শরয়ি পদ্ধতি:

ক্রোধ একটি মানবীয় ত্রুটি। মানুষের চাহিদার বিপরীত হলে মানুষ রাগ করে থাকে।
মানুষ হিসাবে কারো কাছে  ক্রোধ থাকা দোষের কিছু নয়। তবে রাগ দমন করতে না
পারাটা দোষের। ক্রোধ দমন করতে হাদিসে নির্দেশনা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা
(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাঃ কে বলল, ‘আমাকে উপদেশ দিন।’
তিনি বললেন, ‘রাগ করো না।’ সে ব্যক্তি কয়েকবার এ কথা বলল, রাসুল সাঃ বললেন,
‘রাগ করো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬১১৬)

ক্রোধ দমনে শরিয়তের পদ্ধতি:
(ক) ‘আউজুবিল্লাহি মিনাস শায়তানির রাজিম’ দুয়াটি পড়া : সুলাইমান ইনবে সুরাদ
(রা.) বলেন, রাসুল এর কাছে দুজন লোক গালাগালি করল। আমরা তখন তাঁর কাছে
বসে আছি। একজন অন্যজনকে গালি দিচ্ছে। গালি শুনে অপরজনের চোখমুখ লাল
হয়ে গেছে। রাসুল সাঃ বললেন, ‘আমি এমন একটা বাক্য জানি যা কেউ বললে তার রাগ উপশম হবে। তা হলো, ‘আউজুবিল্লাহি মিনাস শায়তানির রাজিম’ আমি বিতাড়িত
শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এক সাহাবি রাসুল সাঃ এর কথাটা
শুনলেন। সে সাথে সাথে গিয়ে ঝগড়ারত ব্যক্তিকে রাসুল সাঃ এর কথাটা শুনিয়ে
বললেন, ‘তুমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো।’ এ কথা শুনে লোকটির ক্রোধ আরো বেড়ে গেল। তার হাত কাঁপতে লাগল। তারপর বলল, তুমি কি আমার মধ্যে কোনো প্রকার ক্রোধ দেখতে পাচ্ছো? আমি কি পাগল? যাও, নিজের কাজে মনোযোগ দাও!’ (তিরমিযি, হাদিস নং-৩৪৫২)
(খ) শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন করা :  রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো
রাগ হয় তখন সে যদি দাঁড়ানো থাকে, তবে যেন বসে পড়ে। যদি তাতে ক্রোধ চলে যায় ভালো। আর যদি না যায়, তবে শুয়ে পড়বে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস, হাদিস
নং-৪৭৮৪)
(গ) অজু করা : নবী কারীম সাঃ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে।
আর শয়তান আগুনের তৈরি। নিশ্চয় পানির দ্বারা আগুন নির্বাপিত হয়। সুতরাং
তোমাদের কেউ যখন রাগান্বিত হয় সে যেন অজু করে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস,
হাদিস নং-৪৭৮৬)

চুপ থাকার অনেক উপকারিতা:

(ঘ) চুপ থাকা : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
‘তোমরা শিক্ষা দাও এবং সহজ করো। কঠিন করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন
চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস, হাদিস নং-৪৭৮৬)
(ঙ) দোয়া করা : কেননা আল্লাহই সব বিষয়ের তাওফিকদাতা। সঠিক পথে পরিচালনাকারী, দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ তাঁরই হাতে। আত্মা বিনষ্টকারী যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য তিনিই একমাত্র উত্তম সাহায্যকারী। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া  দেব।’ (সুরা গাফের, আয়াত-৬০)
(চ) অধিক হারে আল্লাহর জিকির করা : যেমন  কোরআন পাঠ, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ, ইস্তিগফার ইত্যাদি করা। কেননা মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, একমাত্র তাঁর
জিকিরই অন্তরে প্রশান্তি আনতে পারে। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখ আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা রাদ, আয়াত-২৮)
(ছ) ক্রোধসংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস চর্চা : যেসব আয়াত ও হাদিস ক্রোধ সংবরণ করার  উৎসাহ দেয় সেগুলো এবং যেগুলো ক্রোধের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে সেগুলো
মনে করা এবং ভালোভাবে হূদয়ঙ্গম করা। যেমন হাদিসে এসেছে, আনাস (রা.) থেকে
বর্ণিত, রাসুল সাঃ বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় ক্রোধকে সংবরণ করে, অথচ সে বাস্তবায়ন
করতে সক্ষম ছিল, তাকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ময়দানে সব মানুষের সামনে
আহ্বান করবেন। অতঃপর জান্নাতের আনতনয়না হুর থেকে যাকে ইচ্ছা বেছে নিতে স্বাধীনতা দেবেন এবং তার ইচ্ছানুযায়ী তাদের সাথে তার বিবাহ দিয়ে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস-৪১৭৬)

