ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা-3

দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে অথবা তাদের
কারবার সম্পর্কে অবগত আছেন এমন যে সকল পাঠক মুরাবাহার উপরের শর্তগুলো এখানে পড়লেন তারা হয়ত অবাক হয়ে লক্ষ করবেন যে, এগুলোর অনেকাংশই
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পালন করে না। ক্লায়েন্টগণ ও অভিজ্ঞমহল ব্যাংকের মুরাবাহা বলতে বুঝেন, কাঙ্খিত টাকার জন্য সে পরিমাণ মূল্যের মেমো ক্লায়েন্ট কর্তৃক ব্যাংকে হাজির করা এবং কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্লায়েন্টকে ব্যাংককর্তৃক
চেক প্রদান করা। অনেক ব্যাংকের কর্মকর্তাগণই স্বীকার  করে থাকেন যে, তারা গ্রাহক কর্তৃক প্রদর্শিত মেমোর মাধ্যমেই ব্যাংকের খরিদদার হওয়া এবং তা হস্তগত করার
দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। ব্যাংক বা তার প্রতিনিধি কর্তৃক প্রথমে পণ্য ক্রয় করে তা হস্তগত করে নিজরিস্কে নিয়ে অতপর গ্রাহককে বিক্রি করা এত কিছুর প্রয়োজনীয়তা তারা
অনুভব করেন না। কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য গ্রাহক থেকে যে সকল কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে থাকে তার মধ্যে একটি কাগজ ওকালত সম্পর্কিত নিয়োগপত্রও থাকে।
অর্থাৎ ব্যাংক গ্রাহককে তার পক্ষ থেকে মালামাল ক্রয়ের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ
করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনা এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায়। এরপরই পণ্য বিক্রয়ের পেপারসে স্বাক্ষর রেখে কাঙ্ক্ষিত টাকার চেক দিয়ে গ্রাহককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অথচ ঐ নিয়োগের দ্বারা সে প্রতিনিধির দায়িত্ব পেল মাত্র। এরপর যদি লোকটি সৎ হয়
এবং বাস্তবেই ঐ টাকা দ্বারা পণ্যটি খরিদ করে তবে ঐ পণ্যের মালিক তো হল ব্যাংক।
এখন ব্যাংক তার কাছে বিক্রির পূর্বে এটি তো তার পণ্য হল না। সে ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসাবে নিজের কাছে তো আর তা বিক্রয় করতে পারে না। এতো গেল ভালো গ্রাহকের
কথা, যে টাকা দ্বারা পণ্য ক্রয় করছে। কিন্তু ব্যাংকের উদাসীনতার  সুযোগে অনেক
গ্রাহক এমনও থাকে যারা বাস্তবে পণ্য ক্রয়ের কাছেও যায় না; বরং কাঙ্ক্ষিত টাকা
হস্তগত করে তা ইচ্ছামতো খরচ করে। আবার কেউ কেউ ঐ টাকা দ্বারা পূর্বে খরিদকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে থাকে, যা ব্যাংকে যাওয়ার আগেই সে নিজের জন্য খরিদ করেছিল।

অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃষ্টান্ত:

গতকাল এক আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নিজ
বাড়িতে কাজের জন্য কিছু রড/সিমেন্ট বাকিতে ক্রয় করেছেন। সময়মতো টাকা
হাতে না আসায় মূল্য পরিশোধ করতে পারেননি। ভদ্রলোক গেলেন তার এলাকার
একটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায়। তারা মুরাবাহা করতে রাজি হল। তিনি ঐ দোকান
থেকেই মেমো নিয়ে দিলেন এবং তার কাঙ্ক্ষিত এক লক্ষ টাকা গ্রহণ করে দোকানের বকেয়া আদায় করলেন। ওয়াকিবহাল মহল জানেন যে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ
নয়; বরং এ জাতীয় ঘটনাই ব্যাংকগুলোর ‘মুরাবাহার’  সাধারণ চিত্র।
দু-এক জন ব্যতিক্রমী। আল্লাহওয়ালা শাখা ম্যানেজারের অথবা বিনিয়োগের সাথে
জড়িত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে ভালো কথাও অবশ্য শোনা যায়, যারা মুরাবাহার শর্তগুলো
পুরো করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ব্যাংকপাড়ায় তা শুধুই ব্যতিক্রম। ইজারা (লিজিং)
ইসলামী ব্যাংকগুলো মুরাবাহার পর যে বিনিয়োগটি বেশি করে থাকে তা হচ্ছে ইজারা
বা লিজিং। মুরাবাহার মতো ইজারাও শরীয়তের মৌলিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়।ইসলামী ব্যাংকিং শুরুর পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে এটির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। কিমত্ম মুরাবাহার  মতো এখানেও শর্তের
লংঘন হয়ে থাকে বহুভাবে। যেমন শরীয়তের নির্দেশ হল, লিজকৃত পণ্যের কোনো
ক্ষতি হলে (তা যদি লিজগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত না ঘটিয়ে থাকে) তবে এর দায় দায়িত্ব লীজ
দাতার উপর বর্তাবে এবং গ্রহীতা থেকে কোনো ক্ষতি পূরণ নেওয়া যাবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে কি হয়ে থাকে তা তো সবারই জানা রয়েছে। এমনিভাবে মধ্য মেয়াদে
একক সিদ্ধান্তে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিও শরীয়তে নিষিদ্ধ।
‘মুরাবাহা’ সম্পন্ন হওয়ার পর মূল্য বাড়ানো যায় না এমতাবস্থায় মাঝপথে এসে
মুরাবাহাকে এইচপিএসএম (হায়ার পারচেজ শিরকাতুলমিলক) এ রূপান্তর করে ১১% লভ্যাংশ (ভাড়া) থেকে ১৩% এ উন্নীত করে কোনো কোনো ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহককে
নোটিশ দেওয়ার নজিরও এ ঢাকাতেই আছে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর সিমা লঙ্গন:

বিনিয়োগসমূহ এবং এগুলোতে শরীয়া লংঘনের বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। তবে
যেহেতু এ লেখার উদ্দেশ্য নেতিবাচক নয়,তাই গ্রাহক ও সংশ্লিষ্ট মহলের জরুরি
অবগতির জন্য এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে । ইসলামী ব্যাংকগুলো
ঋণের পুন: তফসিলিকরণ, ক্রেডিট ট্রান্সফার, কলমানি দেওয়া ও নেওয়া এবং
সনাতনী ধারার ব্যাংকগুলোর সিন্ডিকেটের সাথে মিলে প্রজেক্ট ফাইনান্স করা,
আমদানি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পণ্য নিজের দখলে ও রিস্কে আনার পূর্বেই বিক্রি
করে দেওয়া, বাইয়ে সালামে শর্তগুলোর অনুসরণ এবং আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের বিভিন্ন পর্যায়ে শরীয়া পরিপালনের বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন  করে থাকে তাও
অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন। আর চার্জের বিষয়টিতে কোনো কোনো ইসলামী ব্যাংক
তো বেশ অগ্রগামী। টিটির টেলিফোন করতে চার্জ নেওয়া হয় ৩০/- টাকা। অথচ সময়
ব্যয় হয় ১ থেকে ২ মিনিট। বাস্তব খরচ ১ থেকে ২টাকা। আজব ধরনের অনলাইন চালু
করে সিটির ভিতরও চার্জ নেওয়া হচ্ছে। গ্রাহক তার একাউন্টে একই সিটির অন্য ব্যাংকে
চেক জমা করল, চেকটি হয়ত ফেরত আসল, অমনিতেই তার একাউন্ট থেকে টাকা
কেটে নেওয়া হল ইত্যাদি অনেক নজির রয়েছে। যেগুলোর শরঈ মাসআলা জানারও প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি? এখানে একথাও উল্লেখ্য যে, কারবারের ক্ষেত্রে সুদ থেকে
বাঁচা যেমন জরুরি তেমনি অন্যান্য নাজায়েয ও নিষিদ্ধ কাজ থেকেও বিরত থাকা কর্তব্য। কোনো কারবার বাতিল নয়; বরং তা ফাসিদ  অথবা পুরো সুদী নয়; বরং আংশিক সুদী
শুধু এ কারণে তা জায়েয হয়ে যায় না।
আগেই বলা হয়েছে, এ লেখার উদ্দেশ্য ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা
নয়; বরং শুধুই সংশোধনের বা ইসলাহের জন্য তা লেখা হয়েছে।
একটি তাহকীকী তথ্য তুলে ধরা হল, এ যুগে ইসলামী ব্যাংকিং সম্ভব এবং যতগুলো
ইসলামী ব্যাংক দেশে আছে সেগুলো সমৃদ্ধি লাভ করুক আর এ কাতারে আরো
ব্যাংক শামিল হোক কিন্তু অবশ্যই নতুন বা পুরাতন সকল ইসলামী ব্যাংককে হতে
হবে শরীয়া পরিপালনের দিক থেকে আপোষহীন ও কোয়ালিটি সম্পন্ন।

