কাদিয়ানী বিষয়ে একটু পর আলোচনা করছি
ইসলাম বিশেষ কোনো জাতি বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর নাম নয়। হিন্দু ধর্মের মতো (যদি তাকে
‘ধর্ম’ বলা চলে) শুধু কিছু সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান অথবা বিশেষ কোনো
উপাসনারীতির নামও নয় ইসলাম। হিন্দুদের ধর্মজগত সম্পর্কে যাদের কিছু অবগতি
আছে, তারা জানেন, এ ধর্মে আকিদা-বিশ্বাসের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। যারা বেদ-উপনিষদ ইত্যাদিকে ঐশী গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করে তারা যেমন হিন্দু, যারা অস্বীকার করে তারাও হিন্দু! সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মূর্তিপূজকেরা হিন্দু, মুর্তিপূজার সমালোচকরাও হিন্দু! একদিকে দেবদেবী ও ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা হিন্দু, আবার এগুলিকে অস্বীকারকারী নিরেট বস্ত্তবাদীরাও হিন্দু! সময়ের প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক লীডার পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নিজের সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘হিন্দু ধর্মটা বড় বেকায়দার জিনিস।
কিছুতেই এর পিছু ছাড়া সম্ভব হয় না। আমি ভগবান মানি না, তবু হিন্দু। কোনো ধর্মেই
আমি বিশ্বাস করি না, তবুও আমি হিন্দু! কি আশ্চর্যের কথা!’
কিন্তু ইসলামধর্ম এর ব্যতিক্রম। মুসলমান হওয়ার জন্য অবশ্যই সুস্পষ্ট কিছু আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করা এবং সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা মেনে চলা একান্ত অপরিহার্য। এ-ছাড়া
কেউ কখনো মুসলমান হতে পারবে না, কোনো নবীর সন্তান হলেও না।
সাথে সাথে ইসলামের এমন কোনো বিষয়ও অস্বীকার করা চলবে না,
যা সন্দেহাতীতভাবে যুগপরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং উম্মতের সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণীও যে সকল বিষয়কে নবীজীর শিক্ষা বলে জানে। ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় এ ধরণের বিষয়কে ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয়। যেমন, আল্লাহ একমাত্র
মাবুদ, তার কোনো শরীক নেই। মুহাম্মাদ সা. তাঁর রাসূল। কেয়ামত ও আখেরাত সত্য। কোরআন আল্লাহ তাআলার নাযিল করা কিতাব। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ। পবিত্র
মক্কা নগরীর কাবাঘর হলো মুসলমানদের কেবলা ইত্যাদি।
নবীজী সা. থেকে যে সমস্ত বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত, যুগ-পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত
এবং একজন সাধারণ মুসলমানের নিকটও যে বিষয়গুলি অজানা নয়, তেমন একটি
বিষয় হলো খতমে নবুওতের আকীদা। অর্থাৎ আমাদের নবীজীর পর আর কোনো নবী নেই। নতুন করে কোনো নবী আর আসবে না। নবুওতের ধারা নবীজীর উপর এসে
চিরতরে সমাপ্ত হয়ে গেছে -এই আকীদা।
কাদিয়ানী পরিচিতি:
কাদিয়ানী এমন একটি আন্দোলন যা ১৯০০ সালে ইংরেজ উপনিবেশবাদের
পরিকল্পনায় ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদেরকে
তাদের ধর্ম থেকে দূরে রাখা; বিশেষত জিহাদের ফরয দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা;
যাতে করে তারা ইসলামের নামে উপনিবেশবাদকে মোকাবিলা করতে না পারে।
এ আন্দোলনের মুখপত্র হচ্ছে- Religious নামক ম্যাগাজিন; যা ইংরেজী ভাষায়
প্রকাশিত হত।
প্রতিষ্ঠা ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:
১। গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৯খ্রিঃ-১৯০৮খ্রিঃ) ছিল কাদিয়ানী আন্দোলনের অস্তিত্বের প্রধান গুটি। সে ১৮৩৯খ্রিঃ ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ
করে। সে এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে যে পরিবার দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এভাবেই গোলাম আহমাদ উপনিবেশের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুগত থেকে বেড়ে উঠেছে। তাকে নবুয়ত দাবী করার জন্য মনোনীত
