এমএলএম-এর সাথে উপরোক্ত দুটি ফাসেদ বিষয়ের সম্পৃক্ততা:
ফিকহের কিতাবে আছে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি যতটুকু কাজ করবে সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। সহীহ মতানুযায়ী
এটি ‘আলআজীরুল মুশতারাক’ বা কমিশন এজেন্টদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন,
শরহুল মাজাল্লাহ, আল্লামা খালেদ আতাসী রাহ. ২/৪৮৪
উল্লেখ্য, কেউ কেউ ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে ‘আলআজীরুল মুশতারাক’ গণ্য করে বলে থাকে, কোম্পানির নির্ধারিত টার্গেট
(কমপক্ষে ১০০০ পয়েন্টের পণ্য বিক্রয় করা) পুরা না করলে কমিশন পাবে না। একথাটা সহীহ নয়। কেননা, আজীরে মুশতারাক যতটুকু কাজ করবে ততটুকুর পারিশ্রমিক হিসাব করে তাকে দিতে হবে। সুতরাং পয়েন্ট ১০০০ এর কম
হলেও কাজ যেহেতু আংশিক হলেও আছে তাই সে অনুপাতে তাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে। অন্যথায় তা ‘আলআমালু
বিলা উজরা’ তথা পারিশ্রমিকবিহীন কর্মের আওতাভুক্ত হয়ে নাজায়েয হবে। অথচ এমএলএম কোম্পানিতে অনেক
ক্ষেত্রে এমনটিই হয়ে থাকে। আর কর্মবিহীন পারিশ্রমিক হল, নেট সিস্টেমে প্রথম ২ ব্যক্তি ছাড়া পরবর্তী লোকদেরকে কোম্পানির সাথে জড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করে তাদের সরাসরি উপরের ব্যক্তিটি, যার রেফারেন্সে তারা সদস্য হয়েছে।
এটি কোনো ক্রমেই প্রথম ব্যক্তির কাজ হিসেবে ধর্তব্য হয় না। প্রথম ব্যক্তি এক্ষেত্রেও শ্রম দিলেও কোম্পানির হিসেবে
তার নিজের কাজ হিসেবে গণ্য হয় না। কোম্পানি একে প্রথম ব্যক্তির কাজ হিসেবে ধরে না। এর প্রমাণ হল, যদি এটি
প্রথম ব্যক্তির কাজ হত তাহলে সে প্রথম ২জনকে সংগ্রহ করে কোম্পানি থেকে যে হারে কমিশন লাভ করেছে ২য়,
৩য় স্তর থেকেও ঐ হারে কমিশন পেত। অথচ তা পায় না। বরং তাদের সরাসরি উপরের ব্যক্তিটি সে হারে পেয়ে থাকে।
অতএব ডাউন লেভেল তথা নিম্নস্তরের লোকদের জন্য আপ লেভেলের ব্যক্তিদের কমিশন গ্রহণটা বিনা কর্মে অর্থ গ্রহণ
হিসাবে গণ্য। এ সম্পর্কে ‘আলআকলু বিলবাতিল’-এর আলোচনায় কথা হয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকে, একজন যখন আরেকজনকে নামায শিখায়। এরপর সে আরেকজনকে শিখায়। তো এক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তি পরবর্তীদের আমলের কারণে ছওয়াব পেতে থাকে। তদ্রূপ ডাউন লেভেলের আমলের কারণে আপ লেভেল কমিশন পেয়ে থাকে।
এটা এমএলএম ওয়ালাদের পুরাতন কথা:
টংচেং-এর বিরুদ্ধে যখন মাসআলা দেওয়া হয়েছিল তখন তারা একথা বলা শুরু করে। এর জবাব হল দুনিয়ার ‘উকূদে
মুআওযা’ আর আখিরাতের সদকায়ে জারিয়া এক কথা নয়। সদকায়ে জারিয়া আল্লাহ তাআলা ও বান্দার সাথে সম্পৃক্ত।
