ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা-২

ইসলামী ব্যাংকিং সংখ্যার বিচারে তার যৌবন কাল অতিক্রম করছে। দেশী-বিদেশী
মিলে অনেক ব্যাংকের সকল শাখাই ইসলামী। আর সনাতনী ধারার ব্যাংকগুলোর
মধ্যে অনেকেরই রয়েছে এক বা একাধিক  ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা ইউনিট।
এভাবে বাংলাদেশে কয়েক শত ইসলামী ব্যাংকিং ব্রাঞ্চ রয়েছে, যার সংখ্যা নিয়মিতভাবে বাড়ছে। বর্তমানে শুধু বেসরকারী ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকিং করছে এবং
বেসরকারী ব্যাংকসমূহের গড় মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশ তাদের দখলে।
একাউন্ট হোল্ডার (আমানতকারী), বিনিয়োগকারী, বিনিয়োগগ্রহীতা ও ভোক্তা এবং আমানতকৃত টাকার অংক সকল ক্ষেত্রেই ইসলামী ব্যাংকগুলোর এখন জয়জয়কার।
তাই সনাতনী সূদী পদ্ধতির অনেক ব্যাংকই এখন পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রবেশের পথে রয়েছে। এর কারণ সুস্পষ্ট। তা হচ্ছে, এদেশের সাধারণ
মুসলিম জনগণ তাদের প্রিয় ধর্মের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বিশ্বাস, যা তাদেরকে
ইসলাম নামের প্রতি দারুণভাবে আকর্ষিত  করে।
মুযারাবা-মুশাকারা
হযরত যথার্থই বলেছেন, ইসলামের মৌলিক বিনিয়োগ পদ্ধতি হচ্ছে মুযারাবা ও
মুশারাকা। কারণ এ দু’টিই এমন যুগান্তকারী পদ্ধতি যেগুলোর মাধ্যমে ইনসাফভিত্তিক সামজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। ইসলামী অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও
স্বাতন্ত্র এবং কল্যাণমুখিতার প্রমাণ একমাত্র মুযারাবা-মুশারাকার মাধ্যমেই করা সম্ভব।

ইসলামী ব্যাংকিং এ মুযারাবা কী?

মুযারাবা হচ্ছে এমন একটি কারবার যেখানে ২টি পক্ষ থাকবে। ১টি মূলধন সরবরাহকারী, অন্যটি ব্যবসায়ী। একটি চুক্তির মাধ্যমে কারবারটি সংগঠিত হবে, যাতে ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফায় কে কতভাগ লাভ পাবে তা সুনির্ধারিত থাকবে। লাভের কোনো নির্দিষ্ট অংক কারো জন্য নির্ধারণ করা যাবে না; বরং সম্ভাব্য মুনাফার শতকরা হার নির্ধারিত থাকবে। যেমন মুলধন দাতা ৫০%, ব্যবসায়ী ৫০% অথবা এক পক্ষ ৬০% অন্য পক্ষ
৪০%। এভাবে উভয়ের সম্মতিতে যেকোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
লাভের পরিমাণ কমবেশি যাই হোক তা উভয়ের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত শতকরা হারে
বন্টিত হবে। আর যদি লোকসান  হয় তবে অর্থদাতার টাকা যাবে আর ব্যবসায়ীর শ্রম
বৃথা যাবে।
প্রচলিত সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার সাথে মুযারাবার কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যাক :
১. সুদী ব্যবস্থায় অর্থদাতার মুনাফার অংশটি সুনির্ধারিত থাকে। যেমন-বিনিয়োগকৃত
টাকার ১৫%। ব্যবসায় যে পরিমাণ লাভই হোক না কেন সে ঐ অংকের সুদ পাবেই। পক্ষান্তরে মুযারাবা কারবারে এভাবে মুনাফা ফিক্সড করার কোনো সুযোগ নেই।
ব্যবসায় লাভ বেশি হলে উভয়েই তা পূর্ব নির্ধারিত হার অনুযায়ী ভাগ করে নিবে।
ব্যবসায়ী এক তা ভোগ করতে পারবে না। আবার লাভ কম হলে বিনিয়োগকারী
ব্যবসায়ীর নিকট তার নির্ধারিত হারের বেশি দাবি করতে পারবে না।
২. ব্যবসা যদি লসের সম্মুখীন হয় তবে তা মুযারাবা কারবারে বিনিয়োগকারীকে বহন
করতে হবে। অর্থাৎ যে পরিমাণ মূলধন খোয়া যাবে বিনিয়োগকারী তা ব্যবসায়ী থেকে
দাবি করতে পারবে না। কিন্তু সুদী ব্যবস্থায় ব্যবসায় ক্ষতি হলেও অর্থদাতা শুধু তার
মূলধনই নিবে না; বরং এর উপর নির্ধারিত সুদও আদায় করবে। ব্যবসায়ীর বন্ধকী
সম্পত্তি বিক্রয় করে অথবা অন্য যেকোনো পন্থায় এ টাকা সে আদায় করে নিবেই।
৩. পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যবসায়ী যত বেশি পরিমাণ লাভই করুক অর্থদাতা শুধুমাত্র
নির্ধারিত হারের সুদই পাবে। অতিরিক্ত লাভ ভোগ করবে ব্যবসায়ী একাই। কিন্তু
মুযারাবা ব্যবস্থায় লাভ যত বেশি হবে অর্থদাতার মুনাফায় অংশদারিত্ব ততই বাড়বে।

বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা:

বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোর টাকার মূল উৎস হচ্ছে আমানতকারী তথা একাউন্ট হোল্ডারদের জমাকৃত টাকা। বলাবাহুল্য যে, এদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র এবং
কম ও বেশি জমাকারী সব ধরনের লোকই রয়েছে। তবে অধিকাংশরাই যে তুলনামূলক
কম আয়ের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের কর্তৃক ব্যাংকে জমাকৃত টাকা দ্বারা
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ তাদের ব্যবসা গড়ে তোলে এবং এক সময় প্রচুর মুনাফার
মালিক হয় অথচ ব্যাংককে প্রদান করে সেই নির্ধারিত ১৪-১৫%। বাকি পুরোটাই ভোগ
করে তারা একা। মূলত যে ১৫% সুদ প্রদান করে তাও কস্টিং চার্জের আওতায় এনে এর উপর মুনাফা হিসাব করে তা ভোক্তাদের থেকে আদায় করে নেয়। অর্থাৎ লাভের পুরোটিই থাকে তাদের কাছে। এভাবে সম্পদ হয়ে উঠে এককেন্দ্রিক, ধনী ও দরিদ্রের তারতম্য
বাড়তে থাকে দিন দিন। কিন্তু মুযারাবা ব্যবস্থায় যেহেতু প্রকৃত মুনাফাই কেবল বন্টনযোগ্য তাই ব্যবসার হিসাবের পূর্বে অর্থদাতার লভ্যাংশকে কস্টিং চার্জের অন্তর্ভুক্ত করার
সুযোগ নেই এবং বেশি মুনাফা হলে কোনো পক্ষেরই এককভাবে তা কুক্ষিগত করার
সুযোগ নেই।
উপরের বর্ণিত মুযারাবা পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তের এমন একটি আদর্শ বিনিয়োগ ব্যবস্থা,
যা শরীয়তের স্বাতন্ত্র, সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়ের রক্ষাকবচ। কিন্তু প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতি পালনে আগ্রহী নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে মানুষের আমানত-দিয়ানতের অবস্থা অত্যন্ত নিম্নমুখি। তাদেরকে যদি বলা হয় যে, আমরা
লোকসান বহন করব, তবে সে ব্যবসায় লোকসান বৈ লাভ কখনো হবে না। আর সে
ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পাতানো লোকসানের বোঝা বহন করতে করতেই ব্যাংকগুলোর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে।
এই যুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে এবং বর্তমান যুগে মুযারাবার কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক কিছুই বলার আছে। তবে যেহেতু ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুযারাবা
করছেই না তাই এই বিষয়টি আজ থাক। সুযোগ হলে অন্য কোনো দিন তা আলোচনা
করা যাবে।

মুরাবাহা কি?

মুরাবাহ হচ্ছে ইসলামী ফিকহের ক্রয়-বিক্রয়ের একটি প্রকারের নাম। মূলত এটি
কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশ বিনিয়োগ মুরাবাহা নামেই হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা দরকার যে,
ফিকহের কিতাবাদিতে বর্ণিত মুরাবাহা ও ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত মুরাবাহার মাঝে
পার্থক্য রয়েছে। ফিকহে বর্ণিত মুরাবাহা  হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি তার কোনো বস্তত
ক্রয়মূল্যের অধিক দামে অন্যের নিকট বিক্রয় করা। এখানে পণ্যটি আগে থেকেই বিক্রেতার মালিকানায় রয়েছে এবং তা নগদ বা বাকি যেকোনো মূল্যে বিক্রি হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের মুরাবাহায় বিক্রেতার (ব্যাংক) নিকট আগে থেকে কোনো পণ্য থাকে না;
বরং ক্রেতার (বিনিয়োগ গ্রহণকারী) সাথে বিক্রয়-চুক্তি সম্পাদনের পর ব্যাংক তা ক্রয়
করে থাকে। অতঃপর অধিকমূল্যে বাকিতে/কিস্তিতে বিনিয়োগগ্রহীতার নিকট বিক্রি
করে থাকে। এক্ষেত্রে মূল্য আদায়ের সময় বিবেচনায় এনে পণ্যের দাম কমবেশি করে থাকে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবলম্বন করা উক্ত ‘মুরাবাহা’ যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতি নয় তথাপি শর্তসমূহ যথাযথ পালন করলে তা
জায়েযের পর্যায়ে এসে যায়। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার সূচনালগ্নে পরিবেশ-পরিস্থিতি
মূল্যায়ন করে যুগের ফকীহগণ প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকগুলোকে মুরাবাহা করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপকভাবে মৌলিক ও আদর্শ বিনিয়োগ মুযারাবা চালু করার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন।

