এমএলএম বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-(চতুর্থ ও শেষ পর্ব)

প্রশ্নোত্তর পর্ব:

প্রশ্ন : দালাল কাজ করলে পারিশ্রমিক পাবে, কাজ না করলে পাবে না। এর উদাহরণ তো ফিকহের কিতাবে আছে। সুতরাং
সে অনুযায়ী ক্রেতা-পরিবেশক কোম্পানির নির্ধারিত টার্গেট পূরণ করলে কমিশন পাবে, না হয় পাবে না। এতে তখন বিনিময়হীন শ্রমের ত্রুটি থাকবে না।

উত্তর : কাজ করলে পারিশ্রমিক পাবে আর কাজ না করলে পাবে না-এটি أجير مشترك -এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর এমএলএম
এ পরিবেশক তথা দালালকে আলআজীরুল মুশতারাক বলা যায়। (দেখুন : ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৫/৯৭) কিন্তু আজীরে মুশতারাক অল্প কাজ করলেও সে অনুপাতে তাকে উজরত দিতে হবে।

(এ প্রসঙ্গে ফিকহী হাওয়ালা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এমএলএম কোম্পানিতে যেহেতু অল্প কাজ করলে, যদি টার্গেট
পূর্ণ না হয়, কমিশন দেওয়া হয় না তাই এটি বিনিময়হীন কাজের মধ্যে পড়বে। যেমন অনেক কোম্পানিরই এমন শর্ত রয়েছে যে, ডান-বাম  উভয় দিকে দুইজন করে নেট চলতে হবে। যদি কোনো এক দিকে চলে অন্য দিকে না চলে অথবা একজন জোগাড় হয় দুইজন না হয় তাহলে কমিশন দেওয়া হয় না।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, তারা কাজ ছাড়া বিনিময় নেয়। অথচ তাদের সকলের কাজ করার কথা ফরমে লেখা আছে। অর্থাৎ ডাউন লেভেলের লোকদের জন্যও আপ লেভেল ওয়ালাকে অনেক শ্রম দিতে হয়।

উত্তর : এমএলএম বিষয়ে প্রথম ফতোয়ার পর তারা ফরমে ঐ কথাগুলো লিখেছে:

ফরমে লিখার আগেই বলত, এখানে কেউ কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। নেট চালানোর জন্য কষ্ট করতে হয়, দৌড়াতে হয়।
এর জবাব খুবই স্পষ্ট। একটা কথা হল, কাজ করা, কাজের জন্য দৌড়ঝাপ দেওয়া, কিন্তু তা যদি হয় অন্যের কাজ, সেই
কাজটি যদি লেখা হয় অন্যের নামে তখন তো আর সেটিকে নিজ কাজ বলা চলবে না। অর্থাৎ এখানে দেখতে হবে কাজের নিসবত কার দিকে হয়েছে। এখানে প্রথম ব্যক্তি (উদাহরণস্বরূপ ‘ক’) যদি তৃতীয় লেভেলে কাউকে ভিড়ানোর জন্য কাজ
করে তবে সেটি পরবর্তী স্তরের লোকের কাজ। ‘ক’ কেবল তাকে তার কাজে সহযোগিতা করছে। কোম্পানি বলেন, শরীয়ত বলেন, আইন বলেন, কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি ক-এর কাজ নয়; বরং দ্বিতীয় স্তরের লোকের কাজ। যদি এটি ‘ক’-এর
কাজ হত তাহলে ঐ পরিমাণই কমিশন পেত, যে পরিমাণ পেয়েছিল প্রথম দুজনকে বানিয়ে। যদি এ রকম হত যে, ‘ঙ’ যা
পাচ্ছে এর একটি অংশ ‘ক’কে দিয়ে দিচ্ছে তাহলে দাবিটার কিছু যুক্তি থাকত। কিন্তু সে দিবে না; বরং উল্টো বলবে, আরে
মিয়া! আর কত খাবেন। তো সে কাজ করেছে অন্য ব্যক্তির জন্য। আর বিনিময় দিচ্ছে কোম্পানি। কাজের সম্পর্ক একজনের সাথে আর বিনিময়ের সম্পর্ক আরেকজনের সাথে। দেখুন এ দুটিতে কি মিল আছে!!

খোদ কোম্পানির সফটওয়ারেই ঐ ব্যক্তিকে নিম্নস্তরের ব্যক্তি কর্তৃক নিয়ে আসা লোক হিসাবে ধরা হয় এবং রেফারেন্স
হিসেবে তার নম্বরই ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এটি যেহেতু প্রথম ব্যক্তির কাজ নয় তাই ঐ কাজের জন্য প্রাপ্ত কমিশন উজরত
বেলা আমল তথা কাজহীন বিনিময়ের অন্তর্ভুক্ত।

প্রশ্ন : সে তো কোম্পানির আজীর তথা পরিবেশক।

উত্তর : সে কোম্পানির পরিবেশক তা ঠিক। কিন্তু সে চাকরিজীবি নয়। কোম্পানি তাকে এমন কোনো পদে নিয়োগ দেয়নি
যে, সময় দিলেই সে বেতন পেতে থাকবে। বরং কোম্পানি বলছে, আপনি চারজন লোক কোম্পানিতে ভেড়ালে তারা এবং তাদের অধস্তনরা আরো যত লোক নিয়ে আসবে সকলের জন্য আপনাকে কমিশন দেওয়া হবে।

প্রশ্ন : ফতোয়াতে صفقة في صفقتين -এর কথা আছে। এটি কিভাবে হয়? তারা বলে, পণ্যের সাথে পরিবেশক সুবিধা ফ্রি দেওয়া
হচ্ছে। যেমন হারপিকের সাথে মগ ফ্রি দেওয়া হয়। এখানেও চুক্তি একটিই হয়।

উত্তর : হারপিকের সাথে মগ, দুটো মিলে একটি পণ্য । অর্থাৎ একই মূল্যে আপনি ২টি পণ্য পাচ্ছেন। আর এখানে
ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে ইজারা চুক্তিকে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। ২টা পণ্যকে এক করা আর ২টা চুক্তিকে এক করা এক বিষয়
নয়। ফিকহে ইসলামীর সাধারণ তালিবুল ইলমও এ ফরক বুঝে থাকে।

প্রশ্ন : ‘আলজুআলা’ চুক্তি কোনো কোনো মাযহাবে জায়েয আছে। অতএব বিষয়টিকে যদি আলজুআলা চুক্তি ধরা হয়
তাহলে তো উপরোক্ত ত্রুটি থাকবে না?

উত্তর : আলজুআলার জন্যও কাজ শর্ত। কিন্তু  এখানে তা নেই। কেননা পরবর্তী স্তর থেকে যে কমিশন আসে সেখানে
প্রথম ব্যক্তির নিজস্ব কোনো কাজ নেই।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের ৩ ভাগের ২ ভাগ মানুষ যদি এমএলএমে শরিক হয় তাহলে তা তাআমুলের পর্যায়ে পড়বে কি না?
এবং সে ভিত্তিতে তা জায়েয হবে কি না?

উত্তর : না। ১৬ কোটি মানুষও যদি এতে শরিক হয় তবুও তা জায়েয হবে না। তাআমুল ঐ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
যেখানে বিষয়টি সরাসরি শরীয়তের নুসূস ও উসূলের পরিপন্থী নয়।

প্রশ্ন : উপর স্তর যেমন-ক এবং নিম্ন স্তর যেমন-ঙ উভয়ে পরস্পরে যদি কমিশন পাওয়ার ব্যাপারে রাজি থাকে তাহলে
কমিশন গ্রহণ বৈধ হবে কি না? আমরা তো অনেক কিছুই বিনা পরিশ্রমে পেয়ে থাকি।

উত্তর : চুক্তি হয়েছে ক-এর সাথে কোম্পানির। আর কমিশনও দিচ্ছে কোম্পানি। ক-এর সাথে ঙ-এর আকদ হয়নি।
সুতরাং তারা উভয়ে রাজি হওয়া না হওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর। এছাড়া রাজি হলেই কি সব বৈধ হয়ে যায়। দুনিয়ার কত
নিষিদ্ধ কারবার যেমন-সুদ, জুয়া ইত্যাদি সবই তো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই হয়।

প্রশ্ন : এমএলএম এর মধ্যে Buy back কিভাবে হয়? একটু বুঝিয়ে বলবেন।

উত্তর : Buy back হল পণ্যটা বিক্রেতা কর্তৃক কম মূল্যে পুনরায় খরিদ করে নেওয়া। এটি আগে ছিল। এখন আছে কি না
জানি না। দুই কারণে এমনটি করা হত : এক. ৩ হাজার টাকার পণ্য ৭ হাজার দিয়ে মানুষ কিনতে চাইত না। তাই কোম্পানি
বাধ্য হয়ে বাই ব্যাকের প্রচলন শুরু করে। দুই. আরেকটি কারণ হল, হুজুগের তালে এত লোক টংচেং জিঞ্জিয়ানে যোগ
দিতে লাগল যে, এত বেশি পণ্য দিয়ে কোম্পানি কুলিয়ে উঠতে পারত না। তাই এ পদ্ধতি জারি করেছিল তারা।

প্রশ্ন : ট্রি প্ল্যান্টেশনের হুকুম জানতে চাই।

উত্তর : পূর্বে বলেছি, এমএলএম সিস্টেমটা যেমনিভাবে নাজায়েয, তেমনিভাবে এ সিস্টেমভিত্তিক যেসব কোম্পানি রয়েছে সেগুলোও নাজায়েয। তবে অধিকাংশ এমএলএম কোম্পানিতে নেট পদ্ধতির ত্রুটি ছাড়াও অন্যান্য উপাদানও থাকে।
যেমন এমএলএমভিত্তিক একটি কোম্পানি ইউনি পে টু ফর ইউ তাদের কারবারটা ছিল লোকদের থেকে টাকা নিয়ে নিত
প্রথম ধাপেই ২২% লাভের চুক্তিতে। ১ লক্ষ টাকায় ২২ হাজার টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলত। তো লাভ নির্ধারিত হওয়ার
কারণে কারবারটি নাজায়েয হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। অন্য কিছু দেখার দরকার হয় না। অতি মুনাফালোভী
সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর কিছুদিন আগে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে
ঐ কোম্পানিটি।

ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড:

এ ধরনেরই আরেকটি কোম্পানি হল, ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড। সদস্যদের কাছে গাছ বিক্রি করে চলেছে তারা। কত কোটি
গাছ (!) ইতিমধ্যে বিক্রি হয়েছে তার হিসাব শুধু তারাই বলতে পারবে। আমাকে কেউ যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে তখন
সহজে বোঝানোর জন্য বলি, বাংলাদেশের মোট আয়তন কতটুকু? বনায়নের জন্য কতটুকু জায়গা খালি আছে? ঐ
এমএলএম কোম্পানিকে সরকার কতটুকু জায়গা লীজ দিয়েছে? কৃষি বিজ্ঞানে কত হাত পর পর কয়টা গাছ লাগানোর
কথা আছে? সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ কতটি গাছ লাগানো যাবে?

তাদের অফিসে হাজার হাজার লোক ভীড় করে। প্রত্যেককে ৩০টি করে গাছ দিলে কয় লক্ষ গাছের প্রয়োজন? এগুলো
তারা কোথায় লাগিয়েছে? এবং আকদ যখন হয় তখন বাস্তবে গাছ ছিল কি না? এতটুকু বললে সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলে
এবং বলে, তার মানে এ ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর আলেমদেরকে বলতে হলে, ফিকহী ভাষায় বলতে হয়। যেমন তাদের বইয়ে আছে, কোনো গাছ অগ্নিকান্ড অথবা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সংশ্লিষ্ট
প্যাকেজ অনুযায়ী অর্থাৎ গোল্ডেন প্যাকেজের ক্ষেত্রে প্রতি সনদপত্রের বিপরীতে ছয় বছর পর মোট ২০,০০০/- টাকা
এবং ক্ল্যাসিক প্যাকেজের ক্ষেত্রে প্রতি সনদপত্রের বিপরীতে ১২ বছর পর মোট ৫০,০০০/- টাকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে
কোনোরূপ প্রভাব ফেলবে না। (পরিচিতি, শর্ত ও নিয়মাবলি, ৯ নং অনুচ্ছেদ)

এবার বুঝুন, গাছ বিক্রি করা হল, না কি বেশি টাকা দেওয়ার শর্তে কম টাকা নেওয়া হল। এখন এটি নাজায়েয হওয়ার জন্য
অন্য কিছুর দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। এমএলএম সিস্টেম ছাড়াই এটি নাজায়েয। এছাড়া তাতে নাজায়েয ইন্সুরেন্সও
যুক্ত রয়েছে।

প্রশ্ন : ফতোয়া আসার পর তারা এমএলএম-এর বিকল্প চেয়েছিল কি না?

উত্তর : ফতোয়া আসার পর তারা আমাদের নিকট এসেছিল। বলেছিল, আপনারা ফতোয়া দিয়েছেন। এটি শরীয়তের বিষয়। আমাদের কিছু বলার নেই। এবার আপনি আমাদের পরামর্শ দিন। আমার শরীয়া অনুযায়ী চলব। আপনারা যা যা শর্ত দিবেন
সব মানব। আমি বললাম, আপনারা মানতে পারবেন না। তারা বলল, না, মানব। প্রয়োজনে লিখে দিতে পারি।

আমি জানতাম, তারা মানবে না। তাদের না মানার কারণ স্পষ্ট। এমএলএমের আসল রহস্য নেট সিস্টেম। এর মাধ্যমেই মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়। যা হোক, আমি বললাম, যদি শরয়ী তরীকায় আসতে চান তাহলে এই নেট সিস্টেম তুলে দিতে
হবে। শুধু এক স্তর থাকবে। এবং দুইটা চুক্তি ভিন্ন ভিন্ন হবে। সাধারণ ব্যবসার মতো ক্রেতা ভিন্ন থাকবে। পরিবেশক ভিন্ন
থাকবে। বড় বড় কোম্পানিকে দেখবেন, তারা মাঝেমধ্যে পরিবেশক সম্মেলন করে। যারা তাদের পণ্য বা সেবা বেশি
পরিবেশন করেছে তাদেরকে কোম্পানি নিজের টাকা থেকে বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করে। বোনাস, ইনসেনটিভ নামে
অনেক কিছু দেয়। আমি জানি আপনারা এ পথে আসবেন না। কারণ আপনাদের মূল আকর্ষণ নেট সিস্টেম। সেটা বাদ
দেওয়ার চিন্তা আপনারা করবেন না।

প্রশ্ন : এমএলএম পদ্ধতির কারবার ও অন্যান্য কারবারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী?

এমএলএম বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-(চতুর্থ ও শেষ পর্ব)
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং

উত্তর : দুনিয়ার অন্যান্য কারবারে মূল উদ্দেশ্য হয় সেবা/পণ্য বিক্রি করে লাভবান হওয়া এবং ক্রেতার ক্ষেত্রে পণ্য/সেবা দ্বারা উপকৃত হওয়া। কিন্তু এখানে পণ্য কারোরই মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হল পণ্যকে ছুঁতা বানিয়ে মানুষকে নেট সিস্টেমের ভিতরে নিয়ে এসে তাদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। আর ক্রেতাগণ এ পদ্ধতিতে বাধ্য হয়েই পণ্য নিয়ে থাকে। কারণ তারা পণ্য খরিদের জন্য এসব কোম্পানিতে যায় না; বরং কমিশন ও বোনাস লাভের উদ্দেশ্যেই যায়।

আপনি গুগলে সার্চ করলে দেখতে পাবেন তাতে অনেক এমএলএম কোম্পানির এ্যাড আছে। একটা এ্যাডের শিরোনাম এ রকম-এক মাসে টাকা দ্বিগুণ করুন। বুঝে দেখুন, কোন কৌশলে টাকা কামাতে চায়। যেখানে ব্যাংকে টাকা দ্বিগুণ করতে
লাগে ৫-৬ বছর। তাও যদি মাঝে টাকা না ওঠানো হয়। ফিক্সড ডিপোজিট করা হয় তখন। এর বিপরীতে এখানে মাত্র এক
মাসে টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে!

 

প্রশ্ন : বাস্তবে এমএলএম-এর কোনো বিকল্প আছে কী?

উত্তর : ফিকহের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের উচিত সম্ভাব্য বিকল্পও বলে দেওয়া, কিন্তু এটি কখন? সবক্ষেত্রেই কি বিকল্প
বলা যাবে, সবকিছুর বিকল্প হয় না। তাই সব কিছুর বিকল্প বলা সম্ভবও নয়। এমন জিনিসেরই বিকল্প হয় যেটা বিকল্পযোগ্য।
মদ নিষিদ্ধ। এর কি বিকল্প আছে? কোকাকোলা বা এ জাতীয় পাণীয় কি মদের বিকল্প? না। কারণ নেশা জাতীয় দ্রব্য ছাড়া
মদের বিকল্প হবে না। আর নেশা সৃষ্টিকারী সবকিছুই ইসলামে নিষিদ্ধ। সুতরাং এমএলএম-এর কোনো বিকল্প নেই। এটি মূল থেকেই হারাম। এ পদ্ধতি এ রকমই একটি বিষয়, যার বিকল্প নেই। যেমন সুদ। এর সত্যিকারের বিকল্প ইসলামের নেই।
মুদরাবা সুদের বিকল্প নয়। কেননা, মুদারাবাতে লোকসানের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। পক্ষান্তরে সুদখোর কখনো লোকসানের ঝুঁকি নিতে রাজি হয় না। পঁচা জিনিসের বিকল্প হয় না। পঁচা জিনিসের বিকল্প আনলে সেটাও পঁচা হবে। এক্ষেত্রে করণীয় হল, পঁচাটা বাদ দিয়ে সহীহটা নেওয়া। এমএলএম সিস্টেমটাই পঁচা। এর সহীহ বিকল্প নেই। তাই বিকল্প না চেয়ে এ কথা বলুন, অনেকেই এর সাথে জড়িয়ে গেছে। তাদের রুজি-রোজগারের কী ব্যবস্থা হবে। তারা জায়েয পন্থায় কীভাবে ব্যবসা করবে।
তখন বলব, হালাল রোজগারের অনেক পথ আছে। কিন্তু সেগুলো খোঁজ না করে আপনি যদি বলেন, এমএলএম-এর
সুবিধাযুক্ত বিকল্প দিন তাহলে এটি সম্ভব নয়। কেননা, ঐ সুবিধাগুলোই নিষিদ্ধ। সুতরাং ঐসব সুবিধাযুক্ত বিকল্প আসলে
সেটাও নিষিদ্ধ হবে। পরিশেষে বলব, এখনও যদি কেউ সহীহ পন্থায় সততা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করে তাহলে সে মানুষের
টাকা রাখার জায়গা পাবে না। মানুষ এখনো তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় রাখার জন্য শরীয়াসম্মত বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান চায়। এতে লাভ কম হলেও তারা রাজি থাকে। সবকিছুর বিকল্প হয় না এ বিষয়টি হযরত মাওলানা তকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম ‘উকূদুল মুস্তাকবিলিয়াত’-এর আলোচনায় (বুহুছ ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা ১/১৪৩) ব্যাখ্যাসহ লিখেছেন।

প্রশ্ন : পিরামিড স্কীম আমাদের দেশে ছিল কি না?

উত্তর : হুবহু ছিল না। এর কাছাকাছি কারবার কিছুদিন চালু ছিল। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কারো নামে অজ্ঞাত স্থান থেকে টাকা পাঠানো হত। সাথে লেখা থাকত, আপনি এ পরিমাণ টাকা অমুক দুইজনকে পাঠাবেন এবং এতে তার উপকারের
বিষয়টি বলা থাকত এভাবে সামনের দিকে নেট চলতে থাকত। এক সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই এ অভিনব কারবারটি বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু ততদিনে বহুলোক নিজ অর্থ সম্পদ হারিয়ে বসে।

প্রশ্ন : এমএলএম ওয়ালাদের একটি বই-এ লেখা আছে, আমাদের এই সিস্টেমে বহু স্তর থাকলেও এর দ্বারা বৃহত্তর
ভোক্তাশ্রেণী উপকৃত হয়। প্রথাগত পদ্ধতিতে শুধু এজেন্ট, ডিলার, পাইকারী বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতা এই গুটি কতক
লোক পণ্য হাতবদল করে উপকৃত হয়। তাদের এই কথার বাস্তবতা কতটুকু?

উত্তর : এটি তাদের একটি চটকদার কথা। এ ধরনের কথা বলেই মূলত ওরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। এমএলএম-এ পণ্যের ভোক্তার উপকৃত হওয়ার কথা নিতান্তই অবান্তর। কারণ আগেই বলেছি যে, মানসিক রোগী ছাড়া শুধু পণ্য কেনার
জন্য এমএলএম কোম্পানিতে কেউ যায় না; বরং এখানে অন্যকে কোম্পানিতে ভিড়িয়ে কমিশন অর্জনই থাকে মূল উদ্দেশ্য। আর তা করতে গিয়ে বাধ্য হয়েই তাকে পণ্য বা সেবা খরিদ করতে হয়।

একটি উদাহরণ:

ক্রেতাদেরকে লাভবান করাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে শুরুতেই পণ্যের মূল্য ঐ পরিমাণ কমিয়ে দিন যে পরিমাণ টাকা
আপনি কমিশন দিয়ে থাকেন এবং সরাসরি ক্রেতাকে হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করুন। যেমন- কোনো পণ্য যদি আপনার বাজার দাম অনুযায়ী দশ হাজারে বেচতে চান এবং ১০,০০০/-টাকায় যদি আপনাদের দাবি অনুযায়ী আপনার ৪,৫০০/- টাকা লাভ থাকে এবং তা থেকে পরিবেশককে ৪,০০০/- টাকা দিয়ে থাকেন তাহলে আপনি পণ্যটি সরাসরি ৬,০০০/- বা ৬,৫০০/- মূল্যে বাজারে ছাড়ুন। দেখবেন কোনো বিজ্ঞাপন দরকার হবে না। পরিবেশকও লাগবে না। খুচরা বিক্রেতারা দলে দলে এসে আপনার কাছে ভিড় করবে। কারণ আপনাদের ভাষ্যমতে আপনাদের পণ্যের মূল্য বাজারদরের সমান বা কম।
একথা বললেই দেখবেন, ভদ্রলোকেরা একেবারেই চুপসে যান।

আর তাদের বিজ্ঞাপন না দেওয়ার দাবি কতটুকু সত্য তা একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই জানতে পারবেন। মাঝেমাঝেই পত্রিকাগুলোতে পৃষ্ঠাব্যাপী বা ২/৩ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র দেখতে পাবেন। সেখানে নিজের গুণাগুণ বর্ণনা এবং বিভিন্ন বাণী
প্রকাশে তারা অগ্রবর্তী থাকেন। এই কয় দিন আগেও এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে একটি নাম করা দৈনিকে। সেখানে একটি এমএলএম কোম্পানির প্রধান কর্তৃক বক্তৃতা দেওয়ার বিভিন্ন ছবি ছাপা হয়েছে। সাথে দুইজন মন্ত্রীর ছবি
এবং ভিন্ন লাইনে চলচ্চিত্র ও গানের জগতের দুই ব্যক্তি কর্তৃক তাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ছবি। চিন্তা করুন,
যারা বিজ্ঞাপনই দেয় না তারা পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন ছাপল বটে, কিন্তু ঐ ব্যক্তিদেরকে তাদের অনুষ্ঠানে নেওয়া এবং তাদের
ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করার মতলব কী হতে পারে। স্পষ্ট করে বলছি কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠির সাথে আমাদের কোনো
বৈরিতা নেই। শুধু শরীয়তের দায়বদ্ধতার কারণে মুসলমানদেরকে হালাল-হারাম বিষয়ের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্যই আমাদেরকে এসব বিষয়ে কথা বলতে হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগ্রহে আমাদেরকে হালাল পথে চলার তাওফীক দিন।