তিনি বান্দাকে শুধু বিনিময় দেন না; অতিরিক্তও দেন। একটি কাজের জন্য ন্যূনতম ১০ গুণ বিনিময় দেন। এরপর তা বৃদ্ধি করতে করতে কাউকে কাউকে বে হিসাব দিয়ে দেন। কিন্তু আকদে মুআওয়াওয়াযা যেমন ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারা ইত্যাদির
মধ্যে অতিরিক্ত বলতে কিছু নেই। এখানে ‘এওয়াজ’ বা বিনিময় আসে পণ্য বা সেবার মোকাবেলায়। পণ্য বা সেবার সাথেই
এটি সম্পৃক্ত হয়। পণ্য বা সেবার সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে অতিরিক্ত কিছু হলে সেটি বাইয়ে ফাসিদ বা ইজারায়ে ফাসিদার
মধ্যে পড়বে। অতএব একজনের কাজের বিনিময়ে বহুজন পারিশ্রমিক পাওয়ার বৈধতা নেই।
৩. মুফতী বোর্ড ঢাকার ফতোয়ায় আরেকটি বিষয় ছিল: ‘আলগারার’। ইমাম সারাখসী রাহ.-এর বরাতে এর আরেকটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তা হল যার এমন একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে, যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু এর মধ্যে এমন অদৃশ্য
কারণ রয়েছে, যে কারণে তা অস্পষ্ট। অতএব এর বাইরের রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে। আর এর ভিতরের রূপ অজানা। (জামেউল উসূল ১/৫২৭)
এ সংজ্ঞাটি খুব সুন্দর। ফতোয়াটি তৈরির সময় সকলেই একে পছন্দ করেছিলেন। কেননা এটি এমএলএম এর সাথে
ভালোভাবে খাপ খায়। এমএলএম-এর প্রকাশ্যরূপ ঠিকই ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে দেয় আর এর ভিতরের দিকটা অজানা।
অর্থা কয়জনকে ক্রেতা বানাতে পারবে, আদৌ বানাতে পারবে কি না কিছুই জানা নেই। মোদ্দাকথা, এমএলএম-এর একজন পরিবেশক ভবিষ্যতে কী কী পাবে বা আদৌ পাবে কি না তা সম্পূর্ণ অজানা ও অনিশ্চিত, যা আলগারার-এর সমার্থক।
কেউ কেউ দাবি করে থাকে যে, এখানে আলগারার থাকলেও তা পরিমাণে কম, যা নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু এমএলএম চেনেন এমন ব্যক্তিমাত্রই ববুঝবেন যে, এক্ষেত্রে যদি গারার কম হয় তবে আলগারার কাসীর বা বড় গারার পাওয়া হয়ত মুশকিলই হবে।
৪. মুফতী বোর্ড ঢাকা তো এমএলএম-এ শুবহাতুর রিবা এর কথা বলেছে:
তথা রিবার সন্দেহ-এর কথা বলেছে। কিন্তু ভারতের ফিকহ একাডেমীর সেমিনারে কেউ কেউ একে সরাসরি রিবাও বলেছেন। তারা বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে যে, ক্রেতা টাকা দিয়েছে তো পণ্য পেয়েই গেছে। এখন ভবিষ্যতে যে কমিশন
পাবে তা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। কেউ কেউ কিমার তথা জুয়াও বলেছেন। তা এভাবে যে, সে যে টাকা খাটিয়েছে এর এক
