কওমী মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা :
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।শিক্ষা জাতির উন্নতির সোপান। শিক্ষা জাতিকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথ
নির্দেশ করে। শিক্ষা মানুষকে সুন্দর,পরিমার্জি ও আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে মানবরচিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা কখনো মানবজীবনের সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত কুরআন ও নবী করীম
(সা.)-এর সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা ও কামিয়াবী বয়ে আনতে পারে। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা ফরজ করে দিয়েছেন। কওমী মাদরাসায় তাই
শিক্ষা দেয়া হয়।
এছাড়াও ইসলামী শিক্ষা হচ্ছে শাশ্বত শিক্ষা
এছাড়াও ইসলামী শিক্ষা হচ্ছে শাশ্বত শিক্ষা। এ শিক্ষাই মানুষকে নৈতিকতার উচ্চাসনে সমাসীন করতে পারে। আর কওমী মাদরাসা হচ্ছে এই ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ও সত্যিকারের ধারক-বাহক। এজন্য কওমী মাদরাসা হতে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সমগ্র দুনিয়াতে ইসলাম ও মানবতার খিদমতে নিয়োজিত। দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামী মূল্যবোধের হেফাজতের লক্ষ্যে তারা খোদায়ী মদদে বুকটান করে এগিয়ে আসেন। তবে হ্যাঁ জাগতিক জীবন পরিচালনার জন্য সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখযোগ্য।এজন্যে কুরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞানের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান অর্জন করে ব্যক্তি, সমাজ,
রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা একান্ত কর্তব্য।তাই কওমী মাদরাসা ও কওমী মাদারাসাভিত্তিক সঠিক ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
কওমী মাদরাসার উদ্দেশ্য :
বেসরকারি মাদরাসার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন-হাদিসের প্রচার-প্রসার এবং দ্বীন ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত
রাখা এবং দ্বীনের শাশ্বত শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। ইসলামী শিক্ষার সুরক্ষার সাথে সাথে নিত্যনতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ফিতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করা, তাদের হিংস্র থাবা হতে মুসলিম জাতিকে
রক্ষা করা।
কওমী মাদরাসার বৈশিষ্ঠ :
দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন, ২০১৮-তে কওমি মাদ্রাসার ৬টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ
করা হয়েছে।ঈমান, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের
পরম লক্ষ্য স্থির করে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বার সাথে ভয় ও আশার সম্পর্ক স্থাপন এবং তাতে অবিচল থাকা।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী আমি ও আমার সাহাবীগণ যে মত-পথের উপর প্রতিষ্ঠিত’-এর আলোকে
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ অনুসরণে আম্বিয়া আঃ নিষ্পাপ হওয়ার বিশ্বাস এবং সাহাবায়ে কিরাম রা:
যথাযথ মার্যাদা ও তাঁদের সত্যের মাপকাঠি হওয়ার বিশ্বাস অন্তরে সুদৃঢ় করা।চার মাযহাবের প্রতি শ্রদ্ধা ও পরম সহিষ্ণুতার
সহিত হানাফি মাযহাব অনুসরণ।সুলূক ও আধ্যাত্মিকতায় সুপরিচিত চার তরীকা সহ সকল হকপন্থি ধারার প্রতি সহনশীল ও
উদার মনোভাব পোষণ।ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদিসের আলোকে জ্ঞান দান করে, ত্যাগী, পরোপকারী, সমাজসেবক,
অধিক ভোগ-বিলাসে নিরুৎসাহী এবং স্বল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট থেকে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে।
কওমী মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে খাঁটি মানুষ হিসাবে তৈরি করে
এখানে দুনিয়া বিমুখতা, কষ্ট, সবর, শোকর,আত্মীয়তার বন্ধন, ন্যায়পরায়ণতা, মমত্ববোধ, উত্তম আখলাক-চরিত্রের
বিষয়গুলোই শিক্ষা দেওয়া হয়। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, হল দখল,