শুধু ইসলামী নামসর্বস্ব কোনো কিছুই কাম্য নয়।

দুনিয়ার সকল ব্যাংকে টাকা রাখতে গিয়ে মানুষ প্রথমেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে থাকে। তাই অনেক মহলের কয়েকগুণ বেশি সুদের অফারে সাড়া না দিয়ে স্বল্প সুদের বিনিময়ে ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখে থাকে। সুতরাং ব্যাংকের দায়িত্ব হল তাকে সে নিরাপত্তা
দেওয়া এবং তারা তা দিয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোর একাউন্টধারী ডিপোজিটারগণ শুধু নিরাপত্তার বিবেচনায় তাদের কাছে টাকা রাখেন না; বরং তারা কষ্টার্জিত অর্থ এ ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করে কিছু হালাল মুনাফার আশায়।
সুতরাং ইসলামী ব্যাংকগুলো তথা এর মালিকপক্ষের প্রধান দায়িত্ব হল মানুষকে
দেওয়া মুনাফা হালাল হওয়ার বিষয়টি শরীয়তের কষ্টিপাথরে নিশ্চিত করা।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর ইসলামাইজেশনের জন্য সংক্ষিপ্ত কিছু সুপারিশ নিম্নে প্রদত্ত হল।
এ সুপারিশগুলোর প্রতি নজর দেওয়া ছাড়াও ইসলামী ব্যাংকগুলোর কর্তব্য হল তাদের শরীয়া পরিপালনের সূচক উর্ধ্বগামী করার জন্য আর যা যা করার দরকার সবকিছু করার জন্য এখনেই নেমে পড়া এবং সুদ ও নাজায়েয-হারাম কারবারের লানত থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষার জন্য বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১. মালিক পক্ষের সদিচ্ছা
ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরীয়া পরিপালন তথা ইসলামাইজেশন নিশ্চিত করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন মালিক পক্ষ তথা বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সাদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
শরীয়া বিষয়ে যদি তারা আপোষহীনভাবে ঐকান্তিক ও আন্তরিক না হন, যদি ইসলামী
হওয়া সত্ত্বেও তারা সুদের সাথে একই গতিতে, একই পথে এবং একই পন্থায় (শুধু নাম
ভিন্ন করে) দৌড়াতে থাকেন তবে ইসলামাইজেশন কখনো সফল হবে না।
২. কর্মীদের প্রশিক্ষণ
প্রথম শর্ত পূরণের পর ২য় কাজটি হল সংশ্লিষ্ট  কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে গ্রুপ গ্রুপ
করে দীর্ঘ মেয়াদী প্রয়োজনীয় (শরীয়া পরিপালন বিষয়ক) প্রশিক্ষণ দেওয়া। আমরা
জানি যে, এসব ব্যাংকে কর্মরত অনেক ভাই শরীয়তের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। কিন্তু
পুরো জীবন পুঁজিবাদী পদ্ধতির উপর পড়াশোনা করে আসা অথবা সে লাইনে কাজ
করে আসা কাউকে ২/৪দিন বা সপ্তাহ খানেক কয়েক ঘন্টার কর্মশালার মাধ্যমে তো
আর ইসলামী ব্যাংকিং শিখিয়ে ফেলা যায় না।