অংশ লেগেছে পণ্যের কাজে। আরেক অংশ ভবিষ্যতে কমিশন পাওয়ার জন্য, যা অনিশ্চিত। সুতরাং তা কিমারের মধ্যেও দাখেল হয়ে যায়। তবে আমরা একে সরাসরি রিবা বা কিমার না বললেও এতে যে রিবা বা কিমারের সন্দেহ তথা গন্ধ রয়েছে
তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এমএলএম-এর সপক্ষে ইদানীং কোনো কোনো মাওলানা সাহেবও বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ
কেউ বইও লিখে ফেলেছেন। তারা আজব আজব দলিলও পেশ করেছেন। কিন্তু সব কথার বা সব ধরনের লোকের কথার
জবাব দেওয়া জরুরি নয়। কেননা, সবার কথার জবাব দিলে যে ফিকহ বুঝে না সে মনে করবে, আমার কথারও জবাব
দেওয়া হয়। মনে হয় আমিও ফকীহ হয়ে গেছি। এরপরও মানুষ যেন বিভ্রান্তিতে না পড়ে সেজন্য কোনো কোনো কথার
জবাব দেওয়া হল।
এমএলএম সম্পর্কে এক ব্যক্তি বই লিখেছেন:
* একজন তার বইয়ে লিখেছেন, মুফতী বোর্ডের ফাতাওয়ায় আলইজারা ও আলবাইয়ের মাঝে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। আলগারার-এর সম্পর্ক বাইয়ের সঙ্গে, ইজারার সাথে নয়। এ নীতি বাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইজারার ক্ষেত্রে নয়। ইজারা ও
বাই এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন দুটি জিনিস। ঐ ভদ্রলোকের জানা থাকার কথা যে,ফতোয়াটি একক কোনো মুফতীর নয়; বরং
একটি বোর্ডের ফতোয়া। সারাদেশের নির্ভরযোগ্য বহু মুফতী এর সমর্থন করেছেন। এক্ষেত্রে ‘তারা গুলিয়ে ফেলেছেন’
এ ধরনের কথা বলার অর্থ হল, মুফতীদের একটি বিশাল গোষ্ঠিকে জাহেল বা মূর্খ আখ্যা দেওয়া।
তার এই দাবিটিও ভুল। মূলত বাই ও ইজারা দুটোই বিক্রি। একটি হল পণ্য বিক্রি, আরেকটি হচ্ছে সেবা বিক্রি। এজন্য
ইজারার সংজ্ঞা কেউ কেউ এভাবে দিয়েছেন- ‘ইজারা হচ্ছে নির্ধারিত বিনিময়ে নির্ধারিত সেবা বিক্রয় করার নাম।
আলমুহীতুল বুরহানীতে সুস্পষ্টভাবে ইজারাকে বাই বলা হয়েছে। (আরো দেখুন : আলআওসাত ১১/১৩১; আলমুগনী
৮/২২; আলফুরূক ৪/৩৪)
ফিকহের কিতাব খোঁজ করলে দেখবেন, ফাসেদ শর্তাবলি, আলগারার, অজানা থাকার দোষ শুধু বাই এর ক্ষেত্রে সমস্যা
নয়; ইজারার ক্ষেত্রেও সমস্যা। ফাতহুল কাদীরে (৬/৮১) কাযীখানের হাওয়ালায় বলা হয়েছে। আলগারার যে ইজারার
ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তার জন্য আরো পড়তে পারেন : আলগারার ওয়া আছারূহু ফিল উকূদ ৪৬৫; ফিকহুল মুআমালাতিল মালিয়াহ ১৩৯
* কেউ কেউ আলউজরাতু বিলা আমল তথা বিনা কর্মে পারিশ্রমিক বৈধ বানানোর জন্য ক্রিকেট টিমের পুরস্কারের প্রসঙ্গ
টেনে এনেছেন। অর্থাৎ যারা ক্রিকেট খেলে তারা নির্ধারিত একটা বেতন পায়। এরপর টিমের জয় হলে কখনো অতিরিক্ত পুরস্কার পায়। তাদের এই অতিরিক্ত পুরস্কার বৈধ হলে এমএলএম-এর অতিরিক্ত কমিশন বৈধ হবে না কেন?