ইসলামী ব্যাংকিং এ মুরাবাহা জায়েয হওয়ার শর্তাবলি:

১. ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে পণ্য আসার পূর্বে তা বিক্রি করতে পারবে না।
অর্থাৎ বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যাংকের নিকট পণ্য চাওয়ার পর প্রথমে ব্যাংককে তা
খরিদ করতে হবে এবং হস্তগত করতে হবে। এরপর সে ক্লায়েন্ট-এর নিকট তা বিক্রি
করতে পারবে।
২. কোনো না জায়েয-হারাম পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
৩. ব্যাংক যে পণ্য গ্রাহকের নিকট বিক্রি করবে তা যদি এমন হয় যে, গ্রাহক নিজেই
এর মালিক এবং সে ব্যাংকের নিকট তা নগদে কম মূল্যে বিক্রয় করে পরে আবার
বাকিতে বেশি মূল্যে তা ক্রয় করে নিচ্ছে তবে কারবারটি হারাম  হবে এবং সুদের
অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ যার নিকট বিক্রি করবে তার থেকেই এ মুহূর্তে পণ্যটি খরিদ
করেছে এমন হওয়া চলবে না।
৪.বাস্তবভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে। এমন হওয়া চলবে না যে, কোনো দোকানে আগে থেকেই ব্যাংকের এমন চুক্তি রয়েছে যে, আমরা তোমার কাছ থেকে কোনো পণ্য খরিদ
করে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করলে সে আবার তোমার নিকট কম মূল্যে তা বিক্রি করে দিবে। অর্থাৎ বাস্তবভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে, হীলা-বাহানা হলে চলবে না।
৫. কারবারটি এমন হতে হবে যাতে বাস্তবেই ক্রেতার (ক্লায়েন্ট) ঐ পণ্যের জন্য অর্থায়ন দরকার। যদি এমন হয় যে, শুধু পণ্যের নাম ব্যবহার করে নগদ টাকা বিনিয়োগ নিচ্ছে
পণ্য খরিদের কোনো ইচ্ছা নেই তাহলে কারবারটি হারাম হবে।
৬. ব্যাংকের নিকট বিনিয়োগপ্রার্থী (ক্লায়েন্ট) যদি এমন জিনিস খরিদের নামে টাকা নেয়,
যা আগেই সে খরিদ করে ফেলেছে অথবা তা কাজেও লাগিয়ে ফেলেছে এখন সে সব
পণ্যের বকেয়া মূল্য পরিশোধের জন্য অথবা টাকার অন্য কোনো প্রয়োজন হওয়ায় ঐ পণ্যের নামে ব্যাংকের সাথে মুরাবাহা করছে তবে তা-ও হবে হারাম ও সুদী কারবার।

উল্লেখ্য যে:

৫ ও ৬ নং-এর ত্রুটিগুলো হয়ে থাকে এজন্য যে, ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই নিজে পণ্য
খরিদ করতে যায় না এবং তা নিজ রিস্কেও নেয় না।
৭. মুরাবাহার একটি অপরিহার্য শর্ত হল, পণ্যটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ব্যাংকের দায়িত্বে
ও তার রিস্কে যেতে হবে। যে সময়ের মধ্যে সেটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা ব্যাংকের ক্ষতি বলেই ধর্তব্য হবে। যদি মুরাবাহার পণ্য ক্লায়েন্ট (গ্রাহক) কে বিক্রির পূর্বে এমন কোনো
ঝুঁকি (রিস্ক) ব্যাংক বহন না করে তবে কারবার  হারাম হবে।
হযরত মাওলানা তকী উছমানী এবং অন্যান্য ফকীহগণের (যারা ব্যাংকের মুরাবাহার অনুমোদন দিয়েছেন) মতে এটিই একমাত্র শর্ত যা মুরাবাহাকে সুদী কারবার থেকে
ভিন্ন করে। কারণ সুদী লোনের মধ্যে ব্যাংক ক্লায়েন্টকে টাকা দেওয়ার পর তার কোনো
রিস্ক সে বহন করে না। এখন যদি মুরাবাহাতেও এমনটি ঘটে এবং গ্রাহক তথা ক্লায়েন্টকে পণ্য হস্তান্তরের পূর্বে ব্যাংক তার ঝুঁকি বা রিস্ক গ্রহণ না করে তবে কারবারটি হবে সুদী লেনদেনের নামান্তর।
৮. মুরাবাহার আরেকটি শর্ত হল ক্লায়েন্টের নিকট নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করে
দেওয়ার পর তা আর বৃদ্ধি করা যাবে না। অর্থাৎ সনাতনী ব্যাংকগুলো যেমন বছরান্তে
বা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুদের হার বাড়িয়ে দেয় সেভাবে মুরাবাহা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি
করা যাবে না। করলে তা সুদ হবে।
                                                                                                                           (চলবে ইনশাআল্লাহ)