দুর্নীতি, মিথ্যা, প্রতারণা, ব্যভিচার, অপকর্ম, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানী, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে কোন রকমের সম্পর্ক
রাখে না। এমনকি থানাগুলোতেও সন্ত্রাসীদের তালিকায় কোন কওমী মাদরাসার শিক্ষক বা ছাত্র জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে না। দেশপ্রেমিক ঈমানদার খাঁটি মানুষ তৈরির কারখানাই হলো কওমী মাদরাসা।
কওমী মাদ্রাসার দরসে নিজামী প্রতিষ্ঠা :
১১০০ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকহারে থাকলেও তা কোনো সিলেবাসভিত্তিক বা কারিকুলামের আলোকে ছিল
না। ১১০৫ হিজরিতে মোল্লা নিজামুদ্দীন সাহলাভী ইসলামী শিক্ষাকে ঢেলে সাজান। তিনিই দরসে নিজামী মাদরাসা শিক্ষা
পদ্ধতির চালু করেন।শায়খ নিজামুদ্দীন সাহালীতে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের সূচনা করেন।তারই প্রপৌত্র শায়খ হাফিজের জ্ঞানসাধনায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আকবর তাকে ঐ এলাকায় ভালো একটি জায়গীর প্রদানের নির্দেশ দেন। ইসলামের শত্রুরা
১৬৯১ সালে মোল্লা নিজামুদ্দীনের পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তার শিক্ষা উপকরণসমূহ জ্বালিয়ে দেন। ফলে
মোল্লা নিজামুদ্দীনসহ চার ভাই লাখনৌ চলে যান।সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পরিবারের শিক্ষার অবদানের কথা বিবেচনা করে লাখনৌর প্রসিদ্ধ ফিরিঙ্গী মহলে এক সরকারি আদেশবলে জায়গীর দান করেন। মোল্লা নিজামুদ্দীন এখানে দ্বীনি শিক্ষার
কাজ চালিয়ে যান, এমন সময় এটাই মাদরাসায়ে নিজামিয়া নামে সুপরিচিতি লাভ করে। তিনি গঠনমূলকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রায় ১১টি বিষয়ের সমন্বিত একটি সিলেবাস প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে এটাই দরসে নিজামীয়া পদ্ধতি
নামে পরিচিত।
মোল্লা নিজামুদ্দীনকে সম্রাট আওরঙ্গজেব জায়গীর দেন।
১১০৭ হিজরিতে গাজীউদ্দীন খান আজমীর গেটস্থ একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে দিল্লী কলেজ নামে প্রসিদ্ধ। এখানের ছাত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মাওলানা কাসেম নানুতুবী, মাওলানা রশিদ আহমাদ গাংগুহী (রহ.)। কালক্রমে মাদরাসাটির শিক্ষা কার্যক্রমের বিকৃতি ঘটে এবং কলেজে পরিণত হয়।“সিরাতে মুস্তাকীম” তথা সঠিক সরল পথের সংরক্ষক ও অতন্দ্র প্রহরী।যা রাসূল (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবে‘ঈন, তাবে‘ঈন থেকে তাবে তাবে‘ঈনও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে। অতঃপর আইম্মায়ে মুজতাহিদীন থেকে প্রত্যক যুগেই এ আমানত উম্মতের নির্বাচিত মনীষীগণের মাধ্যমে পৌঁছেছে। নিঃসন্দেহে তা সামষ্টিকভাবে অক্ষত। এভাবে দ্বীনের স্থায়ী সংরক্ষণ হয়ে আসছে।
কওমী মাদরাসার অবদান :
আল্লাহ তায়ালা কওমী আলেম-ওলামা দ্বারা বিগত দিনগুলোতে দেশ-জাতি ও দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন-তা দৃষ্টান্তহীন। হেদায়াতের এমন কোন পথ নেই, যাতে কওমী আলেম দ্বারা পথনির্দেশিকা স্থাপন করা হয়নি। বিশ্ব পরিস্থিতিতে দ্বীনের অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সচেতন করে তোলেন কওমী ওলামায়ে কেরাম। তারা ধর্মহীনতা, বদদ্বীনি, নাস্তিকতার প্লাবনে ভেসে যাওয়া মুসলমানদের পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।তারা বর্তমান সময়ে ইসলাম
এবং মুসলিম জাতির হেফাযতের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন।কুরআনের অপব্যাখ্যা, বিকৃত ব্যাখ্যা কারীদের দাঁতভাঙ্গা
জবাব দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে এ সম্পর্কে সচেতন করেন। দেশ ও জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায়
অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। ভারত বর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জিহাদের ফতোয়া প্রদান করেন শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী
(রহ.)। এদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক সুস্থ চিন্তাধারার বিকাশ, দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হয় কওমী মাদরাসার সূর্য সন্তানদের মাধ্যমে।