ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (২য় পর্ব)

৯. নবুঅতের মিথ্যা দাবীদারদের আত্মপ্রকাশ : ভন্ড নবীদের আগমন ক্বিয়ামতের আলামত এর অন্যতম। এদের আবির্ভাব
রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেই হয়েছিল। এদের কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে নবুঅত ভাগাভাগি করতে চেয়েছিল। তাদের একজন
রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এ মর্মে পত্র লিখেছিল যে, ‘হে মুহাম্মাদ! আমাকে তোমার সাথে নবুঅতে অংশীদার করা হয়েছে।
পৃথিবীর অর্ধেক ভূমি তোমার এবং অর্ধেক আমার। তবে কুরাইশ সম্প্রদায় সীমালংঘনকারী’। রাসূল (ছাঃ) পত্রের জবাবে
লিখেন ‘যারা হেদায়াতের উপরে আছে তাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক। এই পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি তাঁর
বান্দাদের মধ্যে যাকে চান এর উত্তরাধিকারী করেন। আর শুভ পরিণাম কেবল আল্লাহভীরুদের জন্যই’।
তিনি আরো বলেন, ‘মুশরিকদের সাথে আমার উম্মতের কতিপয় গোত্র মিলিত না হওয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না, এমনকি তারা মূর্তিপূজাও করবে। আমার উম্মতের মধ্যে খুব শীঘ্রই ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে। এদের সকলেই
দাবী করবে যে, সে নবী। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই’।

ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ:

কতিপয় ভন্ড নবীর পরিচয় :

(১) আসওয়াদ আনাসী : এ ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর আমলে ইয়ামানে নবুঅতের দাবী করে। সে প্রথমে ইসলাম গ্রহণ
করলেও পরে মুরতাদ হয়ে যায় এবং তার মুমিনা স্ত্রীকে হত্যা করে। এ সংবাদ পেয়ে রাসূল (ছাঃ) ইয়ামানের মুসলমানদের
নিকট পত্র প্রেরণ করেন, যাতে তিনি ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধের জন্য উদ্ভুদ্ধ করেন। মুসলমানরা আসওয়াদ আনাসীর পরবর্তী স্ত্রীর সহায়তায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
(২) মুসায়লামা বিন হাবীব আল-কাযযাব : সে মনে করত অন্ধকারে তার নিকট অহী নাযিল হয়। সে নবুঅত ভাগাভাগি
করার প্রস্তাব দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পত্র পাঠিয়েছিল। একবার সে নিজে গিয়েও এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল।
(৩) তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আসাদী : সে প্রথমে নবুঅতের দাবী করে এবং খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। নবম হিজরীতে প্রতিনিধি দলের সাথে মদীনা এসে ইসলাম কবুল করে। রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলে সে আবার নবুঅতের
দাবী করে। ফলে মুসলমানরা তার সাথে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের বিধি
বিধান পালন করতেন। মুসলমান সৈন্যদের সাথে যোগদান করে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। পরবর্তীতে আলী (রাঃ)
এর আমলে খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন।
(৪) সাজাহ বিনতে হারেছ তাগলিবী : সে আরবীয় খৃষ্টান নারী। সে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে নবুঅতের দাবী করে। তার গোত্রসহ আশপাশের বহু মানুষ তার অনুসারী হয়ে যায়। সে ইয়ামামা এসে মুসায়লামা কাযযাবকে সত্যায়ণ করে এবং তার
সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মুসায়লামা ইয়ামামার যুদ্ধে মারা গেলে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করে।
পরে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর আমলে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বছরায় হিজরত করেন। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

(৫) মুখতার বিন আবী ওবায়দ ছাক্বাফীর আবির্ভাব ক্বিয়ামতের আলামত:

সে তাবেঈ যুগের ভন্ডনবী। সে প্রথমে শী‘আ ও পরে নবুঅতের দাবী করে। সে মনে করত তার নিকট জিবরীল (আঃ)
আগমন করেন। মুছ‘আব বিন যুবায়ের তার বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। কোন এক যুদ্ধে সে মারা যায়।
(৬) হারেক বিন সাঈদ আল-কাযযাব : সে দিমাষ্কে নবুঅতের দাবী করে। সে যখন জানতে পারে যে, তার ভন্ডামীর কথা
খলীফা আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান জেনে ফেলেছেন। তখন সে আত্মগোপন করে। একজন বছরী তার অবস্থান জানতে পারলে বিষয়টি তিনি খলীফাকে জানিয়ে দেন। খলীফা আব্দুল মালেক তার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ কর তাকে হত্যা করা হয়।
(৭) মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী : কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের ‘কাদিয়ান’ শহরের জনৈক
ভন্ডনবী মির্যা গোলাম আহমাদ (১৮৩৫-১৯০৮)-এর মাধ্যমে। সে বর্তমান ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর যেলার
‘কাদিয়ান’ নামক উপশহরে জন্মগ্রহণ করে। ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারী নিজেকে মসীহ ঈসা ও ১৮৯৪ সালের ১৭ই মার্চ ইমাম মাহদী এবং ১৯০৮ সালের ৫ই মার্চ নিজেকে নবী হিসাবে ঘোষণা করে। এই ভন্ডের প্রতি বিশ্বাসী হওয়ার কারণে কাদিয়ানীরা নিঃসন্দেহে কাফের। তাদের মুসলমান হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এভাবে যুগে যুগে ভন্ডনবীদের আগমন ঘটতে থাকবে। অবশেষে দাজ্জাল এসে ৩০তম সংখ্যা পূরণ করবে। সে প্রথমে ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করবে, এরপর নবুঅতের দাবী করবে। অতঃপর নিজেকে সৃষ্টিকর্তা দাবী করবে।
১০. খারেজীদের আবির্ভাব : রাসূল (ছাঃ) যে সকল বিষয়কে ক্বিয়ামতের আলামত বলে উল্লেখ করেছেন খারেজীদের
উদ্ভব তার অন্যতম। খারেজী হল প্রত্যেক এমন ব্যক্তি যে এমন হক ইমামের (শাসক) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাকে
লোকেরা ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। খারেজীদের উদ্ভব রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেই ঘটেছিল। তবে তখন ভ্রান্ত দল
হিসাবে তাদের পরিচিতি হয়নি। প্রথম খারেজী ছিল যুল খুওয়াইছিরা তামীমী। যে রাসূল (ছাঃ)-এর বণ্টন নীতির ব্যাপারে
আপত্তি তুলেছিল।

১১. ছাহাবীগণের যুগ অতিক্রান্ত হওয়া ক্বিয়ামতের আলামত:

পৃথিবী থেকে ছাহাবীগণের বিদায় ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামত। আবূ বুরদাহ (রাঃ) এর পিতার সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সা.
বলেন আর আমার ছাহাবীগণ সমগ্র উম্মতের জন্য নিরাপত্তা (রক্ষাকবচ) স্বরূপ। যখন আমার ছাহাবীগণ বিদায় হয়ে যাবে
তখন আমার উম্মাতের উপর প্রতিশ্রুত সময় (ক্বিয়ামত) উপস্থিত হবে। (অর্থাৎ ক্বিয়ামত ঘনিয়ে আসবে, শিরক, বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়বে, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে, শয়তানের শিং উদয় হবে, নাছারাদের রাজত্ব কায়েম হবে, মক্কা ও মদীনার
অবমাননা করা হবে ইত্যাদি।
১২. বিভিন্ন ফিৎনার আবির্ভাব ঘটা : বিভিন্ন প্রকারের ফিৎনা-ফাসাদ ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামত। রাসূল বলেন, ‘আধার
রাতের ন্যায় ফিৎনা আসার পূর্বেই তোমরা নেক আমলের দিকে ধাবিত হও। (কেননা এমন এক সময় আসবে) যে সময়
সকালে একজন মু’মিন হলে সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যাবে। সন্ধ্যায় মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর
বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করে দিবে’।
১৩. বিভিন্ন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়া : সমাজ, রাষ্ট্র ও সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়া ক্বিয়ামতে অন্যতম আলামত। ফিৎনা-ফাসাদ সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে লোকেরা ফিৎনার ভয়ে মৃত্যু কামনা করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামত সংঘটিত
হবে না যতক্ষণ না (বিপদাপদের কারণে) এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মৃত ব্যক্তির স্থানে হওয়া কামনা করবে’। উল্লেখ্য, সাধারণভাবে বিপদ-আপদের কারণে মৃত্যু কামনা করা যাবে না। ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাফছাহ (রাঃ)-এর দরজার নিকট দন্ডায়মান ছিলেন। এ সময় তিনি তাঁর আঙ্গুল দ্বারা পূর্বদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ফিৎনা এ দিক
থেকে আসবে-যেদিক থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। এ কথাটি তিনি দুই বা তিনবার বলেছেন’। রাসূল (ছাঃ) পূর্বের দিকে ইঙ্গিত করে ইরাকসহ পুরো প্রাচ্যকে বুঝিয়েছেন। কারণ ইরাক থেকেই খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা, জাহমিয়া, মাজূসী,
মানুবিয়া, মুযদাকিয়াসহ বহু ভ্রান্ত দলের আবির্ভাব ঘটেছে। অপরদিকে চিন ও ভারত থেকে হুন্দুসিয়া, বুযিয়া, কাদিয়ানী,
বাহাইয়া ও তাতারদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং পরবর্তীতে দাজ্জাল ও ইয়াজূজ-মাজূজের ফিৎনার আবির্ভাব ঘটবে।
চলবে