করা হয়েছে; যাতে করে তাকে কেন্দ্র করে মুসলমানেরা একত্রিত হয় এবং ইংরেজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে। ব্রিটেন সরকারের তাদের
উপর অনেক দয়া-দাক্ষিণ্য ছিল। তাই তারা তাদের প্রতি মিত্রতা প্রকাশ করেছে।
গোলাম আহমাদ তার অনুসারীদের কাছে মেজাজের বিকৃতি, অনেক রোগগ্রস্ত ও মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত ছিল।
২। তার বিরুদ্ধে ও তার নোংরা দাবীর বিরুদ্ধে যারা অবস্থান গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন: ভারতের জমঈয়ত আহলে হাদিসের আমির শাইখ আবুল ওয়াফা সানা উল্লাহ্ অমৃতসরী। তিনি তার সাথে বাহাস (বিতর্ক) করেছেন, তার দলিল খণ্ডন করেছেন, তার শয়তানি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তার মতবাদের কুফরি ও বক্রতা তুলে ধরেছেন।
তারপরেও গোলাম আহমদ যখন সঠিক পথে ফিরে আসেনি তখন শাইখ আবুল ওয়াফা
তার সাথে এই মর্মে মুবাহালা করেছেন যে, তাদের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী সে যেন
সত্যবাদীর জীবদ্দশায় মারা যায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৯০৮ সালে ধ্বংস হয় এবং ৫০টি বই, প্রচারপত্র ও প্রবন্ধ রেখে যায়।
তার লিখিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: ইযালাতুল আওহাম, ইজাযে আহমাদি, বারাহীনে আহমাদিয়া, আনওয়ারুল ইসলাম, ইজাযুল মাসীহ, আত-তাবলীগ ও
তাজাল্লিয়াত ইলাহিয়্যা।
কাদিয়ানীদের আন্দোলনের প্রথম খলিফা:
৩। নূরুদ্দীন: কাদিয়ানী আন্দোলনের প্রথম খলিফা। ইংরেজরা খেলাফতের মুকুট তাকেই পরিয়েছে এবং মুরিদরা তাকে মেনে নিয়েছে। তার লিখিত গ্রন্থ হচ্ছে- ফাসলুল খিতাব।
৪। মোহাম্মদ আলী ও খাজা কামাল উদ্দিন: এ দুইজন কাদিয়ানীদের লাহোরের আমির।
এ দুইজনই কাদিয়ানী মতবাদের প্রবক্তা। প্রথমজন আল-কুরআনুল কারীমের বিকৃত ইংরেজী অনুবাদ লিখেছে। তার লিখিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে: হাকীকাতুল ইখতিলাফ,
আন-নবুয়্যাত ফিল ইসলাম, আদ্-দ্বীন আল-ইসলামী। আর খাজা কামাল উদ্দীনের
লিখিত বই হচ্ছে- আল-মুছুল আল-আলা ফিল আম্বিয়া, এছাড়াও অন্যান্য কিছু বই।
লাহোরস্থ এ আহমাদিয়া জামাত মির্যা গোলাম আহমাদকে কেবল মুজাদ্দিদ
(সংস্কারক) মনে করে। কিন্তু এ দুটো একই আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হয়।
দ্বিতীয় দলটি কোন ক্ষেত্রে সংকটে পড়লে প্রথম দল তাকে সাহায্য করে এবং প্রথম
দল পড়লে দ্বিতীয় দল তাকে সাহায্য করে।
৫। মোহাম্মাদ আলী: সে হল লাহোরস্থ কাদিয়ানী জামাতের আমির এবং কাদিয়ানী মতবাদের গুরু, উপনিবেশবাদের গুপ্তচর, কাদিয়ানী মতবাদ প্রচারকারী ম্যাগাজিনের কর্ণধার। সে কুরআনুল কারীমের বিকৃত ইংরেজী অনুবাদ করেছে। তার রচিত বইয়ের
মধ্যে রয়েছে: হাকিকাতুল ইখতিলাফ, আন-নুবুয়্যাত ফিল ইসলাম।
৬। মুহাম্মদ সাদেক: কাদিয়ানী মতবাদের মুফতি। তার রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে:
খাতামুল নাবিয়্যিন।
৭। বশির আহমাদ বিন গোলাম: তার রচিত বই হচ্ছে- সিরাতে মাহদী, কালিমাতুল ফাসল।
৮। মাহমুদ আহমাদ বিন গোলাম ও তার দ্বিতীয় খলিফা: তার রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- আনওয়ারুল খিলাফা, তুহফাতুল মুলুক ও হাকীকাতুন নুবুয়্যত।
৯। জাফরুল্লাহ্ খান কাদিয়ানীকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিয়োগ করায় এই ভ্রান্ত
মতবাদ ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। তিনি পাঞ্জাব প্রদেশে এ দলকে বড় এক খণ্ড
জমি দেন যাতে করে তাদের আন্তর্জাতিক সেন্টার বানাতে পারে। কুরআনের আয়াত: وَآوَيْنَاهُمَا إِلَى رَبْوَةٍ ذَاتِ قَرَارٍ وَمَعِينٍ [সূরা মুমিনূন, ২৩:৫০] তারা এ স্থানের নাম দিয়েছে: রাবওয়া।
তাদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাস:
১. গোলাম আহমাদ একজন মুসলিম দায়ী হিসেবে তার কর্ম তৎপরতা শুরু করেন।
এক পর্যায়ে কিছু সমর্থক তার পাশে ভিড়ে। অতঃপর সে দাবী করে যে, সে মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) ও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহিপ্রাপ্ত। এরপর আরও একধাপ এগিয়ে সে
