হারাম দ্রব্যের ব্যবসা ও হারাম:
আল্লাহ তা‘আলা মদ, মৃত প্রাণী, রক্ত, প্রতিমা এবং শূকরের গোশত প্রভৃতি হারাম
করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের প্রতি মৃতপ্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত হারাম করা
হয়েছে’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া,
প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বিরত থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০)।
আল্লাহ তা‘আলা যেসব দ্রব্য হারাম করেছেন, সেসব দ্রব্যের ব্যবসা ও হারাম করেছেন। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মক্কা বিজয়ের
বছর এবং মক্কা থাকাবস্থায় বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মদ, মৃত দেহ, শূকর ও প্রতিমা বেচা-কেনাকে হারাম করেছেন। তখন বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি মনে করেন যে,
লোকেরা মৃত পশুর চর্বি দ্বারা নৌকায় প্রলেপ দেয়, তা দিয়ে চামড়ায় বার্ণিশ করে এবং লোকেরা তা চকচকে করার কাজে ব্যবহার করে? তখন তিনি বললেন, না, তা হারাম। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, কারণ
মহান আল্লাহ তাদের জন্য চর্বি হারাম করেছেন অথচ তারা একে গলিয়ে নেয় এবং তা
বিক্রি করে ও তার মূল্য ভক্ষণ করে’। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ
লানত বর্ষণ করেন মদের উপর এবং যে তা পান করে, যে তা পরিবেশন করে, যে তা
বিক্রি করে, যে তা ক্রয় করে, যে তার নির্যাস তৈরী করে, যার জন্য নির্যাস তৈরী করা
হয়, যে তা বহন করে আর যার কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় সবার উপর’।
বায়‘উল ঈনা তথা পাতানো ব্যবসা (ক্রয়-বিক্রয়) নিষিদ্ধ :
ইসলামী শরী‘আত বায়‘উল ঈনা তথা পাতানো ব্যবসা (ক্রয়-বিক্রয়কে) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বায়‘উল ঈনার প্রকৃতি সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
‘বায়‘উল ঈনা হচ্ছে কারো নিকট কোন বস্ত্ত নির্দিষ্ট দামে (যেমন ১২০ দীনারে)
নির্দিষ্ট মেয়াদের (যেমন ১ বছরের) জন্য বিক্রি করা এবং বস্ত্তটি ক্রেতাকে বুঝিয়ে
দেয়া। অতঃপর বস্ত্তটির মূল্য (যেমন ১২০ দীনার) বুঝে পাওয়ার পূর্বে তা উক্ত
ক্রেতার নিকট হ’তে তার চেয়ে কমমূল্যে (যেমন ১০০ দিনারে) ক্রয় করে নিয়ে নগদ
মূল্য পরিশোধ করে দেয়া। ফলাফল হচ্ছে, ক্রেতাকে দিল ১০০ দীনার আর মেয়াদান্তে
তার থেকে গ্রহণ করল ১২০ দীনার’। মোল্লা আলী ক্বারী বলেন,‘বায়‘উল ঈনা হচ্ছে কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট দামে নির্ধারিত সময়ের জন্য কোন পণ্য বিক্রি করল। অতঃপর
বিক্রয় মূল্যের চেয়ে কম দামে তা পুনরায় ক্রয় করল’।
বায়‘উল ঈনা আসলে এক ধরনের পাতানো ব্যবসা (ক্রয়-বিক্রয়)। এরূপ লেন-দেনকারীদের
বাস্তবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কোন উদ্দেশ্য থাকে না এবং যে পণ্যটি তারা ক্রয়-বিক্রয়ের
কথা বলে তা ক্রয় করার যেমন কোন প্রয়োজন ক্রেতার থাকে না, তেমনি বিক্রেতারও
তা বিক্রি করার কোন প্রয়োজন থাকে না। ক্রয়-বিক্রয় পাতানো হওয়ার কারণে বিক্রিত বস্ত্তটি পূর্বে যার ছিল তার কাছেই থেকে যায়। ক্রেতা পণ্যের ভোগ-ব্যবহারও করে
না এবং তা অন্যত্র বিক্রি করে ব্যবসাও করে না। এটা সম্পূর্ণ রূপে একটা পাতানো ক্রয়-বিক্রয়। এটা সরাসরি সূদ না খেয়ে ঘুরিয়ে সূদ খাওয়ার নামান্তর।
আধুনিককালের শেয়ার ব্যবসাও এ পর্যায়ে পড়ে। কেননা এতে দ্রব্যের উপস্থিতি ছাড়া দ্রব্যের বেচা-কেনা হয়। ক্রেতার অনেক সময় সম্যক জ্ঞান থাকে না যে, কি বস্ত্তর
শেয়ার তিনি ক্রয় করেছেন। যে বস্ত্তর শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তা দেখা ও জানার
কোন সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন ক্রয়-বিক্রয়কে ধোঁকা বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বায়‘উল ঈনার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন,
‘মানুষ যখন দীনার ও দিরহাম আঁকড়ে ধরে রাখবে, ‘ঈনা’ তথা পাতানো ক্রয়-বিক্রয়
করবে, গরুর লেজ ধরে রাখবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ছেড়ে দিবে তখন
আল্লাহ তাদের উপর বালা-মুছীবত নাযিল করবেন। এ বালা-মুছীবত তাদের হতে দূর করবেন না, যতক্ষণ না তারা দ্বীনের দিকে ফিরে আসবে’।
পরিমাপে কম-বেশী করা নিষিদ্ধ :
পণ্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতাকে পরিমাপে কম দেয়া কিংবা মেপে নেয়ার
সময় বেশী নেয়াকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কুরআন-হাদীছে এহেন কর্মকে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময়
পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন লোকদের মেপে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে
না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহা দিবসে। যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১-৬)। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি আকাশকে করেছেন
সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদন্ড (দাঁড়িপাল্লা)। যাতে তোমরা সীমালংঘন না কর তুলাদন্ডে। তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিও না’ (রহমান ৫৫/৭-৯)। অন্যত্র তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে।
আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না’ (আন‘আম ৫/১৫২)।
তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা মেপে দেয়ার সময় মাপ পূর্ণ করে দাও এবং সঠিক
দাঁড়িপাল্লায় ওযন কর। এটাই উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে শুভ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
‘পাঁচটি বস্ত্ত পাঁচটি বস্ত্তর কারণে হয়ে থাকে- (১) কোন কওম চুক্তিভঙ্গ করলে
আল্লাহ তাদের উপর তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন। (২) কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বাইরে ফায়ছালা দিলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। (৩) কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীল কাজ বিস্তৃত হলে তাদের মধ্যে মৃত্যু অর্থাৎ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে।
(৪) কেউ মাপে বা ওযনে কম দিলে তাদের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া
হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। (৫) কেউ যাকাত দেয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি
বন্ধ করে দেয়া হয়’।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) যখন বাজারে যেতেন, তখন বিক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, ‘আল্লাহকে ভয় কর। মাপ ও ওযন ন্যায্যভাবে কর। কেননা মাপে কম দানকারীরা ক্বিয়ামতের দিন দন্ডায়মান থাকবে এমন অবস্থায় যে, ঘামে তাদের কানের অর্ধেক
পর্যন্ত ডুবে যাবে’।
[চলবে]