সঠিকভাবে দেহের আদায় করা প্রয়োজনী:

(জ) সঠিকভাবে দেহের হক আদায় করা : প্রয়োজনীয় নিদ্রা ও বিশ্রাম গ্রহণ করা,
সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ না করা, অযথা উত্তেজিত না হওয়া।
(ঝ) আল্লাহকে ভয় করা : হজরত আলী (রা.) এক যুদ্ধে অমুসলিম বাহিনীর
সেনাপ্রধানকে সম্মুখযুদ্ধে ধরাশায়ী করলেন এবং যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত
হলেন, তখন তিনি আলী (রা.)-এর মুখে থুতু নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলী (রা.) লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। তখন ওই সেনাপ্রধান বললেন, ‘আপনি আমাকে হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তা করলেন না কেন?’ উত্তরে আলী (রা.) বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। আপনার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করেছি শুধু
আপনার অবিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহের কারণে। আমার মুখে থুতু নিক্ষেপের পর আমি যদি আপনাকে হত্যা করতাম, তবে তা হয়ে পড়ত আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ, যা আমি কখনোই চাই না।’ (সাহাবা চরিত)
(ঞ) ক্রোধের যাবতীয় কারণ থেকে দূরে থাকা : যেসব কারণে ক্রোধ হতে পারে সেসব জিনিস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।

ক্রোধ ক্ষেত্র বিশেষ জায়েয:

ক্রোধ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না, ক্রোধকে বলা হয় বারুদ, যা একটু আগুনের ছোঁয়ায় ছাই করে দেয় সব কিছু। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ক্ষমার মানসিকতা রাখা প্রয়োজন। ‘রাগ’ যেমন জীবন ধ্বংস করে ঠিক তেমনি ‘ক্ষমা’ জীবনকে সুন্দর করে।
এ প্রসঙ্গে সূরা আল ইমরানের ১৩৪ নম্বর আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ-ক্রটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন। ’
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘এবং রাগ দমনকারীরা ও মানুষকে
ক্ষমাকারীরা। আল্লাহ অনুগ্রহকারীকে ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত -১৩৪)
একটু কষ্ট করে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ ও দমনের ফলে যে উপকার লাভ করবে তা
কল্পনারও অতীত। কুরআন ও হাদিসে রাগ দমনের উপকারিতা বর্ণনায় এসেছে।
রাগ দমনকারীর জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘তুমি রাগ করবে না,
তাহলে তোমার জন্য জান্নাত।’ (সুনানে তিবরানি, হাদিস-২১)
শারীরিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিকেই যে বীর বলা হয় তা কিন্তু নয়, রাগকে নিয়ন্ত্রণ অথবা
রাগ দমনকারী ব্যক্তিই মূলত শক্তিশালী। এটা মানুষের কথা নয়, স্বয়ং রাসূল সা:-এর বাণী। হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘সে ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে ব্যক্তি কুস্তি লড়ে অপরকে ধরাশায়ী করে, বরং প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিই শক্তিশালী, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৬৮০৯)
ক্ষেত্র বিশেষ কিছু রাগ বা ক্ষোভকে সঠিক বলে রায় দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জুলুম ও বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের
জন্য অপরাধী ও জুলুমবাজদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে রাগ বৈধ। জাতীয়, ধর্মীয় ও মানবিক আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে রাগকে কাজে লাগাতে হবে।
তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে অন্যায় দমন করতে গিয়ে অন্যায়কে যাতে প্রশ্রয়
দেয়া না হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে একজন মুমিন হিসাবে  খারাপ রাগ
ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখার তাওফিক দান করুক।  আমিন।