৩. ইসলামী শরীয়া কাউন্সিল:

মালিক পক্ষের সদিচ্ছার পর ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়া পরিপালন নিশ্চিত করার
জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন একটি শরীয়া কাউন্সিল যাদের হাতে থাকবে প্রচুর ক্ষমতা যারা এডভাইজারী কাউন্সিল না হয়ে সুপারভাইজারি কাউন্সিল হবে।তবে ঐ
বোর্ডের সদস্য হতে হবে এমন যোগ্য আলেমে দ্বীনকে যিনি কুরআন-হাদীসকে মূল
থেকে (অনুবাদ থেকে নয়) বোঝার ও বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা রাখেন। যিনি ফিকহ
বিষয়ক মৌলিক লেখাপড়া করেছেন,যিনি ফিকহুল মুআমালাত সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান রাখেন এবং যিনি একনিষ্ঠ, কর্মঠ ও সৎসাহসী। ব্যাংকওয়ালাদেরকে চেষ্টা-তদবীর করেও শরীয়া পালন করাতে ব্যর্থ হলে যিনি ঘোষণাদান পূর্বক ইস্তফা প্রদান করতে
দ্বিধা করবেন না। যিনি অযথা নাজায়েয ও মাকরূহ কাজগুলোকে হীলা-বাহানার
আশ্রয় নিয়ে জায়েয করার চেষ্টা করবেন না অথবা নিজে কাউন্সিলে আছেন শুধু এ
কারণে কাউকে ইসলামী হওয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে দিবেন না। এখানে উল্লেখ করা
যেতে পারে যে, মাওলানা তকী উছমানী সাহেবের কিন্তু একাধিক ব্যাংকের শরীয়া
কাউন্সিল থেকে ঘোষণা পূর্বক ইস্তফা প্রদান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
৪. শাখায়-শাখায় শরীয়া বিশেষজ্ঞ:
মজবুত ও যোগ্য শরীয়া কাউন্সিলের সাথে সাথে প্রতিটি শাখায় এক বা একাধিক যোগ্য
ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলেম শরীয়া কাউন্সিল প্রতিনিধিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যার স্বাক্ষর ছাড়া কোনো বিনিয়োগ অনুমোদিত হবে না। যিনি শরীয়া পরিপালনে ঐ শাখার লোকজনকে সাহায্য করবেন এবং ব্যাংকের ক্লায়েন্ট ও
অন্যান্যদের শরীয়া বিষয়ক পরামর্শ ও অভিযোগ শুনবেন আর তাদের প্রশ্নের
জবাব দিবেন।
৫. শরীয়া বিষয়ক অভিযোগ সেল
উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা শহরে
শরীয়া বিষয়ক অভিযোগ সেলও থাকতে হবে। যেখানে শরীয়া বিশেষজ্ঞগণ
এসংক্রান্ত অভিযোগের শুনানী করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
 উপরোক্ত সুপারিশগুলো এবং এ জাতীয় অন্যান্য শর্তাবলি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত
হলেই কেবল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইসলামী হওয়ার বিষয়টি যথার্থ হবে।
আল্লাহ তাআলাই নেক কাজের তাওফীক দাতা।