উস্কানি বা ধর্মীয় উস্কানি কাকে বলে?
ইয়াসিন রুবেল নামক এক ব্যক্তি তার ফেসবুক প্রোফাইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের চলমান দুর্গাপূজা নিয়ে লিখে “ইসলামে মূর্তি পূজা এক ভয়ংকর অপরাধ। অতএব কোন
মুসলমান পূজাকে উইশ করতে পারে না। পূজায় শুভেচ্ছা জানানো হারাম স্পষ্ট কুফুরি।”
এ কারণে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগে মামলা খেয়ে জেলেও যেতে হয়েছে। চলুন এবার পর্যালোচনা করে দেখি উস্কানি কাকে বলে?
কোনো অপরাধে প্ররোচিত করাকে আইনের ভাষায় উস্কানি বলে৷ আর এই উস্কানি নানাভাবে দেয়া সম্ভব৷ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানি দেয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের সমালোচনা করা,
উস্কানি কিনা? দণ্ডবিধির ১০৭ ধারায় প্ররোচনার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,
‘‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে অপরাধ সংঘটনের জন্য সহায়তা করে,
পরামর্শ দেয় বা উস্কানি দেয় কিংবা ষড়যন্ত্র করে বা কার্যবিরতির দ্বারা অপরাধ সংঘটনের পথ সুগাম করে দেয় তবে তাকে প্ররোচনা বলে৷” এই সংজ্ঞায় স্পষ্ট যে, কোনো অপরাধে প্ররোচনা দেয়া যায় উস্কানির মাধ্যমে৷ আর এর শাস্তি মূল অপরাধের সমান৷ অপরাধটি সংঘটিত না হলেও উস্কানির অপরাধে সাত বছরের শাস্তির বিধান আছে৷
আর দণ্ডবিধির ৫০৫ এবং ৫০৫ (ক) ধারায় উস্কানির মাধ্যম বলা আছে৷ তাতে বলা
হয়েছে প্ররোচনা হতে পারে মৌখিক এবং লিখিত উভয় প্রকার৷ অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়ও উস্কানির বিষয়টি রয়েছে৷ এই আইনে ইলেক্ট্রনিক বিন্যাস ব্যবহার
করে উস্কানি দেয়ার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে গণ্য৷ আর এটি কোনো ব্যক্তি, সমাজ,
সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র বা ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে হতে পারে৷
বাংলাদেশের সংবিধানে উস্কানি র বিষয়ে কি আছে?
বাংলাদেশের সংবিধানেও উস্কানির বিষয়টি রয়েছে৷ সংবিধানের প্রথম ভাগে
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এবং তাতে উস্কানির অভিযোগ সমান অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷ বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় উস্কানি এবং অপরাধের উস্কানি বহুল
পরিচিত৷ ধর্মীয় উস্কানি স্বাধীন বাংলাদেশেতো বটেই, পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ ভারতেও লক্ষ্য করা গেছে৷ আর এই উস্কানি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ছাড়াও কখনো কখনো সরকার বা
রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকেও দেয়ার অভিযোগ আছে৷ এমনকি কখনো কখনো
সংবাদমাধ্যমও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ আছে৷
তথ্যভিত্তিক কিছু বলা উস্কানি নয়
আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘দণ্ডবিধির ৫০৫(ক) ধারায় বলা
হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিতভাবে এমন কিছু প্রকাশ বা বিতরণ করে,
যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক, সেবা প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য ক্ষতিকর হয় বা হতে পারে- এগুলোকে
প্ররোচনামূলক বিষয় বলা হয়৷ আইনে বলা আছে, এই ধরণের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ
সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে৷” তিনি আরো বলেন, ‘‘একই ধরনের অপরাধ
অনলাইনে করলে সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা এবং শাস্তির বিধান আছে৷ আর সংবিধানেও জনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার রক্ষায় প্ররোচনাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে৷” কিন্তু উস্কানি বিষয়টি কী এবং এর পরিধি কী কী তা
কোনো আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই৷ তাই এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠছে
বারবার৷ তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘এই আইনগুলোর সুবিধা নেয় সরকার ও সরকারের লোকজন৷ সাধারণ মানুষ এর কোনো সুবিধা পায়না৷ তারা তেমন আইন সম্পর্কে জানেওনা৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা, সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা বা এইসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা উস্কানিমূলক কাজ
হিসেবে বিবেচনা করা যায়না৷ কারণ এটা নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার৷
সরকারের কোনো অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে প্রচারণা চালানো, জনমত গড়ে তোলা
এবং নাগরিকদের প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করাও উস্কানি নয়৷ তবে এধরণের কাজ সঠিক তথ্যভিত্তিক হতে হবে, গুজব বা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে করা হলে তা উস্কানি হবে৷”
দন্ডবিধিতে উস্কানি ‘র সংজ্ঞায় কি আছে?
দন্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উপাসনালয় ভাঙচুরের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও কী কী
কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে তা বলা নেই।
ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ধর্মীয়
অনুভূতির কোনও সংজ্ঞা এখনও দেশের প্রচলিত আইনে অস্পষ্ট। ২৯৫ ধারায়
জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ২৯৫ এর ‘ক’ ধরার অপরাধ অজামিনযোগ্য। ‘সাম্প্রতিক সময়ে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ‘হয়রানির হাতিয়ার’
হিসেবে।’ ‘দণ্ডবিধির ২৯৫ এর ‘ক’ ধারা মতে, কোনও শ্রেণির ধর্মীয় বিশ্বাসকে
অবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে
দণ্ডিত হবেন। ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ‘ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নিতে
পারবেন। আর এ ধারার অপরাধ জামিন-অযোগ্য।’ দন্ডবিধির ৫০৫ ধারায় স্পষ্ট বলা
হয়েছে যে, কোনো বক্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন, গুঞ্জন যদি সত্য হয় বা সত্য হিসেবে
বিশ্বাস করার কারণ থাকে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেনা৷ তাই তথ্যভিত্তিক
এবং বিশ্বাসযোগ্য কোনো কিছু বলা বা প্রকাশ উস্কানি নয়৷
একথা পরিস্কার হল যে, ইয়াসিন রুবেল শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের একটি বিধান বর্ণনা
করেছে তার লেখা উস্কানির সংজ্ঞায় পড়েনা বরং তার উপর মামলা ও তাকে গ্রেফতার
করা ধর্মীয় উস্কানির অন্তর্ভুক্ত ।