ওরস ও মাযার : কিছু প্রয়োজনীয় কথা

ইসলাম মানবজাতির জন্য হেদায়েতের আলো। মানুষের চিন্তা ও কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এবং সকল
ভ্রান্তি ও প্রান্তিকতা থেকে রক্ষা করার জন্য এই দ্বীন আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। তাই একজন প্রকৃত মু’মিন যেমন
মূর্খতা ও অবিশ্বাসের শিকার হতে পারেন না তেমনি অজ্ঞতা ও অন্ধ-বিশ্বাসেরও শিকার হন না। সকল প্রকার কুফর ও
শিরক থেকে আল্লাহ তার চিন্তা ও কর্মকে রক্ষা করেন। কুফর ও শিরক হল মানব-সমাজের সবচেয়ে বড় কুসংস্কার। মানুষ
এই কুসংস্কারের শিকার তখনই হয় যখন ইসলামের শিক্ষাকে ত্যাগ করে মনগড়া ও কল্পনাপ্রসূত মতবাদের অনুসরণ করে। পৃথিবীতে যত প্রকারের শিরক ও কুফর আছে সবগুলোর মূলে রয়েছে বিভিন্ন কাল্পনিক ও অবাস্তব ধারণা। এজন্য কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-  ‘তোমরা অপবিত্রতা থেকে তথা মূর্তিসমূহ থেকে দূরে থাক। আর দূরে থাক মিথ্যাকথন থেকে।’-সূরা হজ্ব : ৩০-৩১ বস্তুত মিথ্যাই সকল পৌত্তলিকতার জনক। অতএব পৌত্তলিকতা থেকে মুক্ত থাকতে হলে
মিথ্যার সকল ছিদ্রপথ বন্ধ করতে হবে। তদ্রূপ কল্পনাপ্রসূত ধারণার উপর ভিত্তি করে ভক্তি নিবেদনে সীমালঙ্ঘন করারও
সুযোগ নেই। এ জাতীয় সকল ধারণা ও আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যেমন সত্যবিমুখ অবিশ্বাসীদের মর্মন্তদ পরিণাম ঘোষণা করেছেন তেমনি ধর্মের নামে ভিত্তিহীন কর্ম ও বিশ্বাস প্রচারকারীদেরকে ‘আল্লাহর
উপর মিথ্যারোপকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব দু’টোই গোমরাহী ও সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। হেদায়েতের সিরাতে মুসতাকীম হচ্ছে সকল বাতিল মত ও পথ থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হওয়া এবং চেতনা ও বিশ্বাস, কর্ম
ও আচরণ সকল ক্ষেত্রে নবী সা. এর পূর্ণ আনুগত্য করা। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,  ‘বলুন, আমার
প্রতিপালক আমাকে একটি সরল পথে পরিচালিত করেছেন, যা বক্রতা হতে মুক্ত দ্বীন, ইবরাহীমের দ্বীন, যিনি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহ-অভিমুখী করে রেখেছিলেন। আর তিনি ছিলেন না শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ – সূরা আনআম : ১৬১
ওরসঃ- ওরস আরবী শব্দ। এর অর্থ মিলন। কোন বুযুর্গ বা পীরের মাযারে তাঁর মৃত্যূ দিবস পালনের নামে ধর্মীয় জলসার আয়োজন করা। এবং তাঁর ভক্ত জনগনের মিলন ভিড় অর্থাৎ একটি মেলার রূপ ধারণ করা।

ওরস ও মাযারকেন্দ্রিক কার্যকলাপের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট:

মাযারকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে যেসব অনাচার হয়ে থাকে তার অধিকাংশই রিপুতাড়িত কর্মকাণ্ড। নারী-পুরুষের
অবাধ মেলামেশা, গান-বাদ্য এবং মদ ও গাঁজা হচ্ছে মাযারকেন্দ্রিক মেলা ও ওরসের অন্যতম অনুষঙ্গ। এগুলোর তাত্ত্বিক
সূত্র একটিই। তা হচ্ছে, নোংরামী ও রিপুর চাহিদা-পূরণ। এজন্য দেখা যায়, এইসব মাযার-ওরসে অংশগ্রহণকারীদের
সিংহভাগ হল সমাজের অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী।
দ্বিতীয় অনাচার মাযারের সেবক বা পাণ্ডাদের বৈষয়িক ধান্দা। এরা মাযারে আগত নারী-পুরুষের দান-দক্ষিণা ও মান্নত
কোরবানী গ্রহণ করে এবং ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ও আশীর্বাণী বিক্রি করে। বলাবাহুল্য, এখানে তত্ত্বের চেয়ে বৈষয়িক
দিকটিই বড়। তৃতীয় অনাচার হচ্ছে কুফর ও শিরক। মাযারপন্থী বা মাযারে আগত লোকেরা বিভিন্ন কুফরী ও শিরকী ধারণা পোষণ করে। যেমন মাযার বা মাযারে শায়িত ব্যক্তিকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করা; হাজত-পূরণকারী, বালা
মুসীবত থেকে উদ্ধারকারী এবং মানুষের উপকার-অপকারের মালিক মনে করা ইত্যাদি। এসকল শিরকী বিশ্বাস থেকে তারা বিভিন্ন শিরকী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। যথা : মাযারের নামে মান্নত করা, মাযারে এসে সিজদা করা, পশু জবাই করা,
মাযারওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে রোনাযারী করা এবং মাল-দৌলত, সন্তান-সন্ততি, সুস্থতা ও সচ্ছলতা প্রার্থনা করা ইত্যাদি।
এভাবে বিশ্বাসের শিরক মানুষকে কর্মের শিরকের মাঝেও লিপ্ত করে দেয়। চতুর্থ ও সর্বশেষ অনাচারটি হল কুরআন-সুন্নাহ
এবং দ্বীন-শরীয়তের বিকৃতিসাধন। মাযারকেন্দ্রিক সকল গর্হিত কার্যকলাপের পক্ষে সামপ্রদায়িতাধর্মী জেদ ও হঠকারিতা
সৃষ্টির লক্ষ্যে একশ্রেণীর আলখেল্লাধারী গুরু বিভিন্ন অবাস্তব ধারণা প্রচার করে এবং নির্দ্বিধায় কোরআন-সুন্নাহর তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা শুধু ‘অপব্যাখ্যা’ থাকে না; বরং জরুরিয়্যাতে দ্বীন বা দ্বীনের সর্বজনবিদিত আকীদা
ও আমলকে অস্বীকার করা হয়। এ বিষয়টি মাযারপন্থী গুরুদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।

ওরস , মাযার, ও মাযারকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের শরয়ী বিধান:

এ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হলে উপরোক্ত চারটি বিষয়ে কোরআন ও সুন্নাহর বিধান জানতে হবে।
এক. রব একমাত্র আল্লাহ আল্লাহ তাআলা কুল মাখলুকের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সৃষ্টির অস্তিত্ব ও বিলুপ্তি তাঁরই হাতে।
মানুষের জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা-অসুস্থতা, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, উন্নতি-অবনতি, এককথায় সকল কল্যাণ ও অকল্যাণ
একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। তাঁর ইচ্ছায় সব কিছু হয়, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। তাঁর কোনো সহযোগী নেই এবং
তিনি কোনো উপায়-উপকরণের মুখাপেক্ষী নন। কারণ পৃথিবীর সকল বস্তু তাঁর সৃষ্টি, জীবন ও জীবনোপকরণ তাঁর সৃষ্টি,
প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিয়ম তাঁরই সৃষ্টি। গোটা জাহান তাঁর মাখলুক এবং কুল মাখলুক তাঁরই আদেশের অধীন। কোনো
মাখলুকের তাতে বিন্দুমাত্র অংশীদারিত্ব নেই। তদ্রূপ উপায়-উপকরণ ছাড়া কাজ করার ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা
অন্য কাউকে দান করেননি। ইরশাদ হয়েছে- ‘সাবধান! সবকিছু তাঁরই সৃষ্টি এবং আদেশও একমাত্র তাঁর।-আ’রাফ : ৫৪
অতএব কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখে যে, তিনি কোনো উপায়-উপকরণ ছাড়া
অলৌকিকভাবে হাজত পূরণ করতে পারেন, মুসীবত থেকে রক্ষা করতে পারেন, পরিস্তিতিকে অনুকূল বা প্রতিকূল করতে পারেন তাহলে তা হবে পরিষ্কার শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘বলুন, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে উপাস্য মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা তো অণু পরিমাণ কোনো কিছুরও মালিক নয়, না আসমানের, না যমীনের। আর না (আসমান-যমীনে) তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে, আর না তাদের মাঝে রয়েছে আল্লাহর কোনো সহযোগী!’-সূরা সাবা : ২২ অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আসমান ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান
করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশালী। সূরা শূরা : ৪৯-৫০ এজন্য মাযারপন্থীরা মাযার বা মাযারে শায়িত ব্যক্তি সম্পর্কে
যে অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে তা সম্পূর্ণ শিরক। ফিকহের কিতাবে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘কোনো মৃত ব্যক্তিকে তাসাররুফ ক্ষমতার অধিকারী (অর্থাৎ গায়বী ক্ষমতা-বলে কার্যসম্পাদনে সক্ষম) মনে করা কুফরী। আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৮। বুযুর্গানে দ্বীন সর্বদা তাদের অনুসারীদেরকে এই গর্হিত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন।

ইবাদত ও উপাসনা একমাত্র আল্লাহর জন্য:

দুই. ইবাদত একমাত্র আল্লাহর যেহেতু আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা তাই ইবাদতও একমাত্র তাঁর।
আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য হতে পারে না। রুকু, সেজদা, দোয়া, যিকির, হজ্ব, কোরবানী ইত্যাদি খালিস ইবাদত। অতএব আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য তা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন- ‘বলুন, আমার
নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমাকে
এরই আদেশ করা হয়েছে এবং আমি প্রথম আনুগত্যকারী।-সূরা আনআম :১৬২-১৬৩ অতএব কেউ যদি গায়রুল্লাহর
নৈকট্য অর্জনের জন্য সেজদা করে, কোরবানী করে, গায়রুল্লাহকে সন্তষ্ট করার জন্য তার নাম জপতপ করে, মানবীয়
ক্ষমতার উর্ধ্বের কোনো বিষয় গায়রুল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, কোনো মাযার-দরগাহ্‌র উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর মতো তীর্থযাত্রা করে, মাযার-দরগাহর তওয়াফ করে এবং দেয়ালে ভক্তিভরে চুম্বন করে, মোটকথা, যেসব কাজ আল্লাহ তাঁর উপাসনার
জন্য নির্ধারণ করেছেন তা গায়রুল্লাহর জন্য করে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ শিরক। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : তাসাওউফ: তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা : ২১২-২২৯
তিন. হারামকে হালাল মনে করা কুফরী
গান-বাদ্য, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা যে সম্পূর্ণ হারাম তা বলাই বাহুল্য। এটি জরুরিয়্যাতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ দ্বীনের একটি সর্বজনবিদিত বিধান। অথচ এই অকাট্য হারামগুলিই হচ্ছে মাযার ওরস এর অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ‘‘তাফসীরে আহমদিয়া’’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ৬০৪-৬০৫) বলা হয়েছে, ‘বর্তমান যুগে লোকেরা ‘সামা’র ব্যাপারে খুব
তৎপর। তারা মদ পান করে মাতাল হয় এবং অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়। দুশ্চরিত্র লোকেরা শ্মশ্রুবিহীন সুশ্রী বালকদের
একত্র করে এবং গানবাজনা করে। এগুলো যে কবীরা গুনাহ তা বলাই বাহুল্য। আর এগুলোকে হালাল মনে করা সুস্পষ্ট
কুফরী।’ এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এইসব হারাম কাজকে ওরস ও মাযারপন্থীরা শুধু যে হালাল মনে করে তা-ই নয়;
বরং আধ্যাত্মিকতার নামে একে আল্লাহর নৈকট্যের উপায় বলেও প্রচার করে থাকে! নাউযুবিল্লাহ! শরীয়তের দৃষ্টিতে
যেখানে হারামকে হালাল মনে করাই কুফরী সেখানে একে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উপায় মনে করা যে কত জঘন্য
কুফরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চার. ওরস বা মাযারের হজ্ব!

এ পর্যন্ত যে সকল শিরকী বিশ্বাস ও কর্মের কথা বলা হয়েছে তার যে কোনো একটিও কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে
খারিজ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথচ বর্তমানে ওরস এর নামে যেসব কর্মকাণ্ড হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাতে
উপরোক্ত সবগুলি শিরক বিদ্যমান থাকে। বস্তুত বিশ্বাসগত ও কর্মগত অসংখ্য শিরকের সমষ্টি হচ্ছে প্রচলিত ‘ওরস’।
একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, বেদ্বীন-মুলহিদ শ্রেণী ওরসের নামে বাইতুল্লাহর হজ্বের মতো মাযারের হজ্ব প্রবর্তন
করেছে। নাউযুবিল্লাহ! এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দাঃ বাঃ র একটি আলোচনা উল্লেখ করে
প্রসঙ্গটি শেষ করছি। ‘‘প্রচলিত ওরস হচ্ছে কাবা শরীফের হজ্বের ন্যায় মাযারের হজ্বের অপর নাম। এ ওরস সম্পর্কে
একটু ভাবা উচিত। ‘কুরআন-হাদীসে হজ্বের হাকীকত এবং তা আদায় করার পদ্ধতি সবিস্তারে বলা হয়েছে, যার
সারসংক্ষেপ এই যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
যেমন-কাবা, আরাফা, মুযদালিফা, মিনা ও হারাম শরীফ ইত্যাদি।
এবং মানুষকে সেসব স্থান যিয়ারতের আদেশ করেছেন। তাই পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে সফর করে ঈমানদারগণ এ
পবিত্র স্থানগুলোর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমবেত হয়। তারা মহান প্রভূ আল্লাহ তাআলার
নির্দেশে সফরের কষ্ট সহ্য করে সেলাইবিহীন বিশেষ পোশাকে উপস্থিত হয় এবং আল্লাহ তাআলার হুকুমে তাঁর নামে
কোরবানী করে, মান্নত আদায় করে এবং কাবা শরীফের তাওয়াফ করে। যেখানে যেখানে আল্লাহ তাআলা তাকবীল
(চুম্বন করা), ইলতিযাম (জড়িয়ে ধরা) এবং সাঈ তথা দৌড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সেসব স্থানে তা যথাযথ পালন করে।
তারা আল্লাহ তাআলার নিকট বিভিন্ন প্রয়োজন কামনা করে এবং তার শাহী দরবারে দুআ করে। এ কাজগুলোকেই
শরীয়তের পরিভাষায় হজ্ব বলা হয়। হজ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর ইবাদতমাত্রই এক আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
এ কাজগুলোই যদি গায়রুল্লাহর জন্যে করা হয়, তাহলে তা হবে শিরক এবং সে ব্যক্তি হবে মুশরিক।

যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করা হয়,

তাহলে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে মাযারগুলোতে ওরসের নামে সাধারণত যা হয়ে থাকে তা মূলত
হজ্বের কাজ। মাযারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সফর করা হয়। হজ্বের হাদীর ন্যায় সাথে পশু নেওয়া হয়। বিশেষ বিশেষ স্থান ও
কবরগুলো তাওয়াফ করা হয়, কবরে সিজদা করা হয়। কবরের পর্দা ও খুটিতে ভক্তিভরে চুম্বন করা হয়, জড়িয়ে ধরা হয়, কবরবাসীর উদ্দেশ্যে কুরবানী করা হয়। মান্নত আদায় করা হয়। মাযারকে হারাম শরীফের ন্যায় সম্মান করা হয়। শুধু তাই
নয়, সরাসরি কবরস্থ ব্যক্তির কাছে আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্যে, কাজ সমাধা হওয়ার জন্যে, মনের বিভিন্ন বাসনা পূর্ণ
হওয়ার জন্যে প্রার্থনা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হজ্বের স্থানসমূহের সম্মান ও ভক্তির চাইতে মাযারের ভক্তি-শ্রদ্ধাই মাযারপন্থীদের অন্তরে বেশি ও গভীর হয়ে থাকে। এ সব কাজ যদি শিরক না হয় তবে শিরক আর কিসের নাম?’’
(তাসাওউফ : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ পৃ. ২২৮)

পাঁচ. কবর-যিয়ারতের সাথে ওরস বা এসব অনাচারের কোনো সম্পর্ক নেই:

ইসলামে কবর যিয়ারতের বিধান আছে, কিন’ কবরকে উৎসবের স্থানে পরিণত করার অবকাশ নেই। কবর যিয়ারতের
উদ্দেশ্য হল, আখিরাতের স্মরণ জাগ্রত করা এবং কবরবাসীর জন্য দোয়া করা। হাদীস শরীফে আছে, নবী সা. ইরশাদ
করেন, ‘‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা যিয়ারত করতে পার। কারণ তা
আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২১২৭)
নবী সা. নিজেও তাঁর সাহাবীদের কবর যিয়ারত করেছেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। যিয়ারতেরও
মাসাইল ও নিয়মকানুন আছে। সে মোতাবেক কবর যিয়ারত করলে তা হবে ছওয়াবের কাজ। পক্ষান্তরে কোনো কবরকে ‘মাযারে’ পরিণত করে বছর বছর নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হওয়া এবং উৎসবে পরিণত করা সম্পূর্ণ হারাম। হাদীস শরীফে
পরিষ্কার ভাষায় তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক হাদীসে নবী করীম সা. বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানিয়ো
না। (অর্থাৎ কবরের মতো ইবাদত-বন্দেগী শূন্য করো না) এবং আমার কবরকে উৎসবের স্থান বানিয়ো না। বরং আমার
প্রতি দরূদ পড়। কেননা তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছবে।’-সুনানে আবু দাউদ,
হাদীস : ২০৪০ তো নবী সা. এর কবরকেই যখন উৎসবের স্থান বানানোর অবকাশ নেই তখন অন্যদের কথা তো বলাই
বাহুল্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সব ধরনের গোমরাহী থেকে রক্ষা করুন এবং সঠিক পথে চলার তাওফীক
দান করুন।
লেখক:- মাওলানা হাবিবুর রহমান, প্রতিষ্টাতা মুহতামিম দারুল উলুম মাদরাসাতুল উম্মাহ ফ্রান্স।