নিজেকে প্রত্যাশিত মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ দাবী করে। অতঃপর সে নবুয়ত দাবী
করে। সে দাবী করে যে, তার নবুয়ত আমাদের নবী মুহাম্মদ সা. এর নবুয়তের চেয়ে
উচুঁ পর্যায়ের।
২. কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ রোযা রাখেন, নামায পড়েন, ঘুমান, ঘুম
থেকে জাগেন, লেখেন, ভুল করেন, সহবাস করেন (তারা যা দাবী করে তা থেকে
আল্লাহ্ বহু উর্ধ্বে)।
৩. তারা দাবী করে যে, তাদের উপাস্য ইংরেজ। যেহেতু তিনি তাকে ইংরেজী ভাষায়
সম্বোধন করেন।
৪. কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়নি;
বরং জারী আছে। আল্লাহ্ জরুরতের ভিত্তিতে রাসূল পাঠিয়ে থাকেন। গোলাম আহমাদ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন
৫. তারা বিশ্বাস করে যে, গোলাম আহমাদের উপর জিব্রাইল নাযিল হত ও তার কাছে
ওহী (প্রত্যাদেশ) পাঠাত। তার কাছে প্রেরিত ওহিগুলো কুরআনের মত।
৬. তারা বলে: প্রতিশ্রুত মসীহ (গোলাম) যে কুরআন পেশ করেছেন সেটা ছাড়া আর
কোন কুরআন নেই এবং তার শিক্ষার আলোকে যে হাদিস সেটা ছাড়া কোন হাদিস নেই এবং গোলাম আহমাদের কর্তৃত্ব ছাড়া কোন নবী নেই।
৭. তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের কিতাব নাযিলকৃত। সে কিতাবের নাম হচ্ছে-
আল-কিতাবুল মুবীন”। সেটি কুরআন নয়।
৮. তারা বিশ্বাস করে যে, তারা আলাদা নতুন এক ধর্ম ও নতুন এক শরিয়তের অনুসারী
এবং গোলামের সঙ্গিগণ সাহাবীদের মত।
৯. তারা বিশ্বাস করে যে, কাদিয়ান হচ্ছে মদিনা মোনাওয়ারা ও মক্কা মুকাররমার মত।
বরং এ দুটো শহরের চেয়ে উত্তম। কাদিয়ানের ভূমি হারাম। সেটা তাদের কিবলা ও
হজ্জ পালনের স্থান।
১০. তারা জিহাদের আকিদা বাতিল করার আহ্বান জানায়। তারা ইংরেজ শাসনের অন্ধ আনুগত্য করার আহ্বান জানায়। কেননা তাদের ধারণায় কুরআনের দলিল অনুযায়ী ইংরেজরা উলুল আমর (নেতা)।
১১. তাদের মতে কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলিম কাফের। এমনকি যে ব্যক্তি কাদিয়ানী ছাড়া অন্যের কাছে বিয়ে দেয় বা বিয়ে করে সেও কাফের।
১২. তারা মদ, আফিম, মাদকদ্রব্য ও নেশাজাতীয় জিনিসকে বৈধ মনে করে।
কাদিয়ানী চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের গোড়াপত্তন:
১. স্যার সৈয়দ আহমাদের পাশ্চাত্যপন্থী আন্দোলন যে সব বিকৃত চিন্তাধারা প্রচার
করেছে সেগুলো কাদিয়ানী ধর্ম আত্মপ্রকাশ করার মাঠ তৈরী করেছে।
২. ইংরেজরা এ প্রেক্ষাপেটকে কাজে লাগিয়ে কাদিয়ানী আন্দোলন তৈরী করেছে এবং
এর জন্য তাদের অনুগত জায়গীর শ্রেণীর পরিবারের একজনকে নির্বাচন করেছে।
৩. ১৯৫৩ সালে পাকিন্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খানকে অপসারণের দাবীতে এক জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে সংখ্যলঘু ও
অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা করার দাবী ওঠে। সে আন্দোলনে প্রায় দশহাজার মানুষ শহীদ
হয় এবং তারা কাদিয়ানী মন্ত্রীকে অপসারণ করতে সক্ষম হয়।
৪. ১৩৯৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে (১৯৭৪ সালের এপ্রিল) মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামীর অধীনে বড় একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সে সেমিনারে বিশ্বের আন্তর্জাতিক ইসলামী সংস্থাগুলো অংশ গ্রহণ করে। উক্ত সেমিনারে এ সম্প্রদায়ের কাফের হওয়া ও ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এ মতবাদের বিপদকে প্রতিহত করার, কাদিয়ানীদের সাথে সহযোগিতা না করার এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাদেরকে দাফন না করার।
পাকিস্তান সেন্ট্রাল পার্লামেন্ট মির্যা নাসের আহমাদের সাথে বিতর্কের ব্যবস্থা করে।
এতে শাইখ মুফতি মাহমুদ তার বিরুদ্ধে জবাব দেন। দীর্ঘ ৩০ ঘন্টা ধরে উক্ত বিতর্ক চলে। নাসের আহমাদ জবাব দিতে অক্ষম হয়। এর মাধ্যমে এ সম্প্রদায়ের কুফরের পর্দা উম্মোচিত হয়ে যায়। পার্লামেন্ট গেজেট প্রকাশ করে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে
অমুসিলম সংখ্যালঘু ঘোষণা করে। চলবে ইনশাআল্লাহ।