কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ এর প্রভাব কি?

কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ এর প্রভাব কি?

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ এর সময় গর্ভবতী নারীদের ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করা হয়। আসলে কোরআন ও হাদিসে এ ধরনের বিশ্বাসের অস্তিত্ব কতটুকু?

প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের জানান দিতে থাকা সৃষ্টিগুলোর বড় দুটি
হলো সূর্য ও চন্দ্র। চাঁদের আলোর উৎস হলো সূর্য।
১৩ লাখ ৯৪ হাজার কিলোমিটার ব্যাসের এ নক্ষত্রের সঙ্গে পৃথিবী ও জীবজগতের
সম্পর্ক সুনিবিড়। সূর্যের তাপে মহান আল্লাহ সতেজ আর সজীব রেখেছেন পৃথিবীর
সব কিছু। উদ্ভিদ এই সূর্যালোক থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। যদি পৃথিবীতে সূর্যের তাপ ও
আলো না আসত, তাহলে বিপন্ন হতো প্রাণিকুলের জীবন। পুরো পৃথিবী পরিণত হতো একখণ্ড বরফে। অন্যদিকে সূর্য যদি তার ভেতরকার সব তাপ পৃথিবীর ওপর উগড়ে
দিত, তাহলেও পৃথিবী পরিণত হতো শ্মশানে।

পবিত্র কোরআনে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ।

মহান আল্লাহ বলেন : ‘তিনিই সত্তা, যিনি সূর্যকে কিরণোজ্জ্বল ও চাঁদকে স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করেছেন। ’ (সুরা ইউনুস : ৫) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি সৃষ্টি
করেছি একটি প্রজ্বলিত বাতি। ’ (সুরা নাবা : ১৩)
সূর্যের আলোচনায় কোরআনুল কারিমে সব জায়গায়ই ‘প্রজ্বলিত বাতি’, ‘তেজোদীপ্ত’, ‘উজ্জ্বল জ্যোতি’, ‘চমক/ঝলক’, ‘শিখা’ বলা হয়েছে। যার অর্থ সূর্য নিজে দহনক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড তাপ ও আলো উৎপন্ন করে;
পক্ষান্তরে চাঁদের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘স্নিগ্ধ আলো’।

বিজ্ঞানও গবেষণা করে ঠিক তা-ই বলেছে।

বিজ্ঞানের বক্তব্য সূর্যই তাপশক্তির ও আলোর প্রধান উৎস এবং চাঁদের নিজস্ব কোনো
আলো নেই। সূর্যের প্রতিফলিত আলোই তার সম্বল। পবিত্র কোরআন আরো স্পষ্ট
করে বলছে, ‘আল্লাহ চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে, আর সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে। ’ (সুরা নুহ : ১৬)
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হলো আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া। চাঁদ যখন
পরিভ্রমণ অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন
পৃথিবীর কোনো দর্শকের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে
অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই সূর্যগ্রহণ বা কুসুফ। আর পৃথিবী যখন তার পরিভ্রমণ অবস্থায়
চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখনই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য
অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই চন্দ্রগ্রহণ বা খুসুফ।

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার আছে।

ওই সময় খেতে নেই, তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হবে, গর্ভবতী মায়েরা এ সময় যা
করেন, তার প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ে, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী নারী
কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়—এটি ভুল বিশ্বাস।
এ সময় কোনো নারীকে ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করাও অন্যায়। ইসলামী শরিয়াহ

ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই। জাহেলি যুগেও এ ধরনের কিছু ধারণা ছিল। সেকালে মানুষ ধারণা করত যে চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ হলে অচিরেই দুর্যোগ বা দুর্ভিক্ষ হবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষের জন্ম বা মৃত্যুর বার্তাও বহন করে বলে

তারা মনে করত।
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেগুলোকে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে
প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুগিরা ইবনু শুবা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পুত্র
ইবরাহিমের ইন্তিকালের দিনেই সূর্যগ্রহণ হলে আমরা বলাবলি করছিলাম যে
নবীপুত্রের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। একথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন,
‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ তাআলার অগণিত নিদর্শনের দুটি। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। ’ (সহিহ বুখারি : ১০৪৩)
চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণকে আল্লাহ তাআলার কুদরত হিসেবে অভিহিত করে অন্য হদিসে
নবীজি (সা.) সাহাবিদের চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো লোকের মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না।
তবে তা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনগুলোর দুটি। তোমরা সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হতে
দেখলে নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে। (সহিহ বুখারি : ৯৮৪)

সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসগুলো নিছকই কুসংস্কার।

নবীজি (সা.)-এর হাদিসগুলো থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের
কোনো প্রভাব সৃষ্টির ওপর পড়ে না কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি এর নেতিবাচক কোনো প্রভাব সৃষ্টির ওপর না-ই পড়বে, তাহলে
কেন নবীজি (সা.) এ সময় নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাহায্য চাইতে বলেছেন?
শুধু নামাজে দাঁড়াতেই বলেননি, বরং চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণে তিনি কিয়ামতের মহাপ্রলয়ের আশঙ্কাও করেছেন। হজরত আবু মুসা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর সময় সূর্যগ্রহণ
হলে তিনি এ আশঙ্কায় করলেন যে কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি (তাড়াতাড়ি) মসজিদে এলেন। অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু, সিজদাসহ নামাজ
আদায় করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি নবীজি (সা.)-কে এমন করতে আগে আর কখনো দেখিনি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর প্রেরিত এসব নিদর্শন কারো
মৃত্যু বা জন্মের (ক্ষতি করার) জন্য হয় না। যখন তোমরা তা দেখবে, তখনই আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার জিকির ও ইস্তিগফারে মশগুল হবে। ’ (সহিহ মুসলিম : ১৯৮৯)
নবীজি (সা.) অন্য হাদিসে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন
হিসেবে উল্লেখ করে উম্মতকে আতঙ্কিত হয়ে তা থেকে দ্রুত উদ্ধারে সদকা ও
নামাজের নির্দেশ দিয়েছেন।

আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে যে সত্যি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর জন্য আতঙ্কের বিষয়।

সৌরজগতে মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যবলয়ে উল্কাপিণ্ড প্রভৃতি পাথরের এক সুবিশাল বেল্ট আছে। এ বেল্টে ঝুলন্ত একেকটা পাথরের ব্যাস ১২০ থেকে ৪৫০ মাইল। গ্রহাণুপুঞ্জের এ পাথরখণ্ডগুলো পরস্পর সংঘর্ষের ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরখণ্ড প্রতিনিয়ত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো বায়ুমণ্ডলে এসে জ্বলে-পুড়ে

ভস্ম হয়ে যায়। তবে এই বৃহদাকারের পাথরগুলো যদি পৃথিবীতে আঘাত করে, তাহলে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হবে পৃথিবী।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী একই সমান্তরালে,
একই অক্ষ বরাবর থাকে বলে এ সময়ই গ্রহাণুপুঞ্জের ঝুলন্ত বড় পাথরগুলো পৃথিবীতে আঘাত হানার আশঙ্কা বেশি। বৃহদাকারের পাথর পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পক্ষে তা প্রতিহত করা অসম্ভব। ধ্বংসই হবে পৃথিবীর পরিণতি।
তাই তো মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) এ সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য
চেয়েছেন। আমাদের উচিত কুসংস্কারগুলো পরিহার করে সুন্নত অনুযায়ী চন্দ্র বা
সূর্যগ্রহণের সময় এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে
নিরাপত্তা চাওয়া।