এর জবাব কী দিব! খোদ পেশাদার ক্রিকেট খেলার প্রচলিত পদ্ধতিকে কে জায়েয বলেছে তাই তো আগে দেখা প্রয়োজন।
এ ধরনের ফালতু কথা বলার মতলবটা হল, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন। এদেশের অনেক মানুষ বুঝে বা না বুঝে খেলার ভক্ত। সুতরাং এ প্রসঙ্গে ক্রিকেটের কথা নিয়ে আসলে তা সহজেই মার্কেট পেয়ে যাবে। এ ধরনের সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চিন্তা থেকেই হয়ত এমএলএম-এর মাসআলায় খেলার প্রসঙ্গ নিয়ে আসা হয়েছে।
এমএলএম ওয়ালাদের শরীয়া কাউন্সিলও আছে:
তাদের শরীয়া কাউন্সিলররা এর বৈধতার পক্ষে বইও লিখেছেন এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ‘দলিল-প্রমাণ’ পেশ করার চেষ্টা
করেছেন। তাদের একটি দলিল শুনুন। প্রযোজ্য তার জন্য ‘এমএলএম বৈধ। কারণ এটি একটি বেচাকেনা। আর কুরআন মজীদে আছে- আল্লাহ কেনাবেচাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ ভেবে দেখুন, কেউ যদি বলে
কুরআনে পানাহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা কি যে কোনো দ্রব্য ও পানীয় পানাহারের বৈধতা প্রমাণিত হয়? নিশ্চয়ই তারাও বলবে, হয় না। তারাও বলবে, শরীয়তে নিষিদ্ধ বস্ত্ত ছাড়া অন্যগুলো পানাহার করা যাবে। এক্ষেত্রেও
একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ নয় এমন বেচা-কেনা হালাল।
আসলে আলবাই-এর ‘আলিফ-লাম’ হল عهد এর জন্য। অর্থাৎ সব বাই উদ্দেশ্য নয়; বরং শরীয়ত যেটাকে বৈধ বাই বলে
মনে করে এখানে সেটাই উদ্দেশ্য। অন্যগুলো নয়। এরকম দলিল আরবের মুশরিকরাও দিয়েছিল। তারা বলেছিল-বেচা
কেনা আর সুদ তো একই ধরনের কারবার। কুরআন তা খন্ডন করেছে।
* আরেকটি দলিল হল মুদারাবা। অর্থাৎ এমএলএম ওয়ালারা বলতে চায়, ক্রেতা পরিবেশক থেকে যে টাকা নেওয়া হয়
তা মুদারাবা হিসেবে নেওয়া হয়। এরপর যে কমিশন দেওয়া হয় সেটি এরই লভ্যাংশ। আজকাল অনেকেই শুনে শুনে
ফিকহের দু তিনটি পরিভাষা মুখস্থ করে যেখানে ইচ্ছা লাগিয়ে দেয়। সেটি বাস্তবতার সাথে মিলুক বা না মিলুক। এধরনেরই একটি শব্দ হল, মুদারাবা।
বাস্তবে এমএলএম এর সাথে মুদারাবার ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। মুদারাবা হল, এক পক্ষের মূলধন আর অপর পক্ষের শ্রম
বা ব্যবসা। এরপর পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ বণ্টন হবে। এটি শরীয়তের সবচেয়ে স্পর্শকাতর কারবার হিসেবে চিহ্নিত।
এতে হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করতে হয়। কোন খরচটা সরাসরি ব্যবসার জন্য হয়, আর কোনটা সরাসরি ব্যবসার জন্য নয়
এসব হিসাব ভিন্ন ভিন্নভাবে করতে হয়। এবং মুলধন থাকে ব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসার জন্য আমানতস্বরূপ। সরাসরি ব্যবসার ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো খাতে তা ব্যবহার করা যায় না। মূলধনের যথাযথ হেফাযত করতে হয়। তাই এই কারবারে দাখেল হওয়ার আগে চিন্তা করা উচিত আমি তা পারব কি না। মূলধনের হেফাযত করতে